২৩- সর্বস্ব নেয়ার পরও ক্ষমতাসীনদের হাহুতাশ : ভারতের কোনো ঋণই শোধ করা গেল না

ন্দিত্বের ডবল সেঞ্চুরি উদযাপন
...আজ আমার বন্দিত্বের দুইশ’ দিন অতিক্রান্ত হলো। জেল প্রশাসনের অফিসে বসে দুই কাপ চা দিয়ে পারভীনের সঙ্গে জেলজীবনের এই ডবল সেঞ্চুরি উদযাপন করলাম। আইন অনুযায়ী আমার মুক্তির নির্ধারিত দিনের আর নব্বই দিন অবশিষ্ট থাকলেও যে কোনো আকস্মিক ঘটনার জন্য পারভীনকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বললাম। বাস্তবতা মেনে নিয়ে এখন থেকেই মন শক্ত না করলে তখনকার আশাভঙ্গের বেদনা অসহনীয় বোধ হতে পারে।...

আজ বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে গণহত্যাকারী পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনার যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেদিন বাল্যবন্ধু বাবুলকে নিয়ে সাতসকালে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র আমি পায়ে হেঁটে গেণ্ডারিয়া থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হয়েছিলাম। হাটখোলায় পৌঁছে দেখি, বিজয়ী ভারতীয় সেনাদের কলাম সমবেত জনতার জয়ধ্বনির মধ্য দিয়ে সারিবদ্ধভাবে মার্চ করে সদ্য হানাদার বাহিনীমুক্ত শহরে ঢুকছে। রাস্তার দু’পাশে দণ্ডায়মান জনতার কারও কারও হাতে একটি দু’টি ফুলও দেখেছিলাম।
আজকের মতো তখন শহরে এত ফুলের দোকান ছিল না। কাউকে ফুল দিতে চাইলে হয় নিজের বাগান থেকে সংগ্রহ অথবা অন্যের বাগানের ফুল চুরি করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ভারতীয় সৈনিকদের বরণ করার জন্য যারা ফুল হাতে অপেক্ষা করছিলেন, তাদের সেই ফুল জোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। ভিড়ের মধ্য থেকে এক তরুণকে ছুটে গিয়ে একজন ভারতীয় সৈনিককে জড়িয়ে ধরতেও দেখেছিলাম। পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি এদেশের মানুষের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাস না যেতেই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সম্পদ লুণ্ঠনের অভিযোগ উঠেছিল। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল এবং মেজর জয়নুল আবেদিন এই লুণ্ঠনকর্মে বাধ সাধলে তদানীন্তন সরকার ভারতের চাপে তাদের গ্রেফতারও করেছিল।
জাসদ নেতা মেজর (অব.) জলিল মারা গেছেন আর মেজর (অব.) জয়নুল আবেদিন এখনও ঢাকা জেলের সাত নম্বর সেলে সাধারণ বন্দির জীবনযাপন করে চলেছেন। এরপর থেকে ভারতের শুধু একতরফাভাবে অন্তহীন নেয়ার পালাই চলছে। সীমান্ত বাণিজ্যের নামে চোরাচালান করে লুটেরারা সেই সময় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে, শেখ মুজিব সরকারকে ধাপ্পা দিয়ে ভারত আমাদের তিনবিঘা করিডোর না দিয়েই বেরুবাড়ী নিয়েছে, ফারাক্কাসহ অন্যান্য অভিন্ন, আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ দিয়ে আমাদের পানি নিয়ে গেছে, বাংলাদেশকে বাজার সৃষ্টি করে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিচ্ছে, বাংলাদেশের বুক চিরে করিডোর নিয়েছে, অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে নেশাদ্রব্য পাঠিয়ে তরুণ প্রজন্মের নৈতিকতা নিচ্ছে, আকাশপথে অপসংস্কৃতি পাঠিয়ে জনগণের স্বকীয়তা হরণ করেছে, সীমান্তে শত শত বাংলাদেশীর প্রাণ নিচ্ছে এবং সর্বশেষ ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে স্বাধীনতাটুকুও নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেছে।
সর্বস্ব নিয়ে যাওয়ার পরও ক্ষমতাসীনরা সারাক্ষণ হাহুতাশ করে বলছেন, ভারতের কোনো ঋণই শোধ করা গেল না। সিআইডি মিজানের আকস্মিক আগমনে চিন্তায় ছেদ ঘটলো। আমার অনির্ধারিত দেখা এসেছে। আনন্দমাখা বিস্ময় নিয়ে কে এসেছে জিজ্ঞাসা করে জানলাম জননী এবং জায়া দু’জনাই অপ্রত্যাশিতভাবে জেলগেটে অপেক্ষারত। বিজয় দিবসে এই হৃদয়কাড়া উপহারের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক ছুটে পৌঁছে গেলাম অপেক্ষার ঠিকানায়।
মা’র স্বাস্থ্য ক্ষীণতর হয়েছে। ছেলের চিন্তায় খাওয়ার পরিমাণ হয়তো আরও কমিয়েছেন। আমার মা তার আহারের স্বল্পতার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এমনিতেই বিশেষভাবে পরিচিত। এখন বোধহয় সেটাকে উপবাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। পারভীনের আগের সপ্তাহের জ্বর ও ঠাণ্ডা খানিকটা কমেছে। হঠাত্ করে আজ সকালেই মাছুম পারভীনকে সংবাদ পাঠিয়েছে দুই ঈদের মতো বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসেও পরিবারের লোকজন জেলবন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। সেই সাক্ষািটও আবার সাপ্তাহিক দেখার অতিরিক্ত।
স্ত্রীর কাছ থেকে বাইরের দুনিয়ার খোঁজ-খবর নিলাম। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন কর্মকর্তা পারভীনের সঙ্গে বাসায় সাক্ষাত্ করেছেন। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার দৈন্যদশা, ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্যাতন, আমার মুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তাসহ দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন ভদ্রলোক কথাবার্তা বলে গেছেন। হঠাত্ মনে হলো, আমাকে গ্রেফতার এবং আমার দেশ বন্ধ করার অন্যায় প্রচেষ্টা গ্রহণ করে সরকার কি আদতেই কোনোরকম লাভবান হয়েছে? আমার দেশ পত্রিকায় বন্দি মাহমুদুর রহমানের ছবি প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে। কতদিন ধরে জেল খাটছি, তার উল্লেখও ছবির মাথায় থাকছে। প্রশাসন জেলের ভেতরে আমাকে মেরেও তো ফেলতে পারছে না। বরং মুক্তি দেয়া হলে দু-চারটি পেশাদার খুনি হয়তো ভাড়া করা যেত। কিংবা চৌধুরী আলমের মতো গুম করলেও এতদিনে ল্যাঠা চুকে যেত।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বিএনপি সমর্থক নির্বাচিত কমিশনারের নাম ক’জনইবা এখন মনে করে? আমি সিন্দবাদের দৈত্যের মতো ওজনদার না হলেও কেবল বন্দিত্বের কারণে সরকারের ঘাড়ে চেপে বসে থেকে তাদের ভাবমূর্তির বারোটা বাজাচ্ছি। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা সচরাচর ভুল স্বীকার করতে চান না। নইলে, এতদিনে প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার বুদ্ধিদাতাদের ডেকে আমার দেশ চক্রান্তের ব্যর্থতার জন্য ভর্ত্সনা করতেন। আবার এমনও হতে পারে, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের মোর্চা হয়তো নীতিনির্ধারকদের ভরসা দিয়ে বলছে, কুছ পরোয়া নেই, চালিয়ে যাও দেশবাসীর ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার।
আমার উল্টো-পাল্টা চিন্তার কথা পারভীনকে বলে আর ওর উত্কণ্ঠা বাড়াতে চাইলাম না। এমনিতেই দেখলাম মুক্তি-পরবর্তী আমার সম্ভাব্য অখণ্ড অবসর নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে আছে। আমাদের সিরামিক কারখানা হস্তান্তর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে সরকার মুক্তি দিলে তখন একমাত্র আমার দেশ ছাড়া আর কিছু আমাদের হাতে থাকছে না। ছাব্বিশ বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে যাকে দিবারাত্র ব্যস্ত থাকতে দেখে অনুযোগ করেছে, অবহেলার অভিযোগ করেছে, আজ সেই ব্যক্তি কাজকর্ম ছাড়া গৃহকোণে উদাস হয়ে বসে থাকবে, এমন চিন্তা আমার স্ত্রীকে যথেষ্ট পীড়া দিচ্ছে। এই না হলে নারীচরিত্র নিয়ে এত কবিতা আর গল্প!
সরকার শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতা এবং সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করলই। দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রচার করা হলেও তিনি গত জুনের হরতালে গাড়ি পোড়ানোর উদ্ভট মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। গত সাত মাসে পুলিশের পক্ষ থেকে একটিবারের জন্যও ওই মামলায় তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়নি। একই মামলায় এর আগে বিএনপি-জামায়াতের যেসব নেতাকে গ্রেফতার করে গণরিমান্ডে নেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে কেউ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নাম বলেছেন, এমন খবর কট্টর সরকার সমর্থক পত্রিকা জনকণ্ঠ অথবা ডেইলি স্টারেও পড়িনি। অথচ বিজয় দিবসের সাধারণ ছুটির দিনে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট কী নির্বিকারভাবেই না তিন দশকের এই সংসদ সদস্যকে সেই মামলাতেই পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন! নিম্ন আদালতের এমন ‘নিরপেক্ষতা’ দেখানোর পর কার বুকের পাটা আছে যে দাবি করবে, এদেশে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়?
গ্রেফতারের একদিন পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রক্তরঞ্জিত অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়েছে। তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে আটকাবস্থায় নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। তার স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের আনন্দ-উত্সব পালন করলেন। বর্তমান সরকার যে কতটা নির্মম ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারে, তার সাক্ষী আমি নিজেই। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৯৭২ সালে জেলে বন্দি অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই তথ্য বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা। সালাহউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত বেক্সিমকোর চাকরি জীবনে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্ এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ সোহেল রহমান ও সালমান রহমান যতদূর জানি, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দূরসম্পর্কীয় ভাই। জেলখানায় বসে বার বার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে।
১৯৯৬ সালের একদিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে তখন তুমুল আন্দোলন চলছে। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং সালাহউদ্দিন ভাইয়ের এনডিপি তখন একই প্লাটফর্মে। গাড়ি ভাংচুর, বাসে আগুন দিয়ে যাত্রী হত্যা, হরতাল, অবরোধ, সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, রেললাইনের পাটাতন উত্পাটন নিত্যদিনের ঘটনা। আমি সে সময় বেক্সিমকোর শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। সেরকম উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিনে সোহেল রহমান, সালমান রহমান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দীর্ঘক্ষণ ধরে গল্প করছিলেন। আমার ভূমিকা ছিল প্রধানত শ্রোতার। আমার উপস্থিতিতেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দীর্ঘক্ষণ ধরে টেলিফোনে তত্কালীন বিরোধীদলীয় লড়াকু নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আন্দোলনের কৌশল নিয়ে কথা বললেন। সালাহউদ্দিন ভাই তার স্বভাবসুলভ হাস্যরসাত্মক, প্রাণবন্ত ভঙ্গিতেই আপা সম্বোধন করে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথাবার্তা চালালেন। দু’জনার সম্পর্কে কোনোরকম তিক্ততা সেদিন আমি অন্তত অনুভব করিনি। পুরনো সম্পর্কের সেই জোরেই হয়তো কাল আদালতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আস্থার সঙ্গে বলেছেন তার নির্যাতনের সংবাদ প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন না। সালাহউদ্দিন ভাইয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করি যাতে তার এই বিশ্বাস অপাত্রে না হয়।
