কুষ্টিয়ায় দুই যুবক নিহতঃ অন্য দুজনকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়া হয়

র‌্যাবের গুলিতে নিহত দুই যুবকের সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন। তাঁরা বেঁচে আছেন। চোখবাঁধা অবস্থায় টানা ৩৬ ঘণ্টা তাঁদের অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখা হয়। গতকাল সোমবার ভোরে মাইক্রোবাসে করে তাঁদের মাগুরা জেলার ঢাকা সড়কের পাশে রামনগর এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়। বেঁচে আসা দুজনের নাম হাবিবুর রহমান ও হান্নান বিশ্বাস। গতকাল প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, সোমবার ভোরে তাঁদের ফেলে যাওয়ার পর তাঁরা নিজের চেষ্টায় হাতের বাঁধন খুলে ফেলেন। এরপর রামনগর বাজারের লোকজনের সহায়তায় বাড়িতে ফেরেন।

বিকেলে তাঁরা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। হাবিবের দুই পায়ের তালুতে ও হান্নানের ডান হাতে আঘাত করা হয়েছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া হাবিব হাঁটতে পারছেন না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের গুলিতে নিহত জিয়াউর রহমানের স্ত্রীর ভাই হলেন হাবিবুর রহমান। হাবিব ও হান্নান দুজনেরই বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। হাবিব কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও কলেজের শিক্ষানবিশ রোভার স্কাউট। হান্নান বাড়িতে কৃষিকাজ করেন।
এদিকে গত রোববার রাতে নিহত জিয়াউর রহমান ও তাঁর বন্ধু আবদুস সালামকে কুষ্টিয়া চৌড়হাস কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়। শনিবার রাতে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের স্বস্তিপুর এলাকায় তাঁরা র‌্যাবের গুলিতে নিহত হন।
র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, তাঁরা ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। তাঁরা একটি সিএনজি (অটোরিকশা) ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ২৩ অক্টোবর রাতে র‌্যাবের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে দুজন নিহত হন।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাব বাদী হয়ে রোববার রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধা ও অস্ত্র উদ্ধারের কথা উল্লেখ করে একটি মামলা করেছে। উদ্ধার করা সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি (গাজীপুর থ-১১-০২৩৪) থানায় রয়েছে।
অবশ্য এই অটোরিকশার মালিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার বিকেলে তিনি বোয়ালিয়া বাজারের কাছে কালী নদীর সেতুর ওপর বসে ছিলেন। মুঠোফোনে তাঁর মা জানান, “জিয়া (ভগ্নিপতি) শেখপাড়া বাজারে আছে, তুই দেখা কর।” এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি শেখপাড়া বাজারে যান। সেখানে ভগ্নিপতির সঙ্গে দেখা করে আবদুস সালামকে নিয়ে বোয়ালিয়ায় ফিরে আসেন। এ সময় জিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন।
হাবিবুর রহমান বলেন, মাগরিবের পর জিয়া মোটরসাইকেলে করে শেখপাড়া বাজারের দিকে চলে যান। বাকি তিনজন মিলে অটোরিকশা নিয়ে শেখপাড়া বাজারের কাছাকাছি মণ্ডলপাড়ার মধ্যে এলে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই দুটি মোটরসাইকেল এসে অটোরিকশার পেছনে ও সামনে দাঁড়ায়। তাঁরা নিজেদের ‘ডিফেন্স’-এর লোক পরিচয় দিয়ে সালামকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যান। এ সময় ওই স্থানে কয়েকজন জড়ো হলে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়। আধা ঘণ্টার মধ্যে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস সেখানে আসে। মাইক্রোবাসের আরোহীরা তাঁকে ও হান্নানকে চোখ-মুখ ও হাত বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এ সময় আবদুল্লাহ আল মামুন নামের এক তরুণ সেখানে ছিলেন বলে তিনি জানান।
হান্নান বিশ্বাস বলেন, ‘শনিবার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত সারাক্ষণ চোখ-মুখ, পা-হাত বাঁধা ছিল। শুধু খাওয়ার সময় মুখ খুলে দিত। মেঝেতে শুয়ে থাকতাম। তারা বলত, “খা আর আল্লাহ আল্লাহ কর।” সোমবার প্রায় তিন ঘণ্টা গাড়িতে করে ঘোরানো হয়। রাতে কোনো একসময় মাঠের মধ্যে ফেলে তারা চলে যায়।’
মণ্ডলপাড়ার তরুণ আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাস্তায় একটি অটো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কারণ জানতে চাই। এ সময় একজন আমাকে বলেন, “কিছু হয়নি, এখান থেকে চলে যাও।” একপর্যায়ে শার্ট-প্যান্ট পরা এক লোক গায়ে কালো কোট পরেন। কোটে “র‌্যাব” লেখা ছিল। এরপর গাড়ির মধ্যে তিনজনকে দেখিয়ে তাঁরা জানতে চান এদের চিনি কি না।’
বোয়ালিয়া বাজারের কয়েকজন দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সন্ধ্যার পরপরই সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ব্রিজের কাছে জিয়াসহ কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। সিএনজিটি চালু না হওয়ার কারণে বেশ কয়েকজন মিলে একে ধাক্কা দেয়।
হাবিবুরের চাচা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শেখপাড়া বাজার থেকে ফেরার পথে ভাবি (হাবিবুরের মা) ফোন করে জানান, হাবিবুর অটো নিয়ে শেখপাড়ার দিকে গেছে। বাড়ি ফেরার পথেই মণ্ডলপাড়ায় দেখা হয়। অটোর সামনে ও পেছনে দুটি মোটরসাইকেল দাঁড়ানো ছিল। থামামাত্রই সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তাঁদের একজনের পরনে র‌্যাব লেখা কোট ছিল। ভয়ে আমি চলে আসি।’
নিহত জিয়ার ছোট ভাই মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ভাই লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করতে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেল। বাবার যা সম্বল ছিল, সবই চলে গেছে। এখন কার কাছে বিচার চাইব! আইনগত কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে যদি আমার ও আমার পরিবারের অবস্থা বড় ভাইয়ের মতো হয়! ভয় করে, এখন আমরা নিরুপায়!’
এ ব্যাপারে জানতে প্রথম আলো থেকে কুষ্টিয়া র‌্যাব ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ আল মেহেদীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

No comments

Powered by Blogger.