পার্বত্য শান্তিচুক্তি-বাস্তবায়নে ধীরগতি, বাড়ছে হতাশা ও ক্ষোভ by সজীব চাকমা

চুক্তির আলোকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা স্থাপন এবং তৎসংশ্লিষ্ট কমিটি গঠন বা পুনর্গঠন করা হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সন্তোষজনক কোনো অগ্রগতিই লক্ষ্য করা যায় না। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের মেয়াদ তিন বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, অথচ চুক্তি বাস্তবায়নের কাজে এই সরকার একের পর এক প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনো অগ্রগতিই দেখাতে পারেনি১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ ১৪ বছর অতিক্রান্ত হতে


চলেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চুক্তির অধিকাংশ মৌলিক বিষয় অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে চুক্তি নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে চুক্তিবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র ও কায়েমি স্বার্থবাদী নানা তৎপরতার কারণে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করে চলেছে।
চুক্তির 'ক' খণ্ডের ১নং ধারায় 'পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি (আদিবাসী জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন'-এর বিধান রাখা হলেও এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ কোন আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে চুক্তির আগের সময়ের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ, বসতি স্থাপন, ভূমি বেদখল অব্যাহতভাবে চলছে এবং ক্রমাগত আদিবাসী জুম্মরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। পার্বত্যাঞ্চলের সব পৌরসভা ও জেলা শহরগুলোতে আদিবাসী জুম্মরা ইতিমধ্যে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় চুক্তির 'উপজাতি (আদিবাসী জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ'-এর বিধানটি ক্রমাগত খর্ব হয়ে চলেছে।
এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করে এ অঞ্চলে সব নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থাপন করা হলেও নানা জটিলতার কারণে সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারছে না।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও সেই মন্ত্রণালয় চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নমুখী কোনো কার্যকর ও উদ্যোগী ভূমিকাই গ্রহণ করে না। বরং প্রায় সময়ই এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও আমলাদের ভূমিকা থাকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিকূলে।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলেও সরকার এখনও পরিষদের কার্যবিধিমালা প্রণয়নের কার্যক্রম ঝুলিয়ে রেখেছে। আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক পার্বত্য জেলা পরিষদের বিষয়াদির সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়, পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদগুলোর তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় এবং সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রমসহ এনজিও কার্যাবলির সমন্বয় সাধন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ওপর সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধান ইত্যাদি দায়িত্ব-ক্ষমতার বিধান থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকর হতে পারছে না। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারছে না এবং ভূমিকা রাখতে পারছে না।
আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচনের জন্য এখনও পর্যন্ত পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ও চুক্তি মোতাবেক ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। নির্বাচন না হওয়ায় এসব পরিষদে গণতান্ত্রিক পরিচালনা ব্যবস্থা চালু হতে পারেনি। বিশেষ করে দীর্ঘ বছর ধরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া ও ক্ষমতাসীন দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান-সদস্য মনোনয়ন দিয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার ফলে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো কোনো প্রকার জবাবদিহিতা ব্যতিরেকেই পরিচালিত হচ্ছে। ফলে জনগণ তাদের ন্যায্য সেবা ও অধিকার থেকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হচ্ছে।
ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও এই টাস্কফোর্সের কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২২ পরিবার শরণার্থীর মধ্যে ৯ হাজার ৭৮০ পরিবার তাদের ধানি জমি, বাগান-বাগিচা ও বাস্তুভিটা ফেরত পায়নি। তাদের জায়গা-জমি ও গ্রাম এখনও বহিরাগত সেটেলারদের দখলে থাকায় তাদের পুনর্বাসন এখনও যথাযথভাবে হতে পারেনি। অন্যদিকে চুক্তির মূল স্পিরিট লঙ্ঘন করে কাজ করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজও একেবারে গোড়ায় আটকে রয়েছে। এ ব্যাপারেও আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
