২৮- সাহিরর সময় কারারক্ষীর চাবির গোছার ঝনঝন শব্দে সেলের বন্ধ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াই

শাইলকের মতোই সরকার ...
কয়েক মুহূর্ত আগেই শাশুড়ি-বৌ যে সোফাটিতে বসেছিল, সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। শেক্সপীয়রের শাইলকের মতোই সরকার আমার শরীরের মাংস কেটে কেটে নিচ্ছে। ...

গ্রেফতার হওয়ার দুই মাস সাত দিনের মাথায় মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। অবশ্য ডিবি অফিস থেকে চব্বিশে জুন ভোরে উত্তরার টিএফআই সেলে নিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক মাকে দেখেছিলাম মিন্টো রোডের ফুটপাতে তজবীহ্ হাতে আরও লোকজনের সঙ্গে বসে আছেন। আমি মাকে লক্ষ্য করে হাতও নেড়েছিলাম। কিন্তু, গাড়িতে দুই দিকে দুই পুলিশ কর্মকর্তার মাঝখানে বসা আমাকে তিনি কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে পাননি। আজ জেল প্রশাসন থেকে দেখার স্লিপ হাতে পাওয়া মাত্র সাত নম্বর সেল থেকে জেলগেট পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে গেছি। সুপার অফিসের সামনে দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত সোফায় মা আর পারভীন বসে আছেন। গোয়েন্দা পরিবেষ্টিত দুই দুঃখিনী নারী কারাগারে বন্দি পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্যের দেখা পাওয়ার জন্য জেলগেটে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষমাণ। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম জানালাম। হাসি মুখেই তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কিছুটা রোগা হয়ে গেছেন। সোফায় দু’জনার মাঝখানে আমি বসলে পারভীন সোফা থেকে নেমে আমাকে সালাম করল। আমিও স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলাম, আজ ওর জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে উপহার দেয়ার মতো তেমন কিছুই আমার কাছে ছিল না। রোজার প্রথম দিনে এক শিশি আতর উপহার পেয়েছিলাম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কাছ থেকে। তিনি আছেন ডিভিশন ওয়ার্ডে। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় না থাকলেও কী মনে করে পয়লা রোজায় আমার সেবক মারফত উপহার পাঠিয়েছিলেন। পারভীনকে সেই আতরের শিশিটি দিয়ে বললাম, তোমার জন্মদিনের উপহার। প্রত্যুত্তরে এক চিলতে বিষণ্ন হাসি দিয়ে পারভীন উপহারটি গ্রহণ করল। এই পরিবেশে কষ্ট করে হাসলেও ঠিক জানি, বাসায় ফিরেই দরজা বন্ধ করে কাঁদতে বসবে। দুঃখ করে লাভ নেই। এই জেলে প্রতিটি বন্দির পরিবারকেই একই প্রকার কষ্ট সহ্য করতে হয়। উপরন্তু, বন্দি জীবনও বলতে গেলে আমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সহজেই আপস করে অনেকের মতো সপরিবারে নিরাপদে থাকতে পারতাম। যাক সেসব কথা। জায়া ও জননীর সঙ্গে কুশল বিনিময়, সংসারের টুকিটাকি কথা এবং আমার অর্ধশত মামলার আলোচনা করতেই আধ ঘণ্টার সাক্ষাত্কার সমাপ্ত হলো। কারা প্রশাসন সময় শেষের কথা মনে করিয়ে দেয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। আগের দু’বারের মতো করেই পারভীনকে বললাম, এখানে আর এসো না। চটজলদি জবাব এলো, তুমি যেখানে থাকতে পার, আমরা তোমার কুশল জানতে সেখানে আসতেও পারি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা ও