২৯- এক-এগারোর কুশীলবরা দুর্নীতি দমনের ছদ্মবেশে জাতীয়তাবাদী শক্তিকেই নির্মূল করতে চেয়েছিল

জে. মইন বিএনপি’র অনেক শীর্ষ নেতাকে আটকে রাখেন
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিদেশি শক্তির মধ্যস্থতায় জরুরি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করতে অসম্মতি জানিয়ে দেশেই থেকে যান। নিজ আদর্শে অটল থাকার মূল্য হিসেবে তাকে, তার পরিবারকে এবং তার দলকে অনেক ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
ডিভিশনপ্রাপ্ত কয়েদিরা তো বটেই, এমনকি সাধারণ বন্দিরা জেল প্রশাসনের অনুমতিসাপেক্ষে রমজান মাসে মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে ইফতার আনানোর সুযোগ পান। জেল প্রশাসনের অনুমতি পেতে হলে অবশ্য জায়গামত অর্থ-কড়ি লেনদেনের বিষয়ে উদারহস্ত হতে হয়। এছাড়া প্রভাবশালী বন্দিদের ক্ষেত্রে উপরের নির্দেশ ম্যাজিকের মতো কাজ করে। আমার যেহেতু লেনদেন অথবা উপরের সঙ্গে সমঝোতা উভয় ক্ষেত্রেই ভয়ানক আপত্তি রয়েছে, কাজেই জেলের ইফতারি দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছি। তবে উন্নত মানের ইফতারি কখনও কপালে জুটছে না, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। সাত নম্বর সেলের প্রতিবেশীরা যার যার পিসির অর্থ দিয়ে জেলের বাইরের ইফতার আনালে আমাকে শরিক না করে সেই ইফতারি কখনওই খায় না। ডিভিশন সেল থেকেও মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবদুস সালাম পিন্টু এবং মির্জা আব্বাস কয়েকদিন পর পর তাদের গৃহ থেকে আনানো ফল, ইফতার ইত্যাদি পাঠিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, মাওলানা সাঈদীর সঙ্গে এখনও পর্যন্ত আমার সাক্ষাত্ হয়নি। এক এগারো পরবর্তী সময়ে আমার কলাম পড়ে অভিনন্দন জানাতে বার দুয়েক ফোন করেছিলেন, এটুকু মনে আছে। এই পরিচয়ের সুবাদে তার কাছ থেকে ইফতার আশা করা যায় না। সম্ভবত, অন্তরের টানেই তিনি আমাকে এসব ইফতার সামগ্রী পাঠিয়ে থাকেন। তবে, আমি সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের নিয়মিত ইফতার পাঠানোতে। পাঁচ বছর একই সঙ্গে সরকারে থাকলেও এই রাজনীতিবিদের সঙ্গে সেই সময় কদাচিত্ দেখাসাক্ষাত্ হয়েছে। এক এগারোর প্রথমদিকেই তিনি গ্রেফতার হয়ে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে মুক্তি লাভ করার কারণে ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত জানাশোনার সুযোগ হয়নি। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় অথবা কোনোরকম স্বার্থের সংঘাত না থাকলেও বিচিত্র কারণে আমার প্রতি বিরাগ পোষণ করার ক্ষেত্রে সম্ভবত শেখ হাসিনার ঠিক পরেই তার অবস্থান। বিস্ময়কর বিরাগের উত্পত্তির কাহিনীটি খানিকটা দীর্ঘ হলেও দেশের রাজনীতি বোঝার স্বার্থে পাঠকের জেনে রাখা প্রয়োজন।
এক এগারোর কুশীলবরা দুর্নীতি দমনের ছদ্মবেশে এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকেই যে নির্মূল করতে চেয়েছিল, এ নিয়ে জনমনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই বলেই আমি মনে করি। সেই সময় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিএনপি’র নেতৃবৃন্দের সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মতোই ছিল। আওয়ামী লীগেরও কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তবে, তা ছিল নিতান্তই লোক দেখানো। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিদেশি শক্তির মধ্যস্থতায় জরুরি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করতে অসম্মতি জানিয়ে দেশেই থেকে যান। নিজ আদর্শে অটল থাকার মূল্য হিসেবে তাকে, তার পরিবারকে এবং তার দলকে অনেক ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। যাই হোক, জেনারেল মইন পরিস্থিতির চাপে শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেও বিএনপি’র অনেক শীর্ষ নেতাকে ২০০৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলে আটকে রাখেন। এদিকে নির্বাচন এগিয়ে আসতে থাকলে বিএনপি চেয়ারপার্সন তার দলের নেতৃবৃন্দকে মুক্তি না দিলে নির্বাচনে যোগদান করতে অসম্মতি জানান। তার অনড় অবস্থানের কাছে নতিস্বীকার করে সুশীল (?) ও সামরিক জান্তার সমন্বয়ে গঠিত সরকার নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে জাতীয়তাবাদী দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে জেল থেকে মুক্তি দেয়। সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে মির্জা আব্বাসও ছিলেন।
