বার্লিনে বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনে শেখ হাসিনা-স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও গবেষণায় বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব চাই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নতুন ও ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য এ অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছাতে নেটওয়ার্ক উন্নয়ন এবং মেধা ও সম্পদের ব্যবধান কমাতে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালগুলোকে জোরাল উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। গতকাল জার্মানির বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতালে বিশ্বস্বাস্থ্য শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থাপন করা মূল বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এম-৮ অ্যালায়েন্স এ সম্মেলনের আয়োজন করে।


এম-৮ হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও সুশীল সমাজের সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একাডেমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি অ্যালায়েন্স। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক, একাডেমিক ও সামাজিক কার্যাবলি সম্পাদনে চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবার যৌথ কৌশল ও প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের বার্ষিক বিশ্ব সম্মিলন।
'আজকের বিজ্ঞান আগামী দিনের আলোচ্যসূচি' এ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের বিশ্বস্বাস্থ্য শীর্ষ সম্মেলনে অসংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্য উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা ও বিশ্বস্বাস্থ্য কার্যক্রমে উদ্ভাবনী মডেলের ওপর আলোকপাত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মূল নিবন্ধে বলেন, টেলিযোগাযোগের এ যুগে শিক্ষাবিদ ও হাসপাতালগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা খুবই সহজ। অভিন্ন বিশ্বে ঐক্যবদ্ধ এক সম্প্রদায়ের চেতনা সমুন্নত রাখতে আমরা কীভাবে সফল অংশীদারিত্ব বিকশিত করব_ এটা হচ্ছে তারই উদ্যোগ।
তিনি বলেন, মানোন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ওষুধ সরবরাহ সম্প্রসারণে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। নিম্নমানের চিকিৎসাপণ্য প্রতিরোধের জন্য আমাদের তদারক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ওষুধ শিল্পে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বিদ্যমান মেধাস্বত্ব আইনের সুবিধা ২০১৫ সালের পরও নমনীয় রাখার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা প্রতিষেধক ওষুধের ওপর গুরুত্ব আরোপের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের টিকাদানের মতো সহজ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থার কথা ভুলে যাওয়া চলবে না, কারণ এ ব্যবস্থা রোগব্যাধির বোঝা কমাতে সাহায্য করে। টিকাকে সাশ্রয়ী করে আমরা লাখ লাখ মৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারি। এ জন্য আরও উন্নত ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রয়োজন রয়েছে।
শহরের মানুষের জন্য কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পন্থা উদ্ভাবনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত মৌসুমি রোগের অব্যাহত গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী মানসিক ব্যাধি ও অটিজম সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় শেখ হাসিনা এ ধরনের রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় অভিন্ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জনস্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, বিষয়টি উপেক্ষার পর্যায়েই রয়েছে। এর প্রভাবে ডায়রিয়া, পানিবাহিত রোগ ও অপুষ্টির মতো বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বেড়েছে।
জাপানের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায় জরুরি প্রস্তুতির বিষয় আমাদের আগামী দিনের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন। তিনি অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে গুরুত্বসহকারে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা অধিক উৎপাদনের শক্তি। শ্রমিক প্রেরণ ও নিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের আলোচনা অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা কমাতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিশেষ করে নারী ও শিশুস্বাস্থ্য সবসময়ই অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। দারিদ্র্য বিমোচন, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনার মতো নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোর সঙ্গে সুস্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির ওপর কর প্রত্যাহারে সরকারের উদ্যোগের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার মান উন্নত হয়েছে। রোগীদের চিকিৎসকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে ই-হেলথ কনসালটেশন চালু করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে সাফল্য অর্জন করেছে। এ হার ২০১০ সালে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রতি ১ লাখে ১৯৪-এ কমে এসেছে।
তিনি বলেন, প্রতি বছর ২ লাখ ৭৪ হাজার অন্তঃসত্ত্বা গরিব নারীর জন্য মাতৃত্ব সহায়তা প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এতে গর্ভকালীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সেবার জন্য ২৫ মার্কিন ডলার দেওয়া হয়।
একজন দক্ষ ধাত্রীর উপস্থিতিতে সন্তান জন্মদানের জন্য ২৭ মার্কিন ডলার নগদ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয় উলেল্গখ করে তিনি বলেন, নারীর জন্য উন্নত ক্লিনিক, উচ্চ রক্তচাপের জন্য স্ক্রিনিং সেবা, ডায়াবেটিস ও সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের মতো রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্পদ, পশ্চাৎপদ প্রযুক্তি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
এতদসত্ত্বেও আমরা স্বাস্থ্যখাতে অগ্রাধিকার প্রদান ও বরাদ্দ বৃদ্ধিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, স্বাস্থ্যই সম্পদ এবং জনগণকে মানবসম্পদে রূপান্তর এবং তাদের উন্নত ও মর্যাদাশীল জীবনযাপনের জন্য সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রয়োজন।
তিনি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে জার্মান চ্যান্সেলর ড. অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
বাংলা পাঠশালা পরিদর্শন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জার্মানির বার্লিনে বাংলা পাঠশালা পরিদর্শন করেন। জার্মানিতে বসবাসকারী বাঙালি শিশুরা এই স্কুলে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করছে।
বার্লিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসভবন প্রাঙ্গণে গত ডিসেম্বরে এই স্কুল চালু হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, দুই ভাগি্ন আজমিনা সিদ্দিকী রূপন্তি ও রেজওয়ানা সিদ্দিকী টিউলিপ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও উপস্থিত ছিলেন। জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ মান্নান স্কুলে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান, নৃত্য এবং কবিতা আবৃত্তি করা হয়। এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আওয়ামী লীগ নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গতকাল তার হোটেল সুটে সাক্ষাৎ করেন।

No comments

Powered by Blogger.