৩৮- কনডেম সেলের মতো ভীতিকর স্থানে পর পর দুই কারারক্ষীর আকস্মিক মৃত্যু ঘটল

কারারক্ষী বেচারা মুহূর্তে ভূতলশায়ী
কারারক্ষীটি হাঁক দিতেই খাটিয়া বহনকারীরা থেমে গেল। দ্রুত পা চালিয়ে একটু এগিয়েই কারারক্ষী দেখল, লাশ কাঁধে যারা যাচ্ছিল তাদের কারোরই কাঁধের ওপরে মাথা নেই। কন্ধকাটা ভূত চোখের সামনে দেখে জ্ঞান হারাবে না এমন বীরপুরুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারারক্ষী বেচারাও মুহূর্তে ভূতলশায়ী হলো।

ফজলু মিঞা পুরনো ঢাকার বিত্তশালী ব্যবসায়ী। ফয়সালের কাছে আগেই শুনেছিলাম, তার কাছে ভূতের গল্পের বেশ ভালো স্টক আছে। চমত্কার ঢাকাইয়া ভাষায় আজ তার কয়েকটি তিনি আমাদের শোনালেন। তার মধ্যে একটি আবার সাত নম্বর সেলের সাম্প্রতিক এক বাস্তব ঘটনার সঙ্গে ভূত মেশানো সুস্বাদু ককটেল। বাস্তবের ব্যাপারটি ঘটেছেও আমি এখানে আসার পর। সেটাই পাঠককে প্রথমে বলছি।
রংপুরের জাতীয় পার্টি নেতা এবং সাবেক এমপি করিমউদ্দিন ভরসার মাদকাসক্ত বড় ছেলে কবির ভরসা আপন ছোট ভাইকে খুন করে যে সাত নম্বর সেলে আছে, সেটা এর মধ্যেই উল্লেখ করেছি। এক রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে আছি। হঠাত্ বিকট চিