দুর্নীতি সূচকে এক ধাপ এগোল বাংলাদেশ

দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বের দেশগুলোর তালিকায় গতবারের চেয়ে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। অর্থাৎ দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। তবে স্কোর ১০-এর মধ্যে এখনো ৫-এর নিচে থাকায় বাংলাদেশ বিশ্বের বেশি মাত্রায় দুর্নীতিতে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পর্যায়েই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৩তম, গত বছর ছিল ১২তম। স্কোর বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ৭। গত দুই বছর ছিল ২ দশমিক ৪।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০১১ সালের এই দুর্নীতির ধারণা সূচকে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিপভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নেওয়া হলেও জুন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এবার ১৮২টি দেশের মধ্যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের ক্রম (র‌্যাংক) ১২০। এই ক্রমে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে আরো আটটি দেশ। গত বছর ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রম ছিল ১৩৪।
এবারও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সোমালিয়া (স্কোর ১.০), উত্তর কোরিয়া তার সঙ্গী হয়েছে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নাম এসেছে নিউজিল্যান্ডের (৯.৫)। বার্লিনভিত্তিক টিআই গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশের বিস্তারিত তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্কোর ০ থেকে ১০-এর ভেতর প্রাপ্ত নম্বর ৩-এর নিচে থাকলে বলা যায়, এসব দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা অনেক বেশি। বাংলাদেশের পয়েন্ট ২ দশমিক ৭। গতবারের তুলনায় এটা ভালো দিক হলেও সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বেগপূর্ণই রয়ে গেছে। কারণ কোনো দেশের স্কোর ৫-এর ওপরে গেলেই কেবল সেই দেশে দুর্নীতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকে বলে ধরা যায়।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সূচকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অগ্রগতি হবে কি না সেটা নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং তা বাস্তবায়নের ওপর। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, সরকারি প্রশাসন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা, স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং কার্যকারিতা বর্তমান সরকার কতটা নিশ্চিত করতে পারে এর ওপরই বাংলাদেশের অগ্রগতি নির্ভরশীল। এ ছাড়া সরকারের ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করাও দুর্নীতি প্রতিরোধের অপরিহার্য বিষয়।
ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো প্রথমদিকে ভালো কাজ করলেও এখন আবার খুব একটা কার্যকর নয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, সরকার বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করলে পরিস্থিতি আরো ভালো হবে। যেসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে সেগুলোকে টেকসই করার জন্য আরো সক্রিয় হতে হবে।
প্রতিবেদন অনুসারে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভুটানের স্কোরই ৫-এর ওপরে (৫.৭)। সার্কের মধ্যে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে দেশটি নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখেছে। ভারতের অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়েছে। গত বছর তাদের স্কোর ছিল ৩.৩, এবার হয়েছে ৩.১। আফগানিস্তান গত বছরের মতো দ্বিতীয় দুর্নীতিপ্রধান দেশের স্থানে থাকলেও স্কোর ১ দশমিক ৪ থেকে বেড়ে ১ দশমিক ৫ হয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার স্কোর ৩ দশমিক ২ থেকে বেড়ে ৩ দশমিক ৩ হয়েছে। সূচকে পাকিস্তান ও মালদ্বীপের অবস্থান রয়ে গেছে গত বছরের মতো ১১তম স্থানে। পাকিস্তানের স্কোর ২.৫। নেপালের স্কোর ২.২।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার বাংলাদেশের সমান পয়েন্ট (২.৭) পেয়েছে ইকুয়েডর, ইথিওপিয়া, গুয়েতেমালা, ইরান, কাজাখস্তান, মোঙ্গলিয়া, মোজাম্বিক ও সলোমন দ্বীপ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত কোনো দেশ পৃথিবীতে নেই। যে দেশটি সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে তারাও ১০-এ ১০ পায়নি। সর্বনিম্ন স্থানের দেশগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে_এসব দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষে বিপর্যস্ত। যেমন_সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়ার পরই রয়েছে আফগানিস্তান ও মিয়ানমার (১.৫), সুদান, তুর্কিস্তান, উজবেকিস্তান (১.৬), ইরাক ও হাইতি (১.৮), বুরুন্ডি, ভেনিজুলিয়া (১.৯), লিবিয়া, কঙ্গো, শাদ, এঙ্গোলা (২.০)। তিনি বলেন, তাই যুদ্ধ ও সংঘাত-সংঘর্ষ বন্ধ না হলে দুর্নীতির প্রবণতা আরো বাড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি কমাতে ক্ষমতাসীন দলের জোরালো নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে তারা এই অঙ্গীকার পূরণে খুব একটা অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হলে বাংলাদেশ পিছিয়েই পড়বে। সংসদকে আরো কার্যকর হতে হবে। বিরোধী দল এ পর্যন্ত ৭৬ শতাংশ সময় চলতি সংসদের বাইরে রয়েছে। দুদকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া কোনো অবস্থায়ই ঠিক হবে না। সরকারি ক্রয়নীতিতে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দুর্নীতির সূচক ফলাফল নির্ধারণে কমপক্ষে তিনটি সমীক্ষাই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এবার ৯টি সমীক্ষা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। ফলে স্বচ্ছতার মাত্রা আরো ভালো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.