কৌতুকের ছলে, কথা যাই বলে আনিসুল হক

‘আমি আমার দাদার মতো শান্তিতে ঘুমের মধ্যে মরতে চাই। তার গাড়ির যাত্রীদের মতো চি ৎ কার চেঁচামেচি করে মরতে চাই না।’
গাড়িচালক যদি গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েন, তাহলে তাঁর মৃত্যুটা হয়তো শান্তিরই হয়, যাত্রীদের মৃত্যুটা শান্তির হয় না।
পশ্চিমে এই কৌতুকটা খুব প্রচলিত। একজন পাদরি, আরেকজন বাস ড্রাইভার। তাঁরা স্বর্গ পাবেন নাকি নরক পাবেন, এই হিসাব চলছে। পাদরিকে স্বর্গের একটা মধ্য মানের কক্ষ বরাদ্দ করা হলো। আর চালকের জন্য বরাদ্দ হলো ফার্স্ট ক্লাস কক্ষ। পাদরি বললেন, ‘আমি সারা জীবন ঈশ্বরের জন্য কাজ করলাম, কত উপদেশ দিলাম মানুষকে, আর আমার চেয়ে একজন বাসচালক স্বর্গে উচ্চ স্থান লাভ করল? তা কী করে হয়?’
উত্তর এল, ‘তুমি যখন উপদেশ দিতে, তখন শ্রোতারা প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ত। আর বাসচালক যখন বাস চালাত, তখন সবার ঘুম ছুটে যেত, সব যাত্রীই ঈশ্বরকে ডাকত।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম সম্প্রতি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এলেন। সেখানে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি তাঁকে বাংলাদেশের এক ড্রাইভারের সম্পর্কে একটা অতি আশ্চর্য তথ্য দিয়েছেন। একজন চালক গাড়ি চালাচ্ছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে, ঠিক মধ্যিখানে যে দাগটা আঁকা, তার ওপর দিয়ে। তাকে বলা হলো, তুমি তোমার লেন দিয়ে গাড়ি চালাও। বাঁ দিক দিয়ে গাড়ি না চালিয়ে রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে চালাচ্ছ কেন? ড্রাইভার বলল, দাগের ওপর দিয়া গাড়ি চালাইলে গাড়িটা সোজা চালানো যায়।
সর্বনাশ! এরা কি লেন বিভাজক দাগটাকে গাড়ি সোজা চালানোর দাগ বলে ভাবে নাকি?
এই জন্যই বলছি, আমাদের চালকদের প্রশিক্ষণ দিন। তাঁদের গাড়ি চালানোর ব্যাপারে দক্ষ হতে হবে, সব ট্রাফিক আইন জানতে ও মানতে পারতে হবে এবং তাঁদের মূল্যবোধ থাকতে হবে, তাঁরা যেন জানেন ও বোঝেন যে জীবন মূল্যবান। আর দেখতে হবে, তাঁরা যেন অতিরিক্ত পরিশ্রম না করেন, তাঁরা যেন সুস্থ থাকেন।
সেবার ঢাকা শহরে মেয়র নির্বাচন হচ্ছিল। মোহাম্মদ হানিফ আর মির্জা আব্বাস ভোটে দাঁড়িয়েছেন। মির্জা আব্বাস তখনো মেয়রের দায়িত্বই পালন করছেন। আমি একজন স্কুটারচালককে প্রশ্ন করলাম, কাকে ভোট দেবেন। তিনি বললেন, হানিফ সাহেবকে। কেন?
আর বলবেন না, আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বড় ঝামেলা করছে। হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স কিনেছি। পুলিশ বলে, লাইসেন্স দুই নম্বর।
আমি বললাম, আপনি বিআরটিএতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসল লাইসেন্স বের করুন।
তিনি বললেন, স্যার, বিআরটিএর পরীক্ষা খুবই কঠিন। লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। প্র্যাকটিক্যালটা স্যার আমরা পারি। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা পারি না। ম্যাট্রিক পাস ছাড়া ওই পরীক্ষায় কেউ পাস করতে পারব না। স্যার, দেশ চালাইতে কোনো পাস লাগে না, আর বেবিট্যাক্সি চালাইতে লাগব ম্যাট্রিক পাস?
ভারী যান চালাতে দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষারও নিশ্চয়ই দরকার আছে। কিন্তু বাস্তব হলো, যাঁরা গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁদের আমরা এক দিনে বসিয়ে দিতে পারব না। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা নয়। মানুষ নানাভাবে শিখতে পারে। বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র। বহু উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মূল্যবোধ নেই, অনেক তথাকথিত কম শিক্ষিত মানুষও উচ্চায়ত আদর্শ, উচ্চতর মূল্যবোধ দিয়ে চালিত হন। কাজেই আমার পরামর্শ হলো, আমাদের চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত হবে, ওই ট্রেনিংটা সম্পূর্ণ করা। সেই ট্রেনিংয়ে ট্রাফিক আইন সব শিখিয়ে দেওয়া হবে। সিগন্যাল চেনানো হবে। আর বারবার করে বলা হবে, জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই।
আবার কৌতুক।
‘তুমি কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট করেছ?’
