২০- প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে উচ্চ আদালতের মান আবার যাওয়ার কথা

‘কোল্ড হার্ট’ তত্ত্ব
...প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক জজদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে নতুন এক তত্ত্ব হাজির করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি সুযোগ পেলেই বলে থাকেন বিচারকদের নাকি ‘কোল্ড হার্ট’ নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হয়। এই তত্ত্বের উত্পত্তি আমার মতো যত্সামান্য লেখাপড়া জানা মানুষের জানার কথা নয়।...

সারাটা দিন আকাশ মুখ গোমরা করে থাকার পর সন্ধ্যার খানিক আগে অস্তগামী সূর্য মেঘের চাদর সরিয়ে দেখা দিয়েই হারিয়ে গেল। প্রকৃতি মানুষের মনের ওপর কত সহজেই না ছায়া ফেলে! আমারও তাই আলস্যেই দিন কাটলো। সমস্ত দিন পড়ার টেবিলের ধারে-কাছেও যাইনি, দুপুরে খেতে বসেও উঠে পড়লাম। কালাম শশব্যস্ত হয়ে রান্না খারাপ হয়েছে কি-না জানতে চাইলে কথা না বাড়িয়ে এক কাপ চা দিতে বলে বারান্দায় গিয়ে গম্ভীর মুখে চুপচাপ বসে পড়লাম। সন্ধ্যায় লক-আপের তালা প্রায় লাগানো হচ্ছে, এমন সময় পাশের ওয়ার্ডের হীরা পুরনো খবরের কাগজের একটা কাটিং শিকের ফাঁক গলিয়ে দিয়ে শুধু বললো, কাল কথা বলব।
সন্ধ্যার পর সেই কাটিং খুলে দেখলাম ডিসেম্বরের সাত তারিখে যুগান্তরের সম্পাদকীয় পাতায় প্রধানমন্ত্রীর যে বিশাল লেখাটি ছাপা হয়েছে, হীরা সেটাই যত্ন করে দিয়ে গেছে। ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ শিরোনামের লেখাটির আদ্যোপান্ত পড়লাম, জরুরি সরকারের আমলে তার জেলজীবন নিয়ে অনেকটা রোজনামচার ধাঁচে লিখেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। সেই লেখায় আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাতে এদেশের উচ্চ আদালতের উচ্চ মান পুনর্বার যাওয়ার কথা। শেখ হাসিনার লেখা থেকেই বরং উদ্ধৃত করি :
“এত প্রহসন, বিচারের নামে প্রহসন চলছে। বিচারকরা কি তাদের বিবেক, চিন্তা, জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বিচার করতে পারে? বিচারকরা তো সংবিধান মোতাবেক শপথ নিয়ে থাকে, সেই শপথ কি রক্ষা করতে পারে?...
হাইকোর্ট রায় দিলেই তা যদি পক্ষে যায় সুপ্রীম কোর্ট স্থগিত করে দেন। শেষ পর্যন্ত কোর্টও বদলে যায়। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে সরকারের বিশেষ দূত নিজেই নাকি আমাকে জামিন দিতে নিষেধ করেছিল। সুপ্রীম কোর্টকেই যদি নিষেধ শুনতে হয়, সর্বোচ্চ আদালত যদি স্বাধীন না হয় তা হলে নিম্ন আদালতের অবস্থা কি তা তো অনুধাবন করা যায়। মামলার রায় কি হবে তার ‘অহি নাজেল’ হয়, যা নির্দেশ দেবে তাই রায় দেবে।...”
প্রধানমন্ত্রীর লেখা পড়ে কৌতুক বোধ করা ছাড়া আদালত অবমাননা মামলায় নজিরবিহীনভাবে দণ্ডিত একজন আসামির আর কিছু করার নেই। লেখাটি আগস্ট মাসে ছাপা হলে আমার মামলার শুনানিতে লর্ডশিপদের অন্তত পড়ে শোনাতে পারতাম। ‘চেম্বার মানে সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামের সংবাদে আমার দেশ পত্রিকায় যেসব তথ্য ছাপা হয়েছিল, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দি জীবনের উপলব্ধির বিশেষ কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না। আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে ডিজিটাল সরকার বহুদিন ধরে হন্যে হয়ে ছুতো খুঁজে বেড়াচ্ছিল; সুতরাং আমার বিষয় বিবেচনার বাইরে রাখছি। এদিকে ক্রোধান্বিত লর্ডশিপদের ভাষায় আমি নিতান্ত এক ‘চান্স সম্পাদক’। কাজেই বর্তমান সরকারের আমলে প্রশাসনিক ও বিচারিক যাবতীয় নির্যাতন আমার ক্ষেত্রে জায়েজ। কিন্তু বেচারা পেশাদার সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে তো কেবল বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের অপরাধে সোয়া মাস জেল খাটতে হয়েছে। সেই বিচারের মানদণ্ডে শেখ হাসিনার উচ্চ আদালতের প্রতি চরম কটাক্ষপূর্ণ এই লেখার অপরাধে তাহলে কত বছর জেলদণ্ড হওয়া উচিত?
আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের দাবি করেছিলেন। তিনি এখন তার মনিবের বিরুদ্ধে কত বছরের সাজার দাবি করেন, সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু কথা হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? আমার বিরুদ্ধে দুই আওয়ামী আইনজীবী বাদী হয়েছিলেন। তারা কি এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই মামলা রুজু করবেন? আর দৈবাত্ মামলা যদি কোনো কাণ্ডজ্ঞানহীন, দুঃসাহসী নাগরিক করেই ফেলে, তাহলে আপিল বিভাগের লর্ডশিপরা সেই মামলা কি আমলে নেবেন? তারা তো কেবল আদালত অবমাননার ‘পাথ ফাইন্ডার’, মাহমুদুর রহমানকে সাজা দিতে চেয়েছিলেন। সেই সাজা জায়েজ করার জন্য অলিউল্লাহ নোমানকেও হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেলে পাঠাতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তো আবার ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, তাদের সবার নমস্য। তার বিরুদ্ধে সুয়োমোটো সমন পাঠানোর চিন্তা করাটাও উচ্চ আদালতের বিচারকদের পক্ষে কবিরা গুনাহ্ করার শামিল। অবশ্য এই একই কাজ বেগম খালেদা জিয়া করলে বহু আগেই মাননীয় বিচারপতিদের জাত্যভিমানে লেগে যেত। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক জজদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে নতুন এক তত্ত্ব হাজির করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি সুযোগ পেলেই বলে থাকেন বিচারকদের নাকি ‘কোল্ড হার্ট’ নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হয়। এই তত্ত্বের উত্পত্তি আমার মতো যত্সামান্য লেখাপড়া জানা মানুষের জানার কথা নয়। আইন বিষয়ে যারা প্রধান বিচারপতির মতো অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, তারা হয়তো জানতে পারেন। আমি ইংরেজি ভাষায় কোল্ড হার্টের কাছাকাছি ভাবপ্রকাশক যে কয়েকটি শব্দ জানি, তার সবগুলোই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার। কোল্ড আই, কোল্ড ফিট এগুলোও ইতিবাচক ভাবপ্রকাশে কখনও ব্যবহার হতে শুনিনি। স্বঘোষিত কোল্ড হার্টেড প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর লেখাটি পড়েছেন কি-না জানি না। বন্দি অবস্থায় তাকে আমার জানানোরও সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন বিষয়ে তার ‘অগাধ পাণ্ডিত্য’ নিয়ে যথেষ্ট বড়াই করেন বলে শুনেছি। অত বড় পণ্ডিতের বক্তব্যের মর্ম বোঝা আমার মতো ‘এই সেই’ ব্যক্তির কর্ম নয়! ‘এই সেই’ শব্দটিও আমি সুপ্রিমকোর্টের লর্ডশিপ এস কে সিনহার কাছ থেকে শিখেছি। তিনি আমাকে বেঞ্চে বসে ওই নামেই ডেকেছিলেন। বাংলাদেশের বিচারপতিদের কাছ থেকে আইন শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের এখন ইংরেজি-বাংলা ভাষারও তালিম নিতে হচ্ছে।
তারপরও আমি হতাশ নই। ইতিহাস অবশ্যই একদিন এদের সবার কার্যকলাপ পক্ষপাতহীনভাবে বিচার করবে। প্রধানমন্ত্রী ও লেখক শেখ হাসিনাকেও একটা প্রশ্ন করবার ছিল। বর্তমান অবস্থায় সেটা তো আর সম্ভব হচ্ছে না। অনন্যোপায় হয়ে প্রশ্নটি পাঠকের বরাবরেই করে রাখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যদি বিচার বিভাগের এমন নগ্ন অবিচারের শিকারই হয়ে থাকেন, তাহলে মইনউদ্দিনের মতো করেই বিচার বিভাগকে কেন ব্যবহার করছেন? আপিল বিভাগে স্থগিতাদেশ প্রথার বিরুদ্ধে যে হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব শেখ হাসিনার লেখায় ফুটে উঠেছে, তার শাসনামলে সেই আপিল বিভাগে স্থগিতাদেশের অবস্থা তো অধিকতর ন্যক্কারজনক হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের বারান্দায় হাঁটাহাঁটির সময় অনেক প্রখ্যাত আইনজীবীকে আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, একই রকম ফ্যাক্টসের ভিত্তিতে শুধু দল বিবেচনায় ভিন্ন রায় আসে কী করে? আইনের শাসনের এ কী অবস্থা হলো বাংলাদেশে!