নির্বাচনপূর্ব সেই সময়টাতে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে দাফতরিক কাজে সহায়তা করার জন্য আমি নিয়মিত তার গুলশান অফিসে যেতাম। সেই সুবাদে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের নানা রকম আচরণ দেখার সুযোগ হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর কুশল বিনিময়ের জন্য এক রাতে সস্ত্রীক মির্জা আব্বাস বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। চেয়ারপার্সনের কক্ষে সেই সময় আরও কয়েকজন বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। জরুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যাঙ্গারু কোর্টে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে নির্বাচনবিধি অনুযায়ী মির্জা আব্বাসকে বেগম খালেদা জিয়া ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মনোনয়ন দিতে পারেননি। চেয়ারপার্সনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুযোগকালে তার কিছু উদ্ধত মন্তব্যে আমি ভয়ানক বিস্মিত হয়েছিলাম। তার নাম উল্লেখ না করে আমার একটি কলামে সে রাতের ঘটনা লিখলে তিনি সঙ্গত কারণেই আমার প্রতি বিক্ষুব্ধ হন। মির্জা আব্বাস নবম সংসদে বিএনপি’র নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও চরম বিরোধী ছিলেন। এই বিরোধিতা কতটা আদর্শিক কারণে, আর কতটা নিজে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারার কারণে, সেটি অবশ্য আমার জানা নেই। সে যাই হোক, তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে, বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যারা প্রভাবিত করেছিল, তার মধ্যে আমিও ছিলাম। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আমার প্রতি তার বিরাগের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ, জাতীয়তাবাদী দলের জন্মলগ্ন থেকে চলমান আব্বাস-খোকা বিরোধে তিনি মনে করেছেন যে, আমি প্রকারান্তরে খোকাকে সমর্থন করছি। অথচ এক এগারো পরবর্তী সময়ে সাদেক হোসেন খোকার দৃশ্যত: আপসকামী মনোভাব এবং আমার প্রকাশ্য জান্তা-বিরোধী তত্পরতার ফলে আমাদের মধ্যে আগেকার যত্সামান্য যোগসূত্রও ছিন্ন হয়। আগেও সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার এক-দু’বারের বেশি দেখা সাক্ষাত্ হয়নি। মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকা উভয়েই পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ এবং দীর্ঘদিন ধরে জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে আছেন। অন্যদিকে, রাজনীতির ময়দানে একেবারেই অপরিচিত আমার চারদলীয় জোট সরকারে হঠাত্ দায়িত্ব পালন অনেকেরই বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল। বিএনপি নেতাদের অনেকেই ২০০১ সালে আমার উড়ে এসে জুড়ে বসাকে পছন্দ করেননি। মইন শাসিত দুই বছরে ঢাকার মেয়রের সঙ্গে একবারের জন্যও দেখা না হলেও সেই সময় আজকের মির্জা আব্বাসপন্থী একাধিক নেতা আমার বাসায় একাধিকবার এসেছেন। মুশকিল হলো, রাজনীতি আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হলে সেখানে যুক্তির কোনো স্থান থাকে না। সেই কারণেই সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মির্জা আব্বাস আদর্শিক অবস্থানের চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। যাই হোক, আমি যেহেতু কোনোরকম দলীয় রাজনৈতিক অভিলাষ পোষণ করি না, সে কারণে মির্জা আব্বাসের মনোভাব বুঝতে পেরে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমিও তাকে এড়িয়েই চলেছি। খোকা-আব্বাস বিরোধ নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এই বিরোধে বিএনপি দল হিসেবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার দায়িত্ব বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলটির বিপুলসংখ্যক ত্যাগী, তৃণমূল কর্মিবৃন্দ এবং নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের। পারস্পরিক সম্পর্কের পুরনো বাস্তবতায় জেলে এসে মির্জা আব্বাসের কাছ থেকে প্রথম দিন ইফতার উপহার পেয়ে আমার বিস্মিত না হয়ে কোনো উপায় ছিল না। জেলে এলে বোধহয় এক আমি ছাড়া সবাই সজ্জন হয়ে ওঠে।
সকালে সেবক সালাহউদ্দিন মারফত খবর পেলাম, মির্জা আব্বাস শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছেন। গত দু’দিন ধরে তার মুক্তি নিয়ে সরকার নানারকম টালবাহানা করছিল। হাইকোর্ট থেকে বৃহস্পতিবার তিনি জামিন পেলেও জেল প্রশাসন উপরের নির্দেশের অজুহাত দেখিয়ে তাকে মুক্তি দিচ্ছিল না। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস নাকি মৌখিকভাবে জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল যে, তারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে চেম্বার জজ আদালতে আপিল করবেন। প্রশাসনের এই আচরণ সরাসরি আদালতের আদেশ লঙ্ঘন কিনা, সেই বিচার উচ্চ আদালত প্রয়োজনবোধে করবেন। শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলে আদালতের রায় নিয়ে প্রশাসনের এই ছেলেখেলা সর্বব্যাপী রূপ নিয়েছে। জামিনের কাগজপত্র জেলগেটে পৌঁছানোর পরও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে ফোন এলেই আদালতের নির্দেশকে কাঁচকলা দেখিয়ে বন্দির মুক্তি আটকে দেয়া হচ্ছে। মির্জা আব্বাসের ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে, আমার জানার কোনো সুযোগ নেই। তিনি ভিআইপি সেলে থাকেন, আর আমি সাধারণ বন্দিদের কাতারে। কাজেই দেখা-সাক্ষাতের কোনো সুযোগ ঘটেনি। তিনি মুক্তি পেয়েছেন, এই খবরেই আমি যথেষ্ট আনন্দিত বোধ করছি। বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হলে আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের লড়াকু এই রাজনীতিকের আগের চরিত্রে ফিরে যাওয়া বিএনপি’র জন্য অত্যাবশ্যক। সাদেক হোসেন খোকা এবং মির্জা আব্বাস ঢাকা শহরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এক সময় কার্যকর নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনগণ তাদের সেই বিপ্লবী চেহারা পুনর্বার দেখতে আগ্রহী হলেও জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে কিনা, সেটা এই সরকারের বাকি মেয়াদকালে দেখা যাবে। দিন শেষ না হতেই আবার দুঃসংবাদ শুনলাম। অশিষ্ট, অগণতান্ত্রিক সরকার তার চরিত্রানুযায়ী মির্জা আব্বাসকে জেল গেট থেকে ফিরিয়ে দিয়ে নতুন মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ করেছে। কারারক্ষীদের কাছ থেকে শুনলাম, জেলগেটের বাইরে অপেক্ষমাণ মির্জা আব্বাসের স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি সরকারের এই অবিচারে একেবারে ভেঙে পড়েছেন। আপন পরিবারের অসহায় অবস্থার কথা স্মরণ করে মিসেস আব্বাসের প্রতি সমবেদনা বোধ করলাম। ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার ফ্যাসিবাদী কৌশলের অংশ হিসেবে একটার পর একটা বানোয়াট মামলা দিয়ে মির্জা আব্বাসের মতো রাজনীতিবিদদের জেলে আটক রেখে শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থন সরকারকে ক্রমেই এক নির্যাতনকারী দানবে পরিণত করছে। এই সরকার যে কেবল ভারতের স্বার্থরক্ষা করার জন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ইসলামী জঙ্গি ভীতিকে ব্যবহার করছে, সে বিষয়টি ওইসব রাষ্ট্রের জনগণ এক সময় অবশ্যই উপলব্ধি করবেন। ততদিনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নেতার ছদ্মবেশে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামক দানবের না উত্থান ঘটে যায়, সেটা নিয়েই যত দুর্ভাবনা। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’-এর সময় আমাদের নাগরিকদের হয়েছে। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণকারী কন্যা বর্তমানে অভিন্ন লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.