‘আমি গাড়ি চালাচ্ছি। দেখলাম একটা বাস আসছে, সাইড দিলাম। তারপর দেখি একটা ট্রাক আসছে। সাইড দিলাম। তারপর দেখি একটা ব্রিজ আসছে। সেইটাকে যেই সাইড দিয়েছি...’
আরেকজন ড্রাইভার কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট করলেন, সেটা শুনুন। ‘রাতের বেলা গাড়ি চালাচ্ছি। দেখি, একটা মোটরসাইকেল ডান দিক দিয়ে আসছে। আমি বাঁয়ে সরে গেলাম। এরপর দেখি আরেকটা হেডলাইট। এটা আসছে বাঁ দিক থেকেই। আমি ডানে সরে গেলাম। এরপর দেখি দুইটা হেডলাইট, মানে দুইটা মোটরসাইকেল, ডান দিকে আর বাঁ দিকে। আমি কী করব বুঝতে না পেরে মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালাতে চাইলাম। তখনই...’
একজন লোক গাড়ি চালাচ্ছেন। তাঁর কাছে ফোন এল। শোন, শুনতে পেলাম তোদের ওই রুটে একজন রাস্তার উল্টো লেন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তুই সাবধানে যা। লোকটা উত্তর দিল, ‘না রে। একটা গাড়ি না। আমি দেখছি শত শত গাড়ি উল্টো লেন দিয়ে আসছে।’
আমাদের দেশে রাস্তাঘাট খারাপ। মহাসড়ক বলতে কিছু নেই। মহাসড়কে গরুগাড়ি চলে, হাটবাজার বসে। গাড়ি লক্কড়ঝক্কড় মার্কা। ট্রাফিক নিয়ম বলতেও কিছু নেই। আর গাড়িগুলো ট্রাফিক সিগন্যাল মানছে কি না, তা দেখারও কেউ নেই। বিআরটিএ দুর্নীতির আখড়া। একে তো গরিব দেশ, তার ওপর আবার দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দেশে আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা দৈবা ৎ ই বেঁচে আছি।
আপনারা আবার ভাববেন না, আমার অ্যাকসিডেন্ট হয়নি বলে আমি এত কথা বলছি। তা নয়। আমি দুইবার বড় অ্যাকসিডেন্টে পড়েছি। একবার বন্ধুসভার অনুষ্ঠান করে মাইক্রোবাসে নোয়াখালী থেকে ফেরার পথে কুমিল্লা পেরিয়ে আমাদের মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়ে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বন্ধুসভার কর্মী মেজবা আযাদ। ভাঙা কাচের টুকরায় তিনি রক্তাক্ত হন। অক্ষত ছিলেন ফারুক আহমেদ। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট। শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারান।
একটু পর আমার কাছে প্রথম আলোর রংপুর প্রতিনিধি আরিফুল হকের ফোন আসে। ‘শুনলাম, তুমি মারা গেছ। তাই তোমাকেই ফোন করে জানতে চাচ্ছি, তুমি ঠিক আছ কি না?’
এরপরের দুর্ঘটনাটা ঘটে ঢাকার শেরাটন হোটেলের সামনে। আমি যাচ্ছি সিএনজিচালিত ত্রিচক্রযানে। সামনে একটা মিনিবাস দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বেবিট্যাক্সি তার পেছনে দাঁড়াল। পেছন দিক থেকে এসে একটা মিনিবাস আমাদের ওই বেবিট্যাক্সিকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে লাগল। দুই মিনিবাসের চিপায় পড়ে আমি আর আমার বেবিট্যাক্সিচালক স্যান্ডউইচ হয়ে গেলাম। আমি বলি, ডাবল চিজ স্যান্ডউইচ।
রক্তাক্ত শরীর নিয়ে অতিকষ্টে ভাঙা ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে আমি চি ৎ কার করে উঠেছিলাম, ‘আমার নাম আনিসুল হক, আমাকে একটু কেউ হাসপাতালে নিয়ে যান।’ সে বিরাট গল্প। শুধু আমি নিজেকে বলি, দ্য গ্রেট সারভাইভার অব এ মিনি বেবি অ্যাকসিডেন্ট। বেঁচে আছি বলে এই নিয়ে রসিকতা করতে পারি। বলি, মরলে ভারি দুর্নাম হতো। মিনি বেবি অ্যাকসিডেন্টে কেউ মরে? দুটো ডাবল ডেকারের মাঝখানে পড়লে না নাম হতো!
না, দুর্ঘটনা কোনো কৌতুকের বিষয় নয়। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এদের প্রত্যেকের কাহিনি পড়লে আমাদের চোখে জল আসে। পৃথিবী স্থির হয়ে যায়। আমরা চাই না আর একজন মানুষও অপঘাতে মারা যাক। সবাই মিলে সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। আমরা চাইছি সবাইকে সজাগ করতে। গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে পড়া যেমন বিপজ্জনক, দেশ চালানোর সময় ঘুমিয়ে পড়াও তেমনি ভয়াবহ। আমাদের জেগে থাকতে হবে এবং জাগিয়ে তুলতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.