আজ সকাল থেকেই কাশিমপুরের পক্ষীরাজ্যে তুমুল আন্দোলন চলছে। গতকালের বৈরী আবহাওয়ার রেশ সকাল পর্যন্ত কাটেনি, তার ওপর যুক্ত হয়েছে ভারী কুয়াশা। এই আবহাওয়ায় রোজকার মতো বারান্দামুখো না হয়ে ঘরেই বই মুখে বসে ছিলাম। পক্ষীকুলের কলরব যে অন্যান্য দিনের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার, সেটা ঘরে বসেই টের পাচ্ছিলাম। অন্যান্য দিন বেলা বাড়লে তাদের কিচির-মিচির কমতে থাকে, আজ উল্টো কারবার। টানা বারান্দার পুবদিক ঘেঁষে বেশ বড় একটা গাছে প্রচুর পাখির আস্তানা; টের পাচ্ছিলাম কলরবটা সেদিক থেকেই আসছে। সেবক কালাম ছুটে এসে বললো, দেখে যান স্যার, এক আজব প্রাণী। গিয়ে দেখি এক কিম্ভূতকিমাকার বিশাল পাখি ধ্যানমগ্ন হয়ে গাছের বড় ডালটিতে বসে আছে, তাকে ঘিরেই যত উত্তেজনা। প্রাণীটির গায়ের রঙ ফ্যাকাশে হলদে আর ধূসর মেশানো, বিশাল চ্যাপ্টাপানা মুখ, চোখ খোলা না বন্ধ ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। অগুনতি শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, ফিঙে এবং কয়েক জাতের অচেনা পাখি সেই ধ্যানগম্ভীর আগন্তুকের নিরাপদ দূরত্বে চঞ্চল হয়ে গাছে বসছে, মাথার ওপর চক্রাকারে উড়ছে অথবা তিনতলা সেলের বারান্দার কার্নিশের নিরাপদ আশ্রয়ে দম নিচ্ছে।
কেবল কয়েকটি গুণ্ডা কিসিমের ফিঙে মাঝে মাঝে সাহস করে তেড়ে গিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। তাদের মধ্য থেকে দুই-একজন দুঃসাহসী আকারে অন্তত তিনগুণ বৃহত্ পাখির মাথায় কয়েকটা ঠোকরও দিল। কালাম পাশ থেকে বেশ গর্বের সঙ্গেই বলে উঠলো, এগুলো পাখির রাজা ফিছকুল, কাউকে ভয় করে না। অপরিসীম ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হলুদ পাখি ফিছকুল ওরফে ফিঙের আক্রমণ উপেক্ষা করে ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল। এদিকে গাছের নিচেও কৌতূহলী বন্দিদের ভিড় বাড়ছে। সেই ভিড় থেকেই একজন ওপরে আমাকে দেখতে পেয়ে আগন্তুক পাখির নাম জানতে চাইল। আমি পক্ষীবিশারদ না হলেও আন্দাজে বললাম, হুতোম পেঁচা হবে। প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করলাম, এতটুকু নড়লো না পাখিটা। এমন ধৈর্য মানুষের থাকলে পৃথিবীতে এত অশান্তি, মারামারি, হানাহানি দেখতে হতো না।
বিষম হৈচৈয়ের মধ্যে কারারক্ষী, জমাদাররাও এসে হাজির। তাদেরই মধ্য থেকে একজন মন্তব্য করলো, অলুক্ষণে পেঁচা দেখা ভালো না। বালা-মসিবত আসে। এই কথা শুনেই দুনিয়ার সর্বরকম কুসংস্কারের ডিপো কালামের মুখ শুকিয়ে আমসি। আমি হেসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আসামিদের জীবনে বালা-মসিবত এসেছে বলেই তো আমরা জেলে; সুতরাং পেঁচা অন্যের জন্য অশুভ হলেও আমাদের জন্য নিশ্চয়ই শুভ। ধাঁধায় পড়ে কালাম আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝতে চাইল, কথাগুলো আমি মন থেকে বলছি কি-না। দুপুর পর্যন্ত এ তামাশা চলার পর কিছু অতিউত্সাহী চ্যাংড়া কিসিমের আসামি প্রথমে ঢিল ছুড়েও পেঁচার ধ্যান ভাঙতে না পেরে ধরার জন্য গাছ বেয়ে ওঠা শুরু করলো। আমার ইচ্ছা ছিল পেঁচাটাকে কাছ থেকে আরও কয়েকদিন দেখা, সেটা আর হয়ে উঠলো না। মনুষ্য প্রজাতির স্বভাবজাত এই হিংস্র, আগ্রাসী কাজকর্মে মহাবিরক্ত হলেও চুপ করেই রইলাম। জানি, আমার নিষেধের কেউ তোয়াক্কা করবে না। মানুষ এবং পাখির মিলিত আক্রমণে আর টিকতে না পেরে হুতোম পেঁচাকে শেষ পর্যন্ত অস্থায়ী আশ্রয়টুকু ত্যাগ করে অন্য আশ্রয়ের খোঁজে উড়তে হলো। তখন দেখলাম কী বিশাল পাখাবিশিষ্ট এক রাজসিক পাখি। সে সামনে আর পেছনে শালিক, বুলবুলি, ফিঙের ঝাঁক উড়ে চলেছে। ছবি তোলার শখ আমার কোনোকালেই নেই। কিন্তু আজ ক্যামেরা না থাকার জন্য সত্যিই আফসোস হচ্ছে। নিরানন্দ, একঘেয়ে জেলজীবনে খানিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে বেচারা হুতোম চলে গেল নিরুদ্দেশের পানে।

No comments

Powered by Blogger.