স্ত্রীর চলে যাওয়া দেখলাম। অন্যদিন দেখা শেষ হওয়া মাত্র সেলের ফিরতি পথে হাঁটা ধরি। আজ কারারক্ষীদের সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছা হলো। একজন ডেপুটি জেলার বলে উঠলেন, স্যার আপনি দেখতে অবিকল আপনার মায়ের মতো। বাল্যকাল থেকে এই কথাটি শুনতে শুনতে প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছি। জীবনের অধিকাংশ সময় কঠিন সংগ্রামে অতিবাহিত করার পর আমার সত্তরোর্ধ মায়ের এবার বোধহয় একটুখানি শান্তি প্রাপ্য ছিল। সেই শান্তি আমি তাকে দিতে পারলাম না। স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তাকে এখন স্বামীর ডজন ডজন মামলার তদবিরের জন্য আইনজীবীদের চেম্বার এবং বাড়িতে দৌড়াতে হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত আগেই শাশুড়ি-বৌ যে সোফাটিতে বসেছিলেন, সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। শেক্সপীয়রের শাইলকের মতোই সরকার আমার শরীরের মাংস কেটে কেটে নিচ্ছে। আমার এই অসম লড়াইকে সাত নম্বর সেলের ফয়সাল নির্বুদ্ধিতা বলে ভর্ত্সনা করে। অনুযোগ করে বলে, আমি নাকি মা এবং স্ত্রীর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছি না। তার ধারণা ভবিষ্যতে দেশের জনগণ অবিমৃষ্যকারিতার জন্য আমাকে গল্পের ‘ডন কুইক্সোট’ আখ্যা দিয়ে পরিহাস করবে। রূপক গল্পের এই বোকা নায়কটি তার ততোধিক বোকা সঙ্গীকে নিয়ে পুরনো দিনের নাইটদের মতো একটা হাড় জিরজিরে ঘোড়ায় চেপে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে ঘর ছেড়েছিল। আমিও হয়তো তাই। কিন্তু পৃষ্ঠপ্রদর্শন করব না কখনও। নিরুদ্বিগ্ন জীবনে প্রত্যাবর্তনের সেতু নিজ হাতে পুড়িয়ে দিয়ে তবেই আমি জেল জীবন বেছে নিয়েছি।
সেলে ফিরে ফয়সালের সঙ্গে গল্প করে মনটা খানিকটা হালকা করার চেষ্টা করছি, এমন সময় অলিউল্লাহ নোমান দেখা করতে এলো।
জেলগেটে নোমানের আত্মসমর্পণের পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার সুযোগ পায়নি। আমার সহকর্মী তরুণটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, জেলে কষ্ট হচ্ছে কিনা জানতে চাইলাম। মিতবাক নোমান হাসিমুখেই বলল, সে ভালো আছে। দশ নম্বর সেলের অন্য বন্দিরা তাকে সাংবাদিক হিসেবে যথেষ্ট সম্মান দিচ্ছে। জেলগেটে ওর আত্মসমর্পণের গল্প শুনলাম। রাজবন্দিরা সাধারণত মুক্তি পাওয়ার পর ফুলেল শুভেচ্ছা পেয়ে থাকে। নোমান ভাগ্যবান। আতাউস সামাদ, ফরহাদ মজহারের মতো বরেণ্য ব্যক্তিবর্গসহ তিন-চারশ’ সাংবাদিক রীতিমত পুষ্পবৃষ্টি করে তাকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। আমি ভেবেছিলাম, অলিউল্লাহ নোমানকে ম্রিয়মাণ দেখব। সাহসী সাংবাদিককে জেলে এসেও যথেষ্ট উজ্জীবিতই মনে হলো। সেপ্টেম্বরের তিরিশ তারিখ ওর সাজার মেয়াদ শেষ হবে, অর্থাত্ আমাদের উভয়েরই রমজানের ঈদ জেলেই কাটবে। জেলবাসের ক’দিনে যথাসম্ভব লেখার রসদ জোগাড় করার পরামর্শ দিলাম। বেশিক্ষণ গল্প করা গেল না। বৈরী সরকারের প্রশাসন টের পেলে শাস্তি হিসেবে যে কোনো একজনকে চালানে দূরের কোনো কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। ঈদের দিন সুযোগ পেলে আবারও দেখা করতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে নোমানকে বিদায় দিলাম। আজকের শুক্রবারটা আনন্দ-বেদনা, সুখে-দুঃখে একেবারে মন্দ কাটল না।