চুক্তি অনুযায়ী সব অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থাপিত পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী সেনাক্যাম্পের মধ্যে প্রথম অবস্থায় মাত্র ৩১টি ক্যাম্প প্রত্যাহারের চিঠি জনসংহতি সমিতির হস্তগত হয়। আর বর্তমান সরকার কর্তৃক এ পর্যন্ত আরও ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সর্বোপরি পার্বত্য সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি ভূমি কমিশন গঠন করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই জাতীয় সংসদে এই আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনে চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করা হলেও এখনও পর্যন্ত তা সংশোধন করা হয়নি। ফলে ভূমি কমিশন গঠিত হলেও ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির কাজ যথাযথভাবে এগুতে পারছে না। আর বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে নিযুক্ত কমিশনের চেয়ারম্যানের একতরফা ও চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক ভূমিকার কারণে স্বয়ং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যানই একের পর এক বিরোধের জন্ম দিয়ে চলেছেন।
বস্তুত চুক্তির আলোকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা স্থাপন এবং তৎসংশ্লিষ্ট কমিটি গঠন বা পুনর্গঠন করা হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সন্তোষজনক কোনো অগ্রগতিই লক্ষ্য করা যায় না। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের মেয়াদ তিন বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, অথচ চুক্তি বাস্তবায়নের কাজে এই সরকার একের পর এক প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনো অগ্রগতিই দেখাতে পারেনি। এ পর্যন্ত এই সরকার চুক্তি মোতাবেক একটি বিষয়ও জেলা পরিষদে হস্তান্তর করেনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আপামর জনগণের দাবি সত্ত্বেও 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, বিপরীতে বাংলাদেশের সব জনগণকে 'বাঙালি' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করলেও চুক্তির আলোকে প্রণীত আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলো সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে এই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার চরম ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের বিলম্বকে পুঁজি করে, সংকীর্ণ কায়েমি স্বার্থবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী চুক্তিবিরোধীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের লক্ষ্যে নানা নাশকতামূলক ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশাকে পুঁজি করে নানা বিভ্রান্তিকর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
ফলে যে লক্ষ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় সে লক্ষ্য আজ ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হতে চলেছে। বিশেষ করে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর ভূমিকার অনুপস্থিতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ বঞ্চিত ও নিপীড়নের শিকার আদিবাসী জুম্মদের মধ্যে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর যা-ই হোক শান্তি, সংহতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। সমস্যাটি সমাধানের বিপরীতে বরং অধিকতর জটিল আকারই ধারণ করবে। আর তা সমাধানের জন্য হয়তো আরও কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এতে হয়তো অনেক মূল্য দিতে হতে পারে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যখন গণতান্ত্রিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় এ অঞ্চলের বিশেষ সমস্যার কথা, বঞ্চিত আদিবাসী জুম্মদের (পাহাড়িদের) ন্যায্য অধিকারের কথা তৎকালীন জাতীয় নেতাদের কাছে বারবার তুলে ধরার, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন দু'একজন বাদে তাতে কেউ গুরুত্ব দেননি। বিশেষ করে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যারা এসব সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসার কথা, তারাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল, অমনোযোগী। একদিকে জুম্ম জনগণের অধিকারের জন্য আন্দোলন, অন্যদিকে সরকারের উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও দমন-পীড়ন। ফলে সমস্যাটির একটা প্রীতিপূর্ণ, কল্যাণময় ও শ্রদ্ধাপূর্ণ সমাধানের বিপরীতে অবিশ্বাস ও সংঘাতের দিকেই মোড় নেয়। এ জন্য পাহাড়ি-বাঙালি অনেকের অনেক রক্ত ঝরেছে। সরকারকেও অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতোই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিটিও বিশেষত পাহাড়ি জনগণের কাছে অনেক রক্ত, অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অগণিত মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত অধিকারের সনদ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জাতীয় স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান এবং জাতীয় সংহতি ও শান্তির লক্ষ্যেই ঐতিহাসিক এক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে সামগ্রিক স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন জরুরি। এই সরকারের অবশিষ্ট দুই বছরের মেয়াদের মধ্যেই চুক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে পার্বত্য সমস্যার অনেক জটিল দিকও সমাধানের সূত্র খুঁজে পাবে।

সজীব চাকমা : কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.