১০- চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো আমাকে নেয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে, ঘরটি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা

চোখ বেঁধে টিএফআই সেলে
চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো আমাকে নেয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে। আমাকে বাঁদিকে ঘোরানো হলো, সেটা টের পেলাম। পা থেকে স্যান্ডেল খুলে ফেলতে বলা হলো। ক্ষণিকের জন্য চোখের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। কালো কাপড়টা আবার বাঁধার ফাঁকে দেখলাম দেয়ালের ফ্রেমে আটকানো ড্রিল মেশিন, হাতুড়ি, চিজেল, কাঁচি জাতীয় যন্ত্রপাতি। শরীরের কোন অংশে কোন যন্ত্রটা সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে ভাবছি, এমন সময় গারদের তালা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম...

হাজতের তালা খোলার আগেই আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। অপেক্ষমাণ র্যাবের পিক-আপের দিকে যেতে যেতে নিরাসক্তভাবে বললাম, টিএফআইতে যাচ্ছি, তাই না? আমার আকস্মিক প্রশ্নে দুই কর্মকর্তাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে বোঝালেন, আমার ধারণা সঠিক। আজ পেছনের কেবিনে আমি এবং আইও মোরশেদুল ইসলাম উঠলাম। এসি বসলেন সামনে, ড্রাইভারের পাশে। ডিবি’র মেইন গেট পার হয়ে গাড়ি মিন্টো রোডে পড়তেই দেখি, রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে মা আরও কয়েকজনকে নিয়ে বসে আছেন। আমার মায়ের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বান্ধবী সায়েরা খালাকেও দেখলাম। নয়া দিগন্ত পত্রিকার সাংবাদিক নাজমুলকে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। তখন সকাল সাড়ে ছ’টা। গ্রেফতার হওয়ার পর প্রথমবারের মতো মাকে ওভাবে ফুটপাতে বসে থাকতে দেখে কষ্টে বুক ভেঙে গেল। পরবর্তী সময়ে জেনেছি, ডিবিতে রিমান্ডের প্রতিটি দিন আমার মা এবং স্ত্রী তো বটেই, জাতীয়তাবাদী দলের সংসদ সদস্যবৃন্দ, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবীরা দিন-রাত পালা করে আমার সংবাদের অপেক্ষায় এভাবেই মিন্টো রোডের রাস্তায় বসে থেকেছেন। আমার মতো অতিসাধারণ একজন ব্যক্তির জন্যে তাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসার ঋণ শোধ করব এমন সাধ্য আমার নেই। তবে আমৃত্যু তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব এই অঙ্গীকার করছি। গাড়ির ভেতরে আমাকে কেউ লক্ষ্য করলেন কি-না বুঝতে না পারলেও হাত নেড়ে উপস্থিতি জানান দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।
মিন্টো রোড ছেড়ে ভিআইপি রোড দিয়ে র্যাবের গাড়ি দ্রুত উত্তর দিকে ছুটতে লাগলো। টিএফআই (টাস্ক ফোর্স ইন্টেরোগেশন) সেল কোথায় জানি না। সেই মুহূর্তে টিএফআই’র পরিবর্তে আমার মাথায় মায়ের রাস্তায় বসে থাকার দৃশ্যই ঘুরছে। যথারীতি জাহাঙ্গীর গেট অতিক্রম করতেই ভাবলাম, ক্যান্টনমেন্টের কোনো গোপন স্থানে হয়তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খানিক বাদে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে গাড়ি এয়ারপোর্ট রোডে প্রবেশ করলে সন্দেহ করলাম আমরা উত্তরার র্যাব-১ হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছি। ঠিক তা-ই হলো। আমার সঙ্গের দুই ডিবি কর্মকর্তা আগে কখনও টিএফআই সেলে আসেননি। র্যাব-১-এ ঢুকেই তারা সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা বিশেষ সেলটি কোনখানে। একাধিক সেন্ট্রির সাহায্য নিয়ে সেই বিশেষ স্থানের সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। দেখলাম সম্পূর্ণ আলাদা এক কম্পাউন্ড। উদ্যত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে র্যাবের কালো পোশাক পরিহিত সেন্ট্রি এগিয়ে এলে পরিচয় দেয়া হলো। আমরা ওখানেই গাড়ি রেখে হেঁটে সেই কম্পাউন্ডে প্রবেশ করলাম। মাঝখানে আসামি, দু’পাশে ডিবি কর্মকর্তাদ্বয়। পেছনে অস্ত্রধারী র্যাব সদস্য। দোতলা ভবনের নিচতলায় অস্ত্রাগার লেখা একাধিক কক্ষ লক্ষ্য করলাম। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠেই দেখি সামনের দরজা বন্ধ। সম্পূর্ণ স্টিলের পাতের দরজা। উপরের দিকে ছোট্ট একটি বর্গাকৃতি কাটা অংশ রয়েছে। সেটিও ভেতর থেকে অতিরিক্ত পাত দিয়ে বন্ধ করা। অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার কলিং বেলে চাপ দিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই কাটা অংশটি খুলে গেল। আমরা বাইরে থেকে সেন্ট্রির চোখ দুটো এবং কপালের খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছি। অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার এগিয়ে গিয়ে কথা বললেন। পাত বন্ধ হয়ে গেল। আবারও অপেক্ষা। এবার দরজা খুললো, আমরা টিএফআই সেলের ভেতরে ঢুকলাম। এই টিএফআই সেলে নির্যাতনের কত কাহিনী আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
ভেতরে যেতেই সম্ভবত নিম্নপর্যায়ের একজন তরুণ কর্মকর্তা একটা রেজিস্টার নিয়ে এলেন। ডিবি’র কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সরকারি চিঠিপত্র ছিল। সেগুলো আদান-প্রদান, রেজিস্টারে লেখালেখির ফাঁকেই সিভিল পোশাকে দু’জন সেন্ট্রি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। একজনের হাতে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র এবং অন্যজনের হাতে কালো কাপড় ও হাতকড়া। আমরা একটা করিডোরের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি বাঁদিকে সাদা রঙের ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে অন্য একজন সেন্ট্রি আমাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। রক্তচাপ যন্ত্র নিয়ে যে ব্যক্তি উপস্থিত হলো, তাকে বললাম আমার রক্তচাপজনিত কোনো সমস্যা নেই। সে জানালো রুটিন কাজটা করতেই হবে। মাপা হলো, যথারীতি ১২০ এবং ৮০। ছেলেটি একটু অবাক হয়েই আমার দিকে তাকালো। বোধহয় ভেবেছিল আতঙ্কে ততক্ষণে নিশ্চয়ই আমার রক্তচাপ অনেক চড়ে গেছে। হাতকড়া ও কালো কাপড়অলা আমার চশমা, ঘড়ি এবং আংটি নিয়ে নিল। হাতকড়া পরানোর সুবিধার্থে দু’হাত এগিয়ে দিলাম। চোখ বেঁধে ফেলার পর দাঁড়িয়ে আছি; দুই ডিবি কর্মকর্তা আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। শুনতে পেলাম, তারা বলছেন সকালে আমি কিছু খাইনি, অতএব নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
এবার সেলে যেতে হবে। চোখ বাঁধা, কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমাকে যে বাঁদিকে ঘোরানো হলো, সেটা টের পেলাম। পা থেকে স্যান্ডেল খুলে ফেলতে বলা হলো। তারপর একটা সেলে ঢুকিয়ে এক হাতের কড়া খুলে দিয়ে সেন্ট্রি বসতে বললো। আন্দাজে দেয়াল হাতড়ে বসে পড়লাম। জায়গাটা খুবই অপ্রশস্ত বোধ হলো। বসামাত্র সেন্ট্রি অপর হাতের সঙ্গে ঝুলতে থাকা হাতকড়া গারদের লোহার মোটা শিকের সঙ্গে আটকে দিল। ওই আটক অবস্থায় বসে থাকা খুবই অসুবিধাজনক। ঠেলেঠুলে কোনোরকমে বসলাম। সেলের একপাশের দেয়ালে পিঠ রেখে পা সোজা করার চেষ্টা করলাম। অপর পাশের দেয়ালটিকে পা দিয়ে স্পর্শ করতে পারলাম। আন্দাজ করলাম, সেলটি প্রস্থে হয়তো তিন ফুটের বেশি হবে না। ধাতস্থ হয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছি। অন্য সেল