৩৭- তিনদিন পার হলেও জেল থেকে উধাও আসামির হদিস বের করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ

ন্দিদের টাকায়ই তথাকথিত উন্নত খাবার
প্রতি সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঈদে বন্দিদের উন্নত খাবার সরবরাহের কথা বুক ফুলিয়ে প্রচার করা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বন্দিদের অন্যান্য দিনের বরাদ্দের টাকা কেটে নিয়ে সেই অর্থ দিয়েই জেল কর্তৃপক্ষ এই তথাকথিত উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করে। ব্যাপারটা কইয়ের তেলে কই ভাজা আর কি।....

সাত নম্বর সেলের লোকসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। আজ ছয় নম্বর ঘরের অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত এক তরুণের জামিন হয়ে গেল। আমার এই সাড়ে তিন মাসের জেল জীবনে পাঁচ জনকে এভাবে জামিনে মুক্তি পেতে দেখলাম। প্রত্যেকের কাছ থেকেই অভিন্ন জামিন বাণিজ্যের গল্প শুনেছি, টাকার অঙ্কে অবশ্য ফারাক রয়েছে। সরকারের পর সরকার এলেও বাংলাদেশের প্রশাসন একই প্রক্রিয়াতেই চলছে। সাত নম্বর সেলে এখন আমরা আটজন আছি। ভিড় কমে যাওয়াতে পরিবেশটা আমার কাছে তুলনামূলকভাবে বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। বাইরে থেকে আমাকে কী মনে হয় জানি না, তবে প্রকৃতিগতভাবে আমি আজন্ম নির্জনতাপ্রিয়। পুরো সেলে একা থাকতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম। যদিও জানি এটা কেবল কল্পনাই।
আজ সকালে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একজন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে প্রশাসনে নালিশ জানাতে হলো। আগেই লিখেছি, সেলের ভেতরের একমাত্র চৌবাচ্চা আমাদের সবার পানির প্রয়োজন মেটায়। সাধারণত, রাতে পাইপে আসা পানি দিনভর ব্যবহারের জন্য সেখানে ধরে রাখা হয়। আমি ছাড়া সেলের বন্দিরা চৌবাচ্চার পানি কাপড়ে ছেঁকে পানও করে। স্বাস্থ্যগত কারণে বোতলের পানির বিলাসিতা এখনও ধরে রেখেছি। ফজরের নামাজঅন্তে সেলের দরজার কাছে বসে আছি, তখনও দিনের আলো পুরোপুরি ফোটেনি। মোটা শিকের দরজার তালা বন্ধ। আমি বাইরেটা পরিষ্কার দেখতে পেলেও, সম্ভবত: আমাকে বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না। কারারক্ষীটিকে দেখলাম, বাসি মুখ ধুয়ে সেই পানি আবার চৌবাচ্চার মধ্যেই ফেলছে। সারা শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। ওই পানি দিয়ে খানিক বাদে গোসল করব, অন্য বন্দিরা ওটাই পান করবে। কারারক্ষীটি ভাবতেই পারেনি, এত ভোরে লক-আপের মধ্য থেকে কেউ তার কাণ্ড-কীর্তি লক্ষ্য করছে। আমি তাকে ডাকতেই আমাদের মিথ্যে বলার জাতীয় চরিত্র অনুযায়ী সব ঘটনা অস্বীকারের চেষ্টা করল। তারপর অবশ্য ক্ষমা চাওয়া, কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট না করার অনুরোধ ইত্যাদি। একশ’ দিনেরও বেশি সময় এখানে কাটিয়ে কেমন করে এখনও যে সুস্থ আছি, সেটাই পরমাশ্চর্য।
দুপুরে খবরের কাগজের পাতা উল্টানোর সময় বিশ্ব ব্যাংকের এক সংবাদে চোখ আটকে গেল। আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানটি আগামী চার বছরে বাংলাদেশের জন্য ৬.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণসীমার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবার বিশ্বব্যাংক কঠোর নজরদারিরও আগাম সতর্কতা উচ্চারণ করেছে। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে এদেশে সুশাসন এবং দুর্নীতি বিষয়ে সেমিনারজীবীদের প্রাত্যহিক তত্পরতা চোখে পড়ার মতো ছিল। এক এগারোর পর থেকে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজের কাছ থেকে এই দুই বিষয়ে আর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছিল না। পরিবর্তনটি লক্ষ্য করে মাস ছয়েক আগে ‘মার্কিন এজেন্ডায় আর সুশাসন নেই’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদনও লিখেছিলাম। কয়েক বছর বিরতির পর বিশ্বব্যাংকের দর্শনে সুশাসনের প্রত্যাবর্তন আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বোধ হচ্ছে। বিগত পৌনে দুই বছরে ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনের ছদ্মাবরণে বাংলাদেশে যেভাবে সরাসরি ইসলাম বিরোধী তত্পরতা চালানো হয়েছে এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ অন্তত মুসলিম বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে গণতন্ত্রের লেবাসে নিয়ন্ত্রণহীন যে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল বাকশাল শাসনামলেরই তুলনা সম্ভব। সকল উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত মি. স্টিফেন ফ্রয়েন অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির (!) সার্টিফিকেটও নাকি দিয়ে এসেছেন। এক এগারোর বিদেশি কুশীলবদের অন্যতম এই ব্যক্তির আগের মানবাধিকার সম্পর্কিত বক্তব্য স্মরণ করলে আমাদের সুশীল (?) সমাজের সদস্যরাও হয়তো বিব্রতবোধ করতে পারেন। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিজ এলেন গোল্ডস্টাইনের কণ্ঠে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকার তাগিদ জেলের মধ্যে বসবাস করলেও আমার কাছে অর্থবহ মনে হচ্ছে। সরকার এই হুঁশিয়ারি হাল্কাভাবে গ্রহণ না করলে আখেরে তাদেরই লাভ হবে। মহাজোটের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত অবশ্য তার নিজস্ব স্টাইলে সুশাসন ও দুর্নীতির বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়ে বিপুল অঙ্কের ডলার প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথাই গুরুত্বসহকারে বলেছেন। যথেষ্ট কৌতূহল নিয়েই সরকারের আগামী বছরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ভোর থেকেই জেলখানায় হৈচৈ চলছে। কাল সন্ধ্যা থেকেই জেলখানায় নাকি গুনতি মিলছে না, একজন বন্দি নিখোঁজ। অন্যান্য দিনের মতোই সকাল থেকে গোসলের পাট সাঙ্গ করে বসে আছি, অথচ আমাদের সেবক বাহিনীর দেখা নেই। জামান এবং আকাশ সাত নম্বর সেলের এজমালি সেবক, যার অর্থ তারা এখানকার আট বন্দিরই ফাই-ফরমাশ খাটবে। আর কাগজপত্রে সালাহউদ্দিনের দায়িত্ব কেবল আমার দেখাশোনা করা। মাদক মামলার তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিনের বয়স চল্লিশের কোঠায়। সর্বদা হাসিমুখ, চটপটে প্রকৃতির সালাহউদ্দিন তিন বেলা ছাব্বিশ নম্বর সেল থেকে আমার খাওয়া এনে দেয় এবং প্রতিদিন সকালে দশ বাই সাতের সেলটি পরিষ্কার করে। সব মিলে আমার পেছনে ওর ঘণ্টা দুয়েকের শ্রম ব্যয় হয়। বাকি সময়টা অন্য বন্দিদের কাজও বিনা আপত্তিতে করে দেয়। আটটা বেজে গেল, আজ তিন সেবকের কারও দেখা নেই। এদিকে, আমার ঘর ছাড়া আর কোনোটির তালা খোলা হয়নি। ফয়সাল আমার মতোই সকালে ওঠে। সে বেচারা তালা খোলার অপেক্ষায় আছে। শেষ পর্যন্ত একজন কারারক্ষীকে ডেকে আনলে সে-ই বন্দি হারানোর দুঃসংবাদ দিল। জেল কর্তৃপক্ষের কাছে এর চেয়ে ভীতিকর খবর আর নেই। উপরআলারা নির্দেশ দিয়েছেন, যতক্ষণ গুনতি না মিলছে সেলের তালা খোলা হবে না। গত রাত থেকে যে গোনাগুনি শুরু হয়েছে, তার সমাপ্তি কখন ঘটবে কেউ বলতে পারছে না। সকাল দশটায় ছাব্বিশ নম্বর সেল থেকে আমার নাস্তা এলেও অন্য বন্দিরা তখন পর্যন্ত খাওয়া দূরের কথা, টয়লেটে পর্যন্ত যেতে পারেনি। বেচারাদের কষ্ট দেখে অস্বস্তি বোধ করলেও আমি নিরুপায়। বার বার কর্তৃপক্ষের কাছে খবর পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত দুপুর বারোটায় অন্যান্য সেলের দরজা খোলার জন্য চাবির গোছা নিয়ে জমাদার এলো। বলা হলো, কর্তৃপক্ষ মাত্র দু’ঘণ্টা সময় দিয়েছে গোসলসহ আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে সবাইকে খোঁয়াড়ে ঢুকে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় আমি যখন নিজের খোঁয়াড়ে ঢুকলাম, তখন পর্যন্ত হারানো বন্দির কোনো হদিস মেলেনি। ফয়সালের কাছ থেকে এরই মধ্যে শুনলাম, এ রকম হারানোর ঘটনা আগেও ঘটেছে। একবার এক বন্দি দু’দিন ধরে ছাদে পানির ট্যাংকির ভেতরে লুকিয়ে ছিল এবং অন্য একজন বিশাল ড্রেনের ময়লা পানির মধ্যে নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল। দু’বারই ধরা পড়ে তাদের ডাণ্ডাবেড়িসহ অতিরিক্ত সাজা খাটতে হয়েছে। কোনো বন্দির পক্ষেই জেলখানার ভেতরে দু’দিনের বেশি পালিয়ে থাকা সম্ভব নয়। ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার কাছে পরাজিত হয়ে এক সময় ধরা দিতেই হয়। আরেকটি সম্ভাবনার কথাও ফয়সাল বলল। আদালতে হাজিরার জন্য পাঠানোর পর কোর্ট গারদের পুলিশ এবং জেলের কারারক্ষীদের যোগসাজশে সেখান থেকে পালানো সম্ভব। এবার এরকমটি হয়ে থাকলে পরবর্তী সময়ে কাগজপত্রে কিছু একটা গোঁজামিল দিয়ে গুনতি মেলানো হবে। হয় পুরনো তারিখে জামিন দেখানো হবে কিংবা হিসেবে ভুল ছিল বলে কাগজপত্র ঠিক করা হবে। এবারের বন্দি হারানোর নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াটি বুঝতে হয়তো আরও কয়েকটা দিন লেগে যাবে।
তিনদিন পার হয়ে গেলেও জেল থেকে উধাও হয়ে যাওয়া আসামির কোনো হদিসই কর্তৃপক্ষ বের করতে পারেনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে পালিয়েছে তার নাম-ধাম পর্যন্ত এখনও অজানা। এই বিস্ময়কর ব্যাপারটি কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। একজন বন্দি জেলে ঢুকলে কত জায়গায় তার নাম-ধাম লেখা হয়। প্রতিটি বন্দির ছবি তোলা বাধ্যতামূলক। আমারই তো একবার হাজতি এবং পরবর্তী সময়ে কয়েদি হিসেবে দু’বার ছবি তুলতে হয়েছে। তিনদিন ধরে ওয়ার্ডে, ওয়ার্ডে গুনতি চললেও এই গায়েব হয়ে যাওয়া বন্দির নাম-ঠিকানা, কয়েদি কিংবা হাজতি কোনো তালিকা থেকেই উদ্ধার করা যায়নি। আমরা যে পিসি থেকে কেনাকাটা করি, সেখানেও তার নাকি কোনো হদিস নেই। মনে হচ্ছে, যেন এই একজন নাম না জানা ব্যক্তি ঢাকা জেলে কোনোদিন প্রবেশই করেনি। ভুতুড়ে ব্যাপার একেবারে। সুপার, জেলার কেমন করে এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন, তা তারাই জানেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্য জেলারের। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তার মুন্সীগঞ্জে বদলির আদেশ এলেও তিনি ব্যক্তিগত কারণে ঈদ শেষ করেই ঢাকা জেল থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন। বদলির আদেশ আসামাত্র সেটা পালন করলে আজ আর তাকে এই উটকো ঝামেলায় পড়তে হতো না। ফয়সালের ধারণা, এবারের ঈদুল ফিতরে বন্দিদের স্মরণাতীতকালের নিকৃষ্ট খাবার পরিবেশনের অপরাধেই আল্লাহর তরফ থেকে এই গজব নাজেল হয়েছে। আগে কখনও জেলের improved diet চেখে দেখার ‘সৌভাগ্য’ হয়নি বিধায় বলতে পারব না এবারের খাওয়া কতটা নিম্নমানের ছিল। তবে ঈদের সকালে পায়েসের নামে যা সরবরাহ করা হয়েছিল, সেটা খাওয়ার পর অন্যকিছু মুখে তোলার ইচ্ছে হয়নি। অথচ এই ঈদের খাবারের অর্থ জোগাড় করতে বন্দিদের জন্য প্রতিদিনের বরাদ্দ ৩০ গ্রাম মাছের অন্তত ১০ দিনের বাজেট কেটে নেয়া হয়েছে। প্রতি সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঈদে বন্দিদের উন্নত খাবার সরবরাহের কথা বুক ফুলিয়ে প্রচার করা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে বন্দিদের অন্যান্য দিনের বরাদ্দের টাকা কেটে নিয়ে সেই অর্থ দিয়েই জেল কর্তৃপক্ষ এই তথাকথিত উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করে। ব্যাপারটা কই-এর তেলে কই ভাজা আর কি! আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়ে ঢাকাইয়া ফজলু মিঞা জোর দিয়েই বলল, ‘আরে না আপনারা বুঝতাছেন না, আসামিরে জেলখানার ভূতে লইয়া গ্যাছে।’ আমি হেসে বললাম, জেলে একশ’ দিন পার করে কোনো ভূতের ছায়ার দেখাও পেলাম না, আপনি ভূত দেখলেন কোথায়? দশ বছর ধরে ঢাকা জেলের বাসিন্দা ফজলু মিঞা সোত্সাহে আরম্ভ করল তার জানা লোমহর্ষক সব ভূতের গল্প।

No comments

Powered by Blogger.