সংবাদপত্র জগতে এসে দেখেছি, সমাজে অন্য রাজনীতিবিদের মতোই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরও প্রশংসা ও নিন্দা দু’টিই রয়েছে। তার রসবোধ এবং সংসদ বিষয়ক লেখাপড়ার আমি একজন ভক্ত ও গুণগ্রাহী। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বন্ধুত্বও অটুট রয়েছে। এখানে বসেই খবর পেয়েছি, আমি জেলে আসার পর তিনি বিভিন্ন স্থানে আমার মুক্তি দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন। ডিবিতে রিমান্ডের সময় আমার মা ও স্ত্রী যখন রাতের পর রাত মিন্টো রোডের ফুটপাতে অসহায়ের মতো বসে থেকেছেন, সালাহউদ্দিন ভাই সস্ত্রীক সেখানে গিয়ে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। এমনকি তার নিজদলে যারা আমাকে ভয়ানক অপছন্দ করেন এবং আমার বর্তমান দুরবস্থায় অতিশয় আনন্দিত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান অফিসে বসে প্রকাশ্যে তর্ক-বিতর্ক করেছেন তাও শুনেছি। অপরিশোধ্য সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ আমার ঝুলিতে তো রইলই। জেল থেকে জেলে ভ্রমণের মাঝে দৈবাত্ দেখা হয়ে গেলে সালাহউদ্দিন ভাইকে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাতে বিলম্ব করব না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের সবরের শক্তি দান করেন।
আজ আমার বন্দিত্বের দুইশ’ দিন অতিক্রান্ত হলো। জেল প্রশাসনের অফিসে বসে দুই কাপ চা দিয়ে পারভীনের সঙ্গে জেলজীবনের এই ডবল সেঞ্চুরি উদযাপন করলাম। আইন অনুযায়ী আমার মুক্তির নির্ধারিত দিনের আর নব্বই দিন অবশিষ্ট থাকলেও যে কোনো আকস্মিক ঘটনার জন্য পারভীনকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বললাম। বাস্তবতা মেনে নিয়ে এখন থেকেই মন শক্ত না করলে তখনকার আশাভঙ্গের বেদনা অসহনীয় বোধ হতে পারে। আমার মা এবং স্ত্রী যে আত্মমর্যাদাবোধ ও সংযমের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী সরকারের সব অবিচার, জুলুম, ইতর আচরণ সহ্য করে চলেছেন, তাতে নিভৃতচারিণী দুই নারীর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে গেছে। তারা মিডিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন, আমার মুক্তির চেষ্টায় সরকারপক্ষের প্রভাবশালীদের কাছে অনেকের মতো ধরনা দেননি, অপরিসীম বেদনা বুকে চেপে রেখে একমনে আপন কর্তব্য করে গেছেন। ভেতরে রক্তক্ষরণ হলেও তাদের অশ্রু বাইরের লোক দেখতে পায়নি। আমার ছোট ঘরের নিভৃতে শাশুড়ি-বউ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভরে কেঁদেছে। তারপর ঘর থেকেই চোখ মুছে পারভীন দৌড়েছে উকিলের চেম্বারে, সিরামিকের কারখানায় এবং ঢাকা ও কাশিমপুরের জেলগেটে। অসহায়, বৃদ্ধ মা একমাত্র পুত্রকে জেলে রেখে একাকী তার বউমার ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনেছেন। দুইশ’টি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত দুই নারীর এমনি করেই কেটেছে। এই প্রতীক্ষা নিয়েই আরও কতদিন কাটবে, সেটা সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

No comments

Powered by Blogger.