জেলে রোজা রাখতে পারব কিনা, এ নিয়ে প্রথমদিকে সংশয় থাকলেও আল্লাহর রহমতে বিশেষ কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তবে ঘুমের সময়টা একেবারেই পাল্টে গেছে। ন’টায় ঘুমিয়ে রাত দেড়টার মধ্যে নিয়মিত ঘুম ভেঙে যায়। ডিভিশন ওয়ার্ডের মেট আলমগীর সঙ্গে তিন-চারজন কারারক্ষী নিয়ে রাত দুটোর দিকে সাহির নিয়ে এলে প্রতি রাতেই জেগে আছি দেখতে পায়। আমার সেলের দিকে আগুয়ান কারারক্ষীর হাতের চাবির গোছার ঝনঝন শব্দ শুনলেই বিছানা ছেড়ে সেলের বন্ধ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। বয়স আর পরিস্থিতি মানুষকে কত পাল্টে দেয়। পঞ্চাশে পা দেয়া পর্যন্ত আমার গভীর ঘুম গৃহে হাসি-ঠাট্টার বিষয় ছিল। বুয়েটে যখন পড়ি, তখন তো দিনে-দুপুরে একবার এমন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যে আমাকে জাগাতে না পেরে দরজাই ভাঙতে হয়েছিল। অথচ এখন? আলমগীর বিস্ময়ের সঙ্গে প্রায়ই বলে, স্যার একবারের জন্যও আপনাকে ডেকে তুলতে হলো না। কারা রক্ষীদের বোধহয় ধারণা, দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। আমি কোনো কথা না বলে কেবল হেসে ওদের সঙ্গে তাল মেলাই। আজ ঘুম ভেঙে গেল রাত একটায়। স্বপ্ন দেখছিলাম কৈশোরে ফিরে গেছি। ছেলেবেলার সাথীদের সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছি গেণ্ডারিয়ার চেনা রাস্তায়। সেখানকার স্কুলের, আমাদের ছোট্ট বাসাটার কত স্মৃতি মনের গভীরে লুকিয়ে আছে। পারভীনকেও যেন দেখলাম ছায়ার মতো দূরে সরে যাচ্ছে। কাকতালীয়ভাবে আমার স্ত্রীর জন্মও গেণ্ডারিয়াতেই, তবে নয় বছরের ব্যবধানে। অবশ্য সেখানে আমাদের দেখা হয়নি। আজ রাতের নস্টালজিক স্বপ্ন মা এবং পারভীনের গতদিনের জেলগেটে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসারই প্রতিক্রিয়া। অন্য বন্দিদের ক্ষেত্রে কী হয়, জানি না। তবে সংসারের মানুষগুলো এখানে দেখা করতে এলেই আমার কঠিন জেল জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা এলোমেলো হয়ে যায়। তাদের এখানে আসতে এত যে নিষেধ করি, তার পেছনে এটাও হয়তো একটা কারণ। সরকারপ্রধান আমাকে যতদিন সম্ভব জেলে আটকে যে রাখতে চান, এ নিয়ে জনমনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। কোন পন্থায় আমাকে রাখা হবে, সে নিয়ে সরকারের একটা সমস্যা ছিল। আপিল বিভাগের সাম্প্রতিক রায় আমাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেই মুশকিল অনেকটাই আসান করে দিয়েছে। অন্তত আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকার নিশ্চিত হতে পেরেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক ইন্দো-মার্কিন মোর্চার চোখের বালির তালিকায় আমার নাম শীর্ষস্থানে থাকার কথা। সুতরাং গ্রেফতার থেকেই আমাকে শায়েস্তা করার সব সরকারি বন্দোবস্ত তাদের কাছ থেকেও শতভাগ সমর্থন লাভ করছে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে মা এবং স্ত্রীকে মন শক্ত করে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে বলেছি। আশা করি, মহান আল্লাহ্তায়ালা তাদের ফ্যাসিবাদের সর্বপ্রকার অত্যাচার, নির্যাতন, হয়রানি সহ্য করে সংসার সমুদ্রে কিস্তি ভাসিয়ে রাখার তৌফিক দেবেন। বাড়ির কথা বাদ দিয়ে রমজান মাসের দিনযাপনের গল্পে এবার ফিরে যাই।

No comments

Powered by Blogger.