ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সম্মেলন সমাপ্ত-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে ৫০ দফা সুপারিশ

মূল্যস্ফীতি, সরকারের ঋণ এবং জ্বালানি সংকটকে এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন দক্ষিণ এশীয় চতুর্থ অর্থনৈতিক সম্মেলনের বক্তারা। এ ছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, পারস্পরিক আস্থার সংকট এবং দুর্বল আঞ্চলিক সংযোগ, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনাকে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।রাজধানীর হোটেল রূপসী বাংলায় ২ দিনব্যাপী দক্ষিণ এশীয় চতুর্থ অর্থনৈতিক সম্মেলনের (এসএইএস-৪) শেষ দিনে গতকাল ৫০ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। এর অতিরিক্ত ৭৩ দফা সুপারিশ করা হয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে।


আগামী মাসে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে এসব সুপরিশ পেশ করা হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য গবেষণা সংস্থার সহযোগিতায় এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থার চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-চ্যান্সেলর সৈয়দ বাবর আলী, ভারতের কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের সভাপতি প্রফেসর মুকুন্দ দেব, নেপালের সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. বেক বাহাদুর থাপা ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাংসদ আরিফা খালেদ পারভেজ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সার্কের সাবেক মহাসচিব ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত ইব্রাহিম হোসাইন জাকি, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রমুখ।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দু'দিনের সম্মেলনে মোট ১৩টি অধিবেশেনে বিভিন্ন সেশনে সার্ক ও সার্কের বাইরের ৮৩ বিদেশি অতিথি অংশ নেন।
সম্মেলনের এবারের মূল প্রতিপাদ্য 'বিশ্বমন্দা থেকে উত্তরণ, নতুন ঝুঁকি এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি : দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান পুনর্বিবেচনা'। এর বাইরেও এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয় রয়েছে সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রলম্বিত অর্থনৈতিক মন্দা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব এবং তার মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রস্তুতি এবং অভিন্ন আঞ্চলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
ড. গওহর রিজভী বলেন, সার্কে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান সত্ত্বেও এর ধীরগতির কারণে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাশে। এ লক্ষ্যে ভারতের সম্পর্কে ঝুঁকি নিয়েও সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ সম্পর্ককে সাহসী বিনিয়োগ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আজ হোক কাল হোক এ বিনিয়োগ একদিন ফল দেবেই। এ ছাড়া নেপাল, ভুটান, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে জ্ঞান ও গবেষণা ফল এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্পর্ক বাড়ানোর কথা বলেন।
উল্লেখযোগ্য সুপারিশ :খাদ্য নিরাপত্তায় প্রযুক্তি সহায়তা, শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করার মাধ্যমে রফতানি প্রতিবন্ধকতা দূর করা, জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কৃষি উৎপাদনসহ অর্থনীতির সব বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা, অবকাঠামো সংকট দূর করে আঞ্চলিক পরিবহন যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, জ্বালানি সমস্যা সমাধানে প্রতিষ্ঠানিক সমাধান খোঁজা, পানিসম্পদের ন্যায্য সমাধান, রাজনীবিদদের মানসিকতার পরিবর্তন, আঞ্চলিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের ভূমিকা বৃদ্ধি, অভিবাসন, প্রযুক্তি সহায়তা, সার্ক ও সাফটাকে কার্যকর করা ইত্যাদি।
পানি ও বিদ্যুতের সমাধান না হওয়া রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব : সম্মেলনের সকালের অধিবেশন প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বলেছেন, সার্ক অঞ্চলের নেতাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়নি। আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারিত না হওয়ার জন্য তিনি আমলাতন্ত্রকেও দায়ী করেন। ফারুক খান বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অন্তত ১ লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশে খরা মৌসুমে পানি সংকট এবং বর্ষায় বন্যার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেন তিনি। তবে সম্প্রতি রাজনীতিবিদদের মধ্যে সদিচ্ছা বেড়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সকালের অধিবেশনে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শ্রীলংকার ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিসের নির্বাহী পরিচালক ড. শ্যামা কেলিগামা, ভারতের এনসিএইআরের মহাপরিচালক ড. শেখর শাহা, ভুটানের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী লিউনোপো ওম প্রধান, পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা ড. ভাকুর আহম্মেদ, নেপালের সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. রাম শাহারান, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শ্যাম বাতিজা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক মনোযোগ যথেষ্ট নয়। জিডিপির কাঙ্ক্ষিত হার বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া, জ্বালানি সহযোগিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সহযোগিতা বৃদ্ধি, নিজেদের মধ্যে অভিবাসন সহজ করা ও ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা।

No comments

Powered by Blogger.