বাংলাদেশে দুর্নীতি সামান্য কমলেও উদ্বেগজনক

ন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। তবে স্কোর ৩-এর নিচে থাকায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা থেকে বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে ২ দশমিক ৭, যা গত বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩ বেশি। গত বছর স্কোর ছিল ২ দশমিক ৪। এ হিসাব অনুযায়ী স্কোরের কিঞ্চিৎ অগ্রগতি হয়েছে। এবার যৌথভাবে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া।


তুলনামূলক কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড।গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) দুর্নীতি বৃদ্ধি ও হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের এ অবস্থান তুলে ধরা হয়। গতকাল বার্লিন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে টিআইর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করা হয়। একই দিনে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির
ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিআইবি)। এবার ১৮২টি দেশের ওপর জরিপ করে এ ধারণা সূচক তৈরি করা হয়। এ বছরের সূচকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রায় সব তথ্যসূত্রের মেয়াদকাল ২০১০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ এবারের সূচকে ২০১০-পরবর্তী সময়ের দুর্নীতির অবস্থার প্রতিফলন পাওয়া যাবে না।
টিআইর জরিপ অনুযায়ী এ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, ঘুষ এবং নানা ক্ষেত্রে গোপন সিদ্ধান্তের ফলে দুর্নীতি হয়েছে। অনেক দেশের সরকারই তাদের জনগণকে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গতকাল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে টিআইবি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০১১ প্রকাশ করা হয়। এ সময় বক্তব্য রাখেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিআইর তৈরি দুর্নীতির ধারণা সূচকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। উপস্থিত ছিলেন সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান এম. হাফিজউদ্দিন খান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, টিআইর তালিকায় উচ্চক্রম অনুসারে ১৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০। নিম্নক্রম অনুসারে ১৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। গত বছর ১৮৭টি দেশের মধ্যে নিম্নক্রম অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। বাংলাদেশের ৯টি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর পর ওই স্কোর নির্ধারণ করা হয়। এ বছর বাংলাদেশের মতো একই স্কোর করে একই অবস্থানে রয়েছে আরও আটটি দেশ। এগুলো হলো_ ইকুয়েডর, ইথিওপিয়া, গুয়েতেমালা, ইরান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া, মোজাম্বিক এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ।
এবার দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে যৌথভাবে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়াকে এবারই প্রথম জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং দেশটি দুর্নীতির শীর্ষে স্কোর অর্জন করে। সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়ার যৌথ স্কোর হলো ১ দশমিক শূণ্য। সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়ার পরেই দুর্নীতিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে যৌথভাবে আফগানিস্তান ও মিয়ানমারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যৌথভাবে তাদের স্কোর ১ দশমিক ৫।
চলতি বছরে তুলনামূলক কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। যার প্রাপ্ত স্কোর ৯ দশমিক ৫। দুর্নীতি কমার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক। দেশ দুটির প্রাপ্ত স্কোর ৯ দশমিক ৪। দুর্নীতি হ্রাসে ৯ দশমিক ৩ স্কোর পেয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে সুইডেন। অন্যদিকে এশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর পঞ্চম স্থানে রয়েছে ৯ দশমিক ২ স্কোর পেয়ে। গত বছর কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে থাকা ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ডের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের স্কোর ছিল ৯ দশমিক ৩। এ হিসাব অনুযায়ী দেশটি পিছিয়েছে।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতির ধারণা সূচকে এবার বাংলাদেশের স্কোরের যৎসামান্য উন্নতি হয়েছে। এ কিঞ্চিৎ অগ্রগতি ধরে রাখার দায়িত্ব সরকারের। আগামীতে স্কোরের অবনতি হলে তা হবে সরকারের ব্যর্থতার কারণেই।
নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশও অবস্থান করছে। তিনি বলেন, সূচকে বাংলাদেশের স্কোর কিঞ্চিৎ উন্নতি হওয়ায় দুর্নীতির মাত্রা সামান্য হলেও রোধ করা সম্ভব হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এক্ষেত্রে আরও ভালো করা যেত। তিনি বলেন, আইন সংশোধন করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব, সংসদে অনুপস্থিতি, বয়কট, কোরাম না হওয়া, ৪ মিনিটে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ, সংসদে কারও একচ্ছত্র অবস্থান, কেনাকাটায় দুর্নীতি, ভূমি দখল, রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাদের প্রভাব, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না হওয়াসহ নানা বিষয় দুর্নীতিকে প্রভাবিত করছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, দিনের পর দিন তাদের প্রশ্রয় না দিয়ে আইন অনুযায়ী বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলংকা এবারও বাংলাদেশের তুলনায় উন্নততর অবস্থানে থাকলেও তারাও দুর্নীতিতে উদ্বেগপূর্ণভাবে চিহ্নিত। এর মধ্যে এবার ভারতের স্কোর ৩ দশমিক ১, যা গত বছর ছিল ৩ দশমিক ৩। এবার শ্রীলংকার স্কোর ৩ দশমিক ৩। গত বছর ছিল ৩ দশমিক ৩। এ ছাড়া ভুটান পেয়েছে ৫ দশমিক ৭ স্কোর, ইতালি ৩ দশমিক ৯, থাইল্যান্ড ৩ দশমিক ৪, চীন ৩ দশমিক ৬, মালয়েশিয়া ৪ দশমিক ৩, তুরস্ক ৪ দশমিক ২, হাঙ্গেরি ৪ দশমিক ৬ এবং পোল্যান্ডের স্কোর ৫ দশমিক ৫। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারতের স্কোর গত বছরের তুলনায় কমেছে। বাকি দেশগুলোতে স্কোর বাংলাদেশের মতোই সামান্য বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, এবার ১৩টি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত ১৭টি জরিপের ওপর নির্ভর করে সিপিআই সূচক তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৯টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো হলো_ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কান্ট্রি পারফরমেন্স অ্যাসেস্মেন্ট রেটিংস, বার্টেলসমান ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত বার্টেলসমান সাস্টেইনেবল গভর্নেন্স ইনডিকেটর, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পরিচালিত কান্ট্রি রিস্ক সার্ভিস অ্যান্ড কান্ট্রি ফোরকাস্ট, আইএইচএস গ্গ্নোবাল ইনসাইটের গ্গ্নোবাল রিস্ক সার্ভিস, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রকল্পের রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস রিপোর্ট, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেস্মেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১০-এর রিপোর্ট ও একই প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ অপিনিয়ন সার্ভিসেস-২০১১।

No comments

Powered by Blogger.