থেকে যন্ত্রণাকাতর গোঙানির আওয়াজ কানে ভেসে এলো। কোনো এক ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্র চলারও প্রচণ্ড শব্দ পেলাম। পরে জেনেছিলাম, যন্ত্রটি বৃহদাকার এগজস্ট ফ্যান। আল্লাহ মানুষকে মানিয়ে নেয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা দিয়েছেন। আটকানো হাত নিয়েই কিছুক্ষণ কসরত করে দেখলাম, মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারছি। কী হতে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তার পরিবর্তে অতীতে ডুব দিলাম। ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর সেন্ট্রি নাস্তার থালা নিয়ে হাজির হলো। চোখের বাঁধন এবং লোহার শিক থেকে হাতকড়া খোলা হলো। সেলের সেই অন্ধকারে থালায় মনে হলো রুটি এবং জাউ জাতীয় বস্তু রয়েছে। প্রহরারত সেন্ট্রিকে জানিয়ে দিলাম আমি ক্ষুধাবোধ করছি না, সে নাস্তার থালা ফিরিয়ে নিতে পারে। কোনো কথা না বলে তরুণটি থালা ফিরিয়ে নিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক পরই আবার এসে জানালো, যেহেতু আমি নাস্তা খাচ্ছি না তাই আবার চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া লাগানো হবে। আমি হেসেই জবাব দিলাম, অবশ্যই। মিনিট দশেক চোখ খোলা থাকার সুযোগে আমি চারপাশটা মোটামুটি দেখে নিয়েছি। সরু করিডোরের দু’পাশে সারি বেঁধে গোটা দশেক সেল। কোনো সেলেই বাতির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই উচ্চতা ও লম্বার দিকটা ঠিক বোঝা গেল না। যথারীতি কালো কম্বল দেখতে পেলাম। আমি কম্বল সরিয়ে মাটিতেই বসে থাকলাম। আমার সেলের উল্টোদিকে আর একটা প্যাসেজের মতো রয়েছে; তার শেষ মাথায় টয়লেট এবং গোসলের স্থান। কোনো এক বন্দি হাতকড়া বাজিয়ে সেন্ট্রিকে ডাকলো। তাকে ধরে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হলো। বোঝা যাচ্ছিল নির্যাতনের ফলে বন্দিটির হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
আরও অন্তত এক ঘণ্টা পার হয়েছে। আগের সেই তরুণ সেন্ট্রি এসে গারদের তালা খুললো। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় হয়েছে। চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরিহিত অবস্থাতেই জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। আমাকে একটা চেয়ারে বসানো হলো। সামনের টেবিলের সঙ্গে হাঁটুর ধাক্কা লাগাতে বুঝলাম প্রশ্নকর্তা টেবিলের ওপারেই। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমার চৌদ্দ পুরুষের পরিচয় এবং জন্ম থেকে ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় তথ্য নেয়া হলো। কত সময় লাগলো বলতে পারব না। তবে এক ঘণ্টার ওপরেই হবে। সেলে ফিরিয়ে দেয়ার আগে জানানো হলো, এটা ছিল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ, আসলটা নাকি দ্বিতীয় দফায় হবে। অন্ধের মতো সেলে ধরে নিয়ে এলো। দ্বিতীয় জিজ্ঞাসাবাদের আগে অল্প সময়ের অপেক্ষা। তবু আগের মতোই হাত আটকে রাখা হলো গারদের শিকের সঙ্গে। উদ্দেশ্য, শারীরিক অসুবিধা সৃষ্টিসহ মানসিকভাবে নির্যাতন করে মনোবল ভেঙেচুরে দেয়া।
ওই অবস্থায় পনেরো মিনিটও পার হয়নি, আসল জিজ্ঞাসাবাদের ডাক চলে এলো। এবার জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের বাইরে চোখের বাঁধন খুলে, বুকে আসামির নম্বর সেঁটে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা হলো। এসব নাটকের উদ্দেশ্য ধারণা করলাম, আতঙ্কিত করার পাশাপাশি অসম্মান করা। ছবি তোলা শেষ হলে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না, তবু যেন মনে হলো এটি ভিন্ন কক্ষ। প্রথমবারের মতোই একটা চেয়ারে বসলাম। নতুন প্রশ্নকর্তা তার কাজ শুরু করলেন। একই ধরনের প্রশ্নমালা, আরও একটু বিশদভাবে। প্রশ্নের মাঝখানে বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়া অস্বাভাবিক মনে হলো। চোখ বাঁধা থাকলেও অনুভব করা যাচ্ছিল একটা তীব্র আলো পাঁচ মিনিট পরপর জ্বলছে আর নিভছে। ভেবেছিলাম টিএফআই সেলের কোনো বিশেষ তরিকা হবে। কিন্তু প্রশ্নকর্তা জানালেন, আসলেই নাকি ঘণ্টায় বার দশেক করে বিদ্যুত্ যাওয়া-আসা করছে। কোনটি সঠিক আল্লাহই জানেন। সওয়াল-জবাব অন্তত এক ঘণ্টা চলার পর দরজা খোলার এবং অনেকগুলো জুতার আওয়াজ পেলাম। টের পেলাম প্রশ্নকর্তা মুখোমুখি চেয়ার থেকে উঠে কোনো বড়কর্তাকে সেখানে বসতে দিলেন। প্রশ্নের ধরন পাল্টে গেল। পনেরো মিনিট কথিত উত্তরা ষড়যন্ত্র নিয়ে কথাবার্তা হলো। দু’দিন আগে ডিবিতে দেয়া বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করলাম। মামলা সম্পর্কে প্রশ্নকর্তাদের উত্সাহে দ্রুতই ভাটা পড়লো। এবার বৃহত্তর রাজনৈতিক আলোচনা। কেন আমি বিনা টেন্ডারে গ্যাস কমপ্রেসর ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ ছাপতে গেলাম? সরকারের এ-জাতীয় সমালোচনা করার জন্যেই আমার আজকের দুরবস্থা, সেটাও জানানো হলো। একজন প্রশ্নকর্তা অন্য মিডিয়া মালিকদের মতো আমাকে সরকারের সঙ্গে মানিয়ে চলতেও পরামর্শ দিলেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বিএনপি’র একজন নেতার নামও উল্লেখ করলেন। আমি জবাবে বললাম, আইন করে সেন্সরশিপ আরোপ করা হোক, আমাদের লেখার আর সুযোগ থাকবে না। কিন্তু গণতন্ত্রের ডঙ্কা বাজানো হবে আর আমরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছাপতে পারব না—এমন দ্বিমুখী আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। কথা প্রসঙ্গে বিনা টেন্ডারে বিদ্যুত্ ক্রয় এবং ট্রানজিট প্রদান বিষয়ে আমার অনমনীয় অবস্থান নিয়েও আলোচনা হলো। আমি সোজাসুজি বললাম, বিনা টেন্ডারে বিদ্যুত্ কেনার জন্যে সরকার অবশ্যই একদিন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হবে। বিশেষত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান যখন সেই ব্যবসার সিংহভাগ দখল করে আছে, তখন জনমনে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। আর ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের কোনোরকম অর্থনৈতিক সুবিধা তো হবেই না, উপরন্তু আমাদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। যে কোনো সময় আমি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে পারি—এই আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে খানিকটা রসিকতার সুরেই বললাম, আজ আমাকে বিনা অপরাধে যেমন করে আপনারা চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন—এমনও হতে পারে বিনা টেন্ডারে বিদ্যুত্ কেনা এবং দেশের অপরিসীম ক্ষতি করে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার অপরাধে বর্তমান নীতিনির্ধারকদেরও ভবিষ্যতে এখানে একইভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আমার কথা শুনে উপস্থিত কর্মকর্তারা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এবার একটা বিরতি দেয়া যাক। আমার সকাল থেকে কিছু না খাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে একজন কর্মকর্তা আমি কিছু খেতে চাই কি-না জানতে চাইলে এক কাপ চায়ের অনুরোধ করলাম।
সেলে ফিরে পূর্ববত্ হাতকড়া পরে বসে রইলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট এবং এক গ্লাস পানি এলো। সেলে বসেই একটা বিস্কুট দিয়ে চা খেলাম। পাহারারত সেন্ট্রি সহানুভূতি মেশানো কণ্ঠে আমাকে আর একটা বিস্কুট খেতে অনুরোধ জানালে কৃতজ্ঞচিত্তে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে মাথা নাড়লাম। চা শেষ করতে না করতেই আবার জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে যাওয়ার সময় হলো। এবার সরাসরি অভিযোগ দিয়ে শুরু হলো। বিনিয়োগ বোর্ডে আমার নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করা হলো। আমি পরিসংখ্যান দিয়ে জানালাম, তাদের অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। বরঞ্চ আমার দায়িত্ব পালনকালীন সর্বশেষ বছর ২০০৫-এ সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের ৩৪ বছরের মধ্যে এক বছরে সর্বোচ্চ ৮৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছিল। বাস্তবতা হলো, মহাজোট সরকারের শাসনামলে বিদেশি বিনিয়োগে ধস নেমেছে। এই ব্যর্থতার জন্যে বিনিয়োগ বোর্ডের বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. সামাদকে আমার মতো চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে টিএফআই সেলে নিয়ে এসে নির্যাতন করা হবে কি-না, নির্দোষভাবে তাও জানতে চাইলাম। একজন একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনার ওপর আমরা কোনো নির্যাতন করিনি। নির্যাতনের কী দেখেছেন আপনি? আমিও বলে উঠলাম, ৫৭ বছর বয়সে অন্ধকূপের মতো একটা সেলে গারদের শিকের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে আটকে, কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে আমাকে ফেলে রেখেছেন, অবমাননাকরভাবে দাগী আসামির মতো বুকে নম্বর সেঁটে আমার ছবি তুলছেন, ব্যঙ্গাত্মকভাবে নানারকম প্রশ্ন করছেন, আমার সংসারের মানুষগুলো জানে না আমি এখন কোথায়, কীভাবে আছি। এটা নির্যাতন নয়? এখন শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দিচ্ছেন। কক্ষে উপস্থিতদের মধ্যে যিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি এই তর্ক আর বাড়তে দিলেন না। এরপর সুশাসন নিয়ে কিছুক্ষণ মতবিনিময় হলো। বিদ্যমান ভয়াবহ বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে আমি কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে বললাম, ইচ্ছে হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। ঘণ্টা দুয়েক পর অনেকটা আকস্মিকভাবেই একজন বলে উঠলেন, আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, আপনাদের না থাকলে ওনাকে ছেড়ে দিতে পারেন। মিনিটখানেক সবাই চুপ করেই রইলেন। তারপর একাধিক চেয়ার সরানোর শব্দে বুঝলাম, সবাই ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পাঁচ মিনিট মতো একাই বসে রইলাম। তারপর একজন এসে সেলে নিয়ে যাওয়ার সময় ডিম ও ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার অনুরোধ করলে আমি সম্ভব হলে আর এক কাপ চা চাইলাম। আন্দাজ করছিলাম, ততক্ষণে তিনটে বেজে গেছে। সেলে ফেরার পর চোখ না বেঁধেই কিছুক্ষণ রাখা হলো। একহাতে হাতকড়া ঝুলছে, অন্য হাতটা মুক্ত। অল্প সময়ের মধ্যেই চা, বিস্কুট, পানি ট্রেতে করে নিয়ে আসা হলো। আগের বারের মতোই একটা বিস্কুট এবং চা খেলাম। একজন সেন্ট্রি ট্রেটা নিয়ে যাওয়ার পর অন্য একজন যথেষ্ট বিনীতভাবে চোখ বাঁধবার এবং হাতকড়া পরানোর অনুমতি চাইলেন। এখানে আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য না থাকলেও সেন্ট্রিটির সৌজন্য ভুলব না কোনোদিন। মনে ভরসা ফিরে এলো। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত বিদ্বেষজনিত কারণে আমার প্রতি যতই কূপিত হন না কেন, দেশের জনগণ যে আমার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে, তার প্রমাণ পেলাম টিএফআই সেলের সেন্ট্রির মমত্ববোধ প্রদর্শনে।
এবার অপেক্ষার পালা। প্রচলিত আইন অনুযায়ী আজই আমাকে রিমান্ড শেষে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করার কথা ছিল। বর্তমান সরকার আইনের যে কোনো তোয়াক্কা করে না, সেটা অবশ্য দেশের তাবত্ নাগরিক জানেন। বিকেল পাঁচটায় সিএমএম আদালতের দিনের কার্যক্রম শেষ হবে। ঘড়ি দেখার সুযোগ না থাকলেও সময় যে ততক্ষণে বিকেল চারটা পার হয়ে গেছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে উত্তরা থেকে জনসন রোড পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, আজ অন্তত আমার রিমান্ড শেষ হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী সেলগুলো থেকে কখনও শেকলের শব্দ, কখনও বা অস্ফুট গোঙানির শব্দে জীবিত মানুষের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। আমি নস্টালজিক প্রকৃতির লোক। চোখ বুজলেই ৫৭ বছরের স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। পাঠক হয়তো ভাবছেন আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলো নাকি। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা লোকের আবার চোখ খোলা আর বোজা। উভয় অবস্থাতেই তো সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। তবে পার্থক্যটা হৃদয়ের। সেটা অনুভব করতে হলে ওই ধরনের নির্যাতনপুরীতে চোখ এবং হাত বাঁধা অবস্থায় সেল নামক অন্ধকূপে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চরম অনিশ্চয়তাময় অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে। অনুভব করছি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। কালো কাপড়ের ওপারে সামান্য যে ছায়ার মতো এতক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলাম, সেটাও ক্রমেই আঁধারের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। সারারাত ওখানে থাকার জন্যে মানসিক শক্তি অর্জন করবার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে ক্ষণিকের জন্যে চোখের বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছিল। কাপড়টা আবার শক্ত করে বাঁধার ফাঁকে দেয়ালে ঝোলানো একটা ফ্রেম দেখতে পেয়েছিলাম। সেই ফ্রেমে আটকানো ড্রিল মেশিন, হাতুড়ি, চিজেল, ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি জাতীয় বেশ কয়েকটি যন্ত্রপাতি নজরে পড়েছিল, যেগুলো কোনো মেশিন-টুলস্ কারখানায় থাকাই বেশি মানানসই হতো। আমার শরীরের কোন অংশে কোন যন্ত্রটা সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে ভাবছি, এমন সময় গারদের তালা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম। একজন সেন্ট্রি চোখের কাপড় এবং হাতকড়াটা খুলে দিলে অবাক হয়ে তাকালাম। আরও বিস্মিত হলাম যখন সকালে আমার পা থেকে খুলে নেয়া স্যান্ডেলটা ফেরত দেয়া হলো। তবে কি টিএফআই রিমান্ড থেকে মুক্তি মিলছে? করিডোরের সামনে ঝোলানো ভারি পর্দাটা সরিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখি, মামলার আইও মোরশেদুল ইসলাম বেশ উত্কণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। টিএফআই সেলেরই একজন সেন্ট্রি একটা মোটা খামের ভেতর থেকে আমার চশমা, ঘড়ি এবং আংটিটা বের করে হাতে দিলেন। দোতলার সেই রহস্যময় স্টিলের দরজা খুলে দেয়া হলো। যত দ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে টিএফআই কম্পাউন্ডের বাইরে অপেক্ষমাণ ডিবি’র সাদা রঙের মাইক্রোবাসে উঠে পানি চাইলাম। ছিপি খুলে পানির বোতলটা মুখে দিতে যাব, এমন মুহূর্তে অস্ত্র হাতে কালো পোশাক পরিহিত একজন র্যাব সৈনিক এসে হাজির। রহস্যের তখনও বাকি আছে।

No comments

Powered by Blogger.