সেঁজুতির আত্মহনন-ধর্ষণের বিষয় চেপে গেছে পুলিশ by রফিকুল ইসলাম,

স্কুলছাত্রী সেঁজুতি আক্তারের আত্মহননে প্ররোচনার অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। তাকে অপহরণ চেষ্টার অভিযোগে যে সাত বখাটের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তাদেরই এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। তবে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে আত্মহননের জন্য বখাটেদের আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় সালিসদারদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ধর্ষণের বিষয়টিও চেপে গেছে পুলিশ। এদিকে অপহরণ চেষ্টার তিন দিন পর মামলা রুজুর দায়ে বাকেরগঞ্জ থানার ওসিকে ক্লোজ করা হয়েছে।


সুরতহাল রিপোর্ট : সেঁজুতির আত্মহননের খবর পেয়ে বাকেরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আফজাল হোসেন গত শুক্রবার রাতেই বড় রঘুনাথপুরের বাসায় গিয়ে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। এ সময় সেঁজুতির মা হাফিজা বেগম, ছোট বোন লাইজু আক্তার নিশি, প্রতিবেশী ও ইউপি সদস্য লিলি বেগমসহ ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর রাত আনুমানিক ৮টার দিকে প্রতিবেশী সাইফুল ইসলামসহ সাতজন সেঁজুতিকে অপহরণের চেষ্টা করে। তখন সে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আসামিরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় সেঁজুতির মা ১৭ অক্টোবর বাকেরগঞ্জ থানায় সাতজনের বিরুদ্ধে অপহরণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। কিন্তু আসামিদের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার সালিসদাররা ঘটনা স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য মামলা তুলে নিতে সেঁজুতির পরিবারকে চাপ দেয়। আসামিদের পক্ষ নিয়ে সালিসদাররা বলেন, 'মামলা করে কী হবে? বিচার পাবে না।'
কোনো বিচার মিলবে না_এমন নানা কথা শুনে সেঁজুতি শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে পাঠানো হয়।
ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান আখতারুজ্জামান বলেন, সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করেনি। তা ছাড়া ১৩ অক্টোবরের ঘটনায় ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষনের আলামত থাকার কথা নয়। এর পরও বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলে ভিসেরা সংগ্রহ করা হতো।
দ্বিতীয় মামলায়ও একই আসামি : রবিবার দুপুরে সেঁজুতির মা সাতজনের বিরুদ্ধে বাকেরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলো পাদ্রি শিবপুর ইউনিয়নের বড় রঘুনাথপুর গ্রামের ফারুক মৃধার ছেলে নয়ন মৃধা, আজিজ আকনের ছেলে নাসির আকন, নূরু আকনের ছেলে শামীম আকন, নাছির উদ্দিনের ছেলে রাজীব, মোজাম্মেলের ছেলে সবুজ, মোতালেব প্যাদার ছেলে সাইফুল ইসলাম ও বারেক মৃধার ছেলে নেছারউদ্দিন। তাদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর আগে ১৭ অক্টোবর সেঁজুতিকে অপহরণ চেষ্টার ঘটনায় উলি্লখিত সাতজনকে আসামি করে বাকেরগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়।
হাফিজা বেগম অভিযোগ করেন, 'আসামিরা অব্যাহতভাবে অশ্লীল মন্তব্য ও আমার অন্য দুই মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেওয়ায় সেঁজুতি আত্মহত্যা করেছে। এ ঘটনার আমি সুষ্ঠু বিচার চাই।' বড় বোন শিল্পী বলেন, 'যাদের কারণে আমার বোন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।'
সড়ক অবরোধ : সেঁজুতির আত্মহননের ঘটনায় তার সহপাঠীরা গতকাল অনশন কর্মসূচি পালন করে। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দোষীদের শাস্তির আশ্বাস পেয়ে তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে।
সহকারী শিক্ষক জাফর ইকবাল বলেন, সেঁজুতির আত্মহননের প্রতিবাদে গতকাল চৈতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কাঁঠালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মোল্লা আবু ইউসুফ আলী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে অনশন কর্মসূচি পালন করে।
একই দাবিতে বাকেরগঞ্জে সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টায় বরিশাল-পটুয়াখালী সড়ক অবরোধ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
ওসি ক্লোজড : বাকেরগঞ্জ থানার ওসি সৈয়দ রবিউল ইসলামকে গতকাল বরিশাল পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। অপহরণ চেষ্টার তিন দিন পর মামলা রুজু, আসামিদের সঙ্গে বাদীপক্ষের মীমাংসার চেষ্টার দায়ে তাঁকে ক্লোজ করা হয়েছে। গতকাল বিকেলেই ওসি দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, মামলা দেরিতে রুজুসহ কর্তব্য পালনে অবহেলার কারণে ওসিকে ক্লোজ করা হয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলার সাংঘর্ষিক তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, তদন্তে আসামিদের আত্মীয়স্বজন ও সালিসদারদের সম্পৃক্ততা পেলে অভিযোগপত্রে তাদের নাম যুক্ত হবে।
পরিবারের পাশে মন্ত্রীর প্রতিনিধি : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রতিনিধি হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের উপপরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল সেঁজুতিদের বাড়িতে যান। এ সময় তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি প্রদানে সর্বাত্মক চেষ্টার আশ্বাস দেন।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রী একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িতরা যাতে কোনোভাবে পার না পায়, তা তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.