ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বাড়ছে -* মূল্যস্ফীতি বাড়া ও বেসরকারি খাতে ঋণ কমার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের * ঋণ নিয়ে ভর্তুকি না দিলেই বরং মূল্যস্ফীতি-আরো বাড়ত : কেন্দ্রীয় ব্যাংক

লতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রত্যাশিত বৈদেশিক ঋণ না পাওয়া এবং ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে প্রাপ্তি কম হওয়ায় ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ বেড়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বেগের কিছু না দেখলেও বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি মাত্রায় ঋণ নেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে অর্থায়ন বিঘি্নত হবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়বে। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ বাড়ালে উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন তাঁরা।


বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে আট হাজার ১৩০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এক হাজার আট কোটি ৮২ লাখ টাকা বেশি।
ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, সরকারি খাতে ঋণের ব্যবহার মানের দিক থেকে সব সময়ই বেসরকারি খাতে অর্থের ব্যবহারের চেয়ে খারাপ। তাই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে তা স্বাভাবিকভাবেই চিন্তার বিষয়। ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত বঞ্চিত হবে। আর মূল্যস্ফীতির চাপও বাড়বে। ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাংক ঋণের ওপর বেশি ভর না করে সরকারকে কর আয় বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, সরকার ঋণ নিয়ে কী খাতে খরচ করছে, সেটিই বড় প্রশ্ন। ঋণের টাকা যদি ভর্তুকি ও বেতন ভাতা বাবদ খরচ হয়, তাহলে তো অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না। বাজেট ঘাটতি বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়ে গেলে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ কমবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণ নেবে। বৈদেশিক উৎস থেকে ১৫ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা আশা করা হয়েছিল। বছর শেষে দেখা গেছে, বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়া গেছে ১০ হাজার সাত কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হয়েছিল গত অর্থবছর। আর চলতি অর্থবছরে ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ব্যাংক থেকে সরকারের ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকেই সরকার নিয়েছে ৮ হাজার ১৩০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
অবশ্য এ নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ব্যাংক থেকে সরকারের এ পর্যন্ত গৃহীত ঋণের পরিমাণ বাজেটে প্রক্ষেপিত মাত্রার অর্ধেকও নয় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঠিক তালেই চলছে ব্যাংকিং খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতি। এমনকি রিজার্ভ মুদ্রা, অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং ব্যাপক অর্থ সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মুদ্রানীতির ভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই।
ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বলেও মনে করে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা মনে করে, সরকারি খাতে ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ভর্তুকি হিসেবে ব্যবহার হয়ে মূল্যস্ফীতি প্রশমিত রাখে। ঋণ কম নিয়ে সরকার যদি ভর্তুকি কমিয়ে দেয়, তাহলেই বরং মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা ২০০৮ সালের সর্বোচ্চ পর্যায়কেও ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা, 'মূল্যস্ফীতি এখন কিছুটা উচ্চমাত্রায় থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রধান আমদানি পণ্যগুলোর মূল্য স্থিতিশীল বা নিম্নগামী থাকার অনুকূল প্রভাব স্থানীয় বাজারে সামনের মাসগুলোয় পড়বে। তবে ভোক্তাপর্যায়ে জ্বালানির মূল্য সরকার আবার বাড়ালে এর প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়বে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো মনে করে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রাপ্তি বিঘি্নত হওয়ার মতো অবস্থা বাংলাদেশে এখনো হয়নি। কারণ বর্তমানে সরকারি খাতের ৭৯ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা ঋণস্থিতি থেকে সরকার ব্যাংকব্যবস্থায় ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আমানত রেখেছে, যা অন্যান্য আমানতের মতো সরকারি, বেসরকারি উভয় খাতে ঋণ জোগানের জন্য ব্যাংকগুলো ব্যবহার করছে।
এ ছাড়া ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যক্তিখাতে ঋণের স্থিতি গত বছরের আগস্ট মাসের দুই লাখ ৮০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে চলতি বছরের আগস্ট মাসে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৫৬১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। রেপোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ অর্থের তেমন চাহিদা না থাকায় মুদ্রাবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অংশগ্রহণ কমে গেছে। রেপো আকারে মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য জোগানের মাত্রা ১১ অক্টোবর ছিল পাঁচ হাজার ২২২ কোটি টাকা, যা ৩০ জুন দেওয়া আট হাজার ২৪২ কোটি টাকার চেয়ে অনেক কম। এ ছাড়া শিল্প খাতে প্রকল্প বিনিয়োগের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে বৈদেশিক অর্থায়নের ব্যবহার এখন উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফলে দেশি ব্যাংকের ওপর চাপ কমবে এবং টাকার মূল্যমানের ওপর আমদানি দায়জনিত চাপ আগের চেয়ে কমে আসবে।
টাকার মূল্যমান হ্রাসের পক্ষেও যুক্তি রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। টাকা কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত রাখার প্রয়াস রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের অন্তঃপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বিঘি্নত করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারণা। সময়ে সময়ে বড় বড় অঙ্কের আমদানি দায় পরিশোধের চাপ বিনিময় হারে সৃষ্টি করে। রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি থাকায় সামগ্রিকভাবে এ চাপ উদ্বেগজনক পর্যায়ে দাঁড়াবে না। মুদ্রাবাজারে তারল্য দৃঢ় নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্যমান অবচিতি পরিমিত রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.