১৮- পশ্চিমাদের ব্ল্যাংক চেক পেলেও ড. ইউনূসের ছায়া প্রধানমন্ত্রীকে ক্রমাগত তাড়া করে ফিরছে

খানিক পর পর আতঙ্কিত দৃষ্টি তরবারির দিকে
....বাংলাদেশে ২০০৭ সালের জাতিসংঘ নির্দেশিত ক্যুদেতার মূল লক্ষ্য যে প্রফেসর ইউনূসকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো ছিল, সেটা শেখ হাসিনার পক্ষে কিছুতেই ভোলা সম্ভব হচ্ছে না। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট প্রফেসর ইউনূসরূপী ডেমোক্লিসের তরবারি যতক্ষণ মাথার ওপর ঝুলছে, ততক্ষণ তিনি সিংহাসনে আয়েশ করে বসেনইবা কি করে? নিজের অজান্তেই খানিক পর পর আতঙ্কিত দৃষ্টি তরবারির দিকে চলে যাচ্ছে।...

আমার সেবক পরিবর্তন হয়েছে। কাশিমপুর জেলের ডিভিশন ওয়ার্ডে ফাই-ফরমাশ খাটার জন্যে একজন বাবুর্চিসহ তিনজন আসামিকে কামপাশ দেয়া হয়। এই ‘কামপাশ’ শব্দটি জেলখানার পরিভাষা। সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের জেলখানায় বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করা হয়। টয়লেট পরিষ্কার করা থেকে রান্না-বান্না কোনো কিছুই জেলের আইনে কাজের বাইরে থাকে না। সেসব কাজ কর্তৃপক্ষের সন্তোষমত করতে পারলে জেলের মেয়াদ কমে। একজন কয়েদি ঠিকমত কাজকর্ম করলে এবং তার বিরুদ্ধে কারা আইন ভঙ্গের কোনো অভিযোগ না থাকলে মোটামুটি ২২ দিন সাজা খাটলে এক মাস দণ্ড ধরা হয়। আসামিদের কাজ বণ্টন জেল প্রশাসনের যে কার্ডটিতে লিপিবদ্ধ করা হয়, তারই নাম কামপাশ। তবে আমার মতো বিনাশ্রম অথবা সিভিল কয়েদিদের কোনো কাজ করতে হয় না এবং সে কারণেই দণ্ড কমা বা রেমিশনের সুযোগও নেই।
এখানে আমার দুই মাসের জেলজীবনে এ পর্যন্ত একবার বাবুর্চি পরিবর্তন হয়েছে, এবার সেবকের পরিবর্তন হলো। ডিভিশন ওয়ার্ডে সেবকদের নেতা কালাম মেট পদপ্রাপ্তির কারণে জেলের অন্যান্য কয়েদিকে তার অধীন কর্মচারী হিসেবেই গণ্য করতে অভ্যস্ত। স্বভাবে গোঁয়ার ও ব্যবহারে রুক্ষ কালামের সঙ্গে কারও বেশিদিন মানিয়ে চলা যথেষ্ট কঠিন। আমিও যে মাঝে-মধ্যে বিরক্ত হই না তা নয়; তবে ছেলেটির মনটা ভালো, এই জন্যে ছোটখাটো ধমক দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখি। দু’তিনদিন আগে এক বিকেলে পুরনো সেবক আমাকে নোটিশ দিয়ে জানালো, ডিভিশন ওয়ার্ডে কালাম থাকলে সে আমার কাজ আর করবে না। আমি জবাবে বললাম, তথাস্তু। তুমি তাহলে প্রশাসনকে বলে অন্য কোথাও কামপাশ দেখ। ফলে সেবকের পরিবর্তন হতে দেরি হয়নি। নতুন সেবকের নাম হাতেম। কানে খাটো, হাবাগোবা জামালপুরের হাতেমকে দেখে মনে করেছিলাম, বোধহয় কোনো লঘু অপরাধে জেলে এসেছে। আগমনের কারণ জানতে চেয়েই আমার আক্কেল গুড়ুম। স্ত্রী হত্যার অভিযোগে হাতেমের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। জেলখানায় এক কালাম ছাড়া এ পর্যন্ত আর কাউকে অকপটে খুনের ঘটনা স্বীকার করতে দেখিনি। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
হাতেমের কান্নাকাটির মাঝখান থেকে অনেক কষ্টে তার পক্ষের কাহিনী উদ্ধার করলাম। কৃষক হাতেম এক রাতে খানিক দেরিতে বাড়ি ফিরলে আর দশটা বউয়ের মতো ওর স্ত্রীও ঝগড়া-ঝাঁটি শুরু করে দেয়। হাবাগোবা হলে কী হবে, ঝগড়ার একপর্যায়ে পুরুষ প্রজাতির হাতেম মিঞার পৌরুষ জেগে ওঠায় বউয়ের গায়ে হাত তুলতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তারপর সেই বউয়ের বিরুদ্ধেই উল্টো নালিশ নিয়ে রাত থাকতেই হাতেম নাকি বীরদর্পে হাজির হয়েছিল তার শ্বশুরবাড়িতে। এদিকে গাঁয়ের বোকা বধূটি স্বামীর হাতে মার খাওয়ার অভিমানে তিনটে অসহায় ছোট মেয়েকে পেছনে ফেলে গলায় দড়ি দিয়ে জ্বালা জুড়িয়েছে। পরদিন সকালে পাড়া-প্রতিবেশী এই ঘটনা জানার পর পুলিশে খবর দিলে শ্বশুরবাড়ি থেকেই হাতেম গ্রেফতার হয়। পুলিশের দাবি, হাতেম বউকে খুন করে লাশ ঝুলিয়ে রেখে অ্যালিবাই সৃষ্টির জন্যে শ্বশুরবাড়িতে গেছে। এতটা চিকন বুদ্ধি হাতেমের আছে কি-না, এ নিয়ে এই ক’দিনে আমি অন্তত যথেষ্ট সন্দিহান।
আমি ভাবছিলাম, বউটা তো মরে বাঁচলো। হাতেমও কাশিমপুর জেলে তিন বেলা আহার পাচ্ছে। কিন্তু তিনটি অসহায় শিশু এই জনারণ্যে কোথায় হারিয়ে গেল? হাতেমও পরিষ্কার করে কিছু জানাতে পারল না। তার ধারণা হয়তো চাচা-মামা কারও আশ্রয়ে আছে। গ্রামের অশিক্ষিত কৃষকটির ওপর মহাবিরক্ত হয়েও তাকে বিদায় করতে মন উঠছে না। কাশিমপুর জেলে দুই খুনের আসামি নিয়ে আমার বর্তমান সংসার। একজন তার অপরাধের কথা স্বীকার করেছে, অপরজনের অপরাধ বোঝার মতো বুদ্ধিও নেই। এটুকুই তফাত।
এদেশে মার্কিনিদের দুই ঘনিষ্ঠতম মিত্রের মধ্যে ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে গেছে জেনে বেশ কৌতুক বোধ করছি। খবরের কাগজে পড়লাম, নরওয়ের টেলিভিশনে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একটি প্রতিবেদন প্রচার নিয়েই এই ঝগড়ার সূত্রপাত। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রফেসর ইউনূস নাকি বেআইনিভাবে তার পরিচালনাধীন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাত্ ৭৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করেছেন। নরওয়ে সরকার টাকাটা গ্রামীণ ব্যাংককে অনুদান হিসেবে দিয়েছিল। নরওয়ের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্ক আমার কাছে সবসময়ই লাভ-হেইটের (Love-hate) মতো মনে হয়েছে। গ্রামীণফোনের প্রধান বিদেশি অংশীদার টেলিনর নরওয়েরই সর্ববৃহত্ বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি।
বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে টেলিনরের লোকজন তাদের নানারকম কাজকর্মে প্রায়ই আমার শরণাপন্ন হতো। তাদের মধ্যে অনেককে তখন প্রকারান্তরে প্রফেসর ইউনূসের সমালোচনা করতে শুনেছি। কোম্পানির বোর্ড সভায় গ্রামীণফোনের সম্প্রসারণ প্রকল্পে তিনি নাকি বাধা প্রদান করতেন, এমন কথাই শুনতাম। বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার্থে আমি টেলিনরকে লভ্যাংশ প্রদান হ্রাস করে এদেশে পুনঃবিনিয়োগ (Re-investment) করার জন্যে চাপ দিলে তারা বলতো, বাংলাদেশী অংশীদার গ্রামীণ ব্যাংক নাকি পুনঃবিনিয়োগের পরিবর্তে লভ্যাংশ পেতেই অধিকতর উত্সাহী। এসব অভিযোগের সত্য-মিথ্যা না জানলেও পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটির দেশি-বিদেশি অংশীদারের মধ্যকার মতবিরোধের কাহিনী সংবাদপত্রের পাতায়ও স্থান পেয়েছে। অপরদিকে নোবেল পুরস্কার নরওয়ে থেকেই দেয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে প্রফেসর ইউনূস নোবেল পাচ্ছেন এমন প্রচারণা চলার পর তিনি শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি পান। বাংলাদেশের জনগণের জন্যে তার এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। তবে নরওয়ের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্ক যা-ই থাক না কেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে পছন্দের তালিকায় মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের কাছে তিনি যে এক নম্বর ব্যক্তি, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সেদেশের সরকারি ও বেসরকারি তাবত্ পুরস্কার তিনি ইতোমধ্যে পেয়েছেন। ক্লিনটন দম্পতির সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের গল্প বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে তো বটেই, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও বহুল প্রচারিত।
এহেন প্রফেসর ইউনূসকে হটিয়ে মার্কিন প্রশাসনের এক নম্বর বন্ধুর স্থানটি দখলের জন্যে বেশ কয়েক বছর ধরে জানপাত করছেন আমাদের হেজাব পরিহিত সেক্যুলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পরিশ্রম অনেকাংশে যে সাফল্যের মুখও দেখেছে, সেটা আমরা ডিজিটাল নির্বাচনেই টের পেয়েছি। প্রফেসর ইউনূসকে স্থানচ্যুত করতে না পারলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার করায়ত্ত করার পাশাপাশি পশ্চিমাদের কাছ থেকে ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী দলের ওপর সবধরনের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন চালানোর ব্ল্যাংক চেকও আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না তিনি। প্রফেসর ইউনূসের ছায়া তাকে ক্রমাগত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ নির্দেশিত ক্যুদেতার মূল লক্ষ্য যে প্রফেসর ইউনূসকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো ছিল, সেটা শেখ হাসিনার পক্ষে কিছুতেই ভোলা সম্ভব হচ্ছে না। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট প্রফেসর ইউনূসরূপী ডেমোক্লিসের তরবারি যতক্ষণ মাথার ওপর ঝুলছে, ততক্ষণ তিনি সিংহাসনে আয়েশ করে বসেনই বা কী করে? নিজের অজান্তেই খানিক পরপর আতঙ্কিত দৃষ্টি তরবারির দিকে চলে যাচ্ছে।
আরও একটি অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি নিশ্চিত নোবেল পুরস্কার থেকে শেখ হাসিনাকে বঞ্চিত করে নিজে সেটি করায়ত্ত করবেন আর তার মাশুল দেবেন না, এও কি হয়? নরওয়ে টেলিভিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ক্ষুরধার বচনে প্রফেসর ইউনূসকে ক্ষতবিক্ষত করার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে গ্রামীণ ব্যাংকের কথিত অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ড. ইউনূস অবশ্য সেই তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেখা যাক, কোথাকার পানি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! এই কাইজ্যার মধ্যে ভারত-মার্কিন লবির মুখপত্র ডেইলি স্টার পড়ে গেছে মহাফাঁপরে। বেচারাদের একেবারে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা! সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, বিশেষ প্রতিবেদন ইত্যাদির বন্যা ছুটিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রধানমন্ত্রীর রুদ্ররোষ থেকে প্রফেসর ইউনূসকে রক্ষা করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে ইংরেজি দৈনিকটি। এদিকে প্রধানমন্ত্রীও তাদের নিজেদের লোক। সুতরাং, এমন কিছু লেখা যাবে না যাতে সেক্যুলার প্রধানমন্ত্রী আবার বিব্রত হন। অতএব সদুপদেশ দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা।
সুশীল (?) পত্রিকার সর্বশেষ নসিহত হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না যাতে তদন্ত প্রভাবিত হয়। সন্দেহ নেই অত্যন্ত সাধু উপদেশ। তবে আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও, এই প্রবাদটির কথা বোধহয় পত্রিকাটির কর্তাব্যক্তিরা ভুলে গেছেন। জেনারেল মইন ও বর্তমান সরকারের আমলে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং শত শত তদন্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। ডেইলি স্টারের নিয়মিত পাঠকরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, সেসব তদন্ত চলাকালে এই পত্রিকাটিতে অসত্য এবং অর্ধসত্য সংবাদ ছাপিয়ে কীভাবে ইন্ধন দেয়া হয়।আমার গ্রেফতারের আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে ডেইলি স্টারে এক বিশাল প্রতিবেদন পড়েছিলাম। সেই সংবাদে বিশেষ সংস্থার বায়বীয় লোকজনের বরাত দিয়ে যেভাবে তারেক রহমানকে বোমা হামলায় জড়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা এখনও ভুলে যাইনি। একইভাবে জরুরি সরকারের সময়ও বিশেষ সংস্থার ফরমায়েশ অনুযায়ী রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন করতেও পত্রিকাটির বাধেনি। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তারা যে সদুপদেশ দিচ্ছেন, সেগুলো ওইসব সংবাদ ছাপানোর সময় সম্ভবত তাদের মনে পড়েনি। অবশ্য এদেশে ক’জনই বা কথা এবং কাজে মিল রেখে চলে? ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্দি অবস্থায় রয়েছি। নরওয়ে টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদনের পেছনের তথ্য জানার কোনো উপায় নেই। তবে আমার ধারণা, মার্কিন দূতাবাস এর মধ্যেই মাঠে নেমে গেছে। দুই ঘনিষ্ঠ মিত্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তাদের স্বার্থের প্রতিকূল। যত দ্রুত এই ঝগড়া মেটানো যায়, ততই মঙ্গল। ডেইলি স্টারও তাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

No comments

Powered by Blogger.