অর্থনীতি পঙ্গু :দেশ দেউলিয়ার পথে

দেশের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, আজ দেশ দেউলিয়ার পথে যাচ্ছে। এ জন্য বর্তমান সরকারের অদক্ষতাকে দায়ী করেন তিনি। ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থনীতি আজ গভীর সংকটে নিমজ্জিত। অর্থনীতির আজ পঙ্গুদশা। ১৯৭৪ সালের পর এমন অবস্থা কখনও হয়নি।


দেশকে ভিনদেশি প্রভুদের কাছে কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে সরকার 'পোড়ামাটি নীতি' অবলম্বন করেছে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য প্রধানমন্ত্রীর এখনই পদত্যাগ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এর বিচার করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার গুলশানের নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এতে মূলত দেশের অর্থনীতির হালচাল নিয়েই বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি। পাশাপাশি টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে আপত্তি
জানিয়ে ড. মনমোহন সিংকে পাঠানো
চিঠির প্রসঙ্গও টানেন। তবে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলন িি.িনহঢ়ষরাব.পড়স-এ সরাসরি দেখানো হয়।
লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, শেয়ারবাজার থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। প্রায় ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। কারসাজির মাধ্যমে তাদের অর্থ লুট করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের ফটকাবাজ বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আন্দোলনরত বিনিয়োগকারীদের 'সুনাগরিক নহে' বলে কটাক্ষ করা হয়েছে।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপকে 'জোড়াতালি' অভিহিত করে তিনি আরও বলেন, এরপরও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব্ব হয়ে যাওয়া হাবিবুর রহমান মঙ্গলবার আত্মহত্যা করেছেন বলে গতকাল সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এ আত্মহত্যা আমাদের ব্যঙ্গ করছে। এসবের দায় নিয়ে এ সরকারের এখনই পদত্যাগ করা উচিত।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিতে সরকারের 'দুর্নীতি' দায়ী বলে দাবি করেন বিএনপি প্রধান। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর অগ্রগতিতে এক মন্ত্রীর অপসারণের শর্ত দিয়েছে দাতারা। দুর্নীতির কারণে সেতুর কাজ আটকে গেছে। সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মূল সমস্যা আড়ালের চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ার এক সাবেক মন্ত্রীকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মালয়েশিয়ার অর্থ সাহায্যে সেতু নির্মাণের একটি প্রস্তাবনা করা হয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সরকারি বক্তব্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। হাস্যকর বিষয় হলো, প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর ভাগ্য অনিশ্চিত থাকা অবস্থায় সরকার দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করেছে।
টিপাইমুখ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের অযোগ্যতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারত আজ আমাদের না জানিয়ে কাজ করছে। এ বাঁধ নির্মাণ হলে মেঘনা অববাহিকায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। হাওরাঞ্চলের পরিবেশ ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়বে। ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকায় বাঁধ হওয়ায় তা ভেঙে গেলে ৮ ফুট পানির নিচে সিলেট তলিয়ে যাবে বলে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। বিষয়টিকে বাংলাদেশের জীবন-মরণ সমস্যা মনে করে এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে উভয় দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সার্বিক সমীক্ষার আহ্বান জানানো হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। দৈনিক ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকায় পেঁৗছেছে। এখন উচ্চ সুদে বাইরে থেকে ঋণ গ্রহণের চিন্তা-ভাবনা চলছে। ১৯৭৪ সালের পর এমন অবস্থা কখনও হয়নি।
জাতীয় অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সরকারের প্রতি আস্থাহীনতায় দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে না। শ্রমবাজারের প্রসারেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সরকার দেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ১১ শতাংশের ওপর, খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। এ জন্য দায়ী সরকারের অব্যবস্থাপনা। সরকারের বাণিজ্য নীতির সমালোচনা করেন বিরোধীদলীয় নেতা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে সরকারের নীতি 'লুটপাটের' পথ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট উত্তরণ ঘটাতে গিয়ে ভর্তুকির চাপে অর্থনীতি আজ সংকটাপন্ন। এ রকম অপরিণামদর্শী নীতি অতীতে আর কোনো সরকার গ্রহণ করেনি।
খালেদা জিয়া বলেন, যুদ্ধে পরাজিত ও দখলদার বাহিনী যেমন জনপদের সব স্থাপনা ও মূল্যবান সামগ্রী পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যায়, সরকারও সে রকম নীতি অবলম্বন করেছে। তারা রেখে যেতে চায় শূন্য কোষাগার, বিশাল ঋণের দায়, ভেঙে পড়া শিল্প-বাণিজ্য ও ধসে পড়া শেয়ার মার্কেট। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যাতে দেশের মানুষ আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আরএ গণি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, ড. আবদুল মঈন খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ ও খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল উপস্থিত ছিলেন।
বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি খাতে 'ঋণ দুর্ভিক্ষের' সৃষ্টি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ৪ মাসেই সরকার পুরো বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে প্রাক্কলন করেছিল তার ৯৮ শতাংশ নিয়ে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত অল্প সময়ের মধ্যে ঋণ নেওয়া নজিরবিহীন।
তিনি অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে বলেন, এখনকার অবস্থা '৭৪-র চেয়েও খারাপ। মানুষ এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি চায়।
সঞ্চয়পত্র নিয়ে সরকার 'আত্মঘাতী নীতি' গ্রহণ করেছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, 'ঘাটতি অর্থায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো সঞ্চয়পত্র বিক্রি। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ধরার কারণে সঞ্চয়পত্র কেনার প্রণোদনা নেই বললেই চলে। ফলে চলতি অর্থবছরে ৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার মতে, সরকারের অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শী নীতির ফলে সব ধরনের জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি বছর ব্যয় ও লোকসানের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি বিদ্যমান মূল্যের চেয়ে বিপিসি কর্তৃক অধিকতর মূল্য প্রদর্শন করে বাড়তি টাকা জনগণের পকেট থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। অদক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে দাম বাড়ার দায়ভার জনগণ মেনে নেবে কেন?
বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, বিনা টেন্ডারে বেসরকারি খাতে নতুন স্থাপিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১৭টিতেই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে এর উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫৮ মেগাওয়াট হলেও বাস্তবে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৪৮৭ মেগাওয়াট। ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র স্থাপনের জন্য শুরুতে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যে বিধান করা হয়েছিল, তা লঙ্ঘন করে তদবিরের জোরে অনভিজ্ঞ দলীয় উদ্যোক্তাদের দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতির ওপর এটি ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের চরম অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত সেপ্টেম্বরে হয়েছে ১১.৯৭ শতাংশ। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দরিদ্র মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

No comments

Powered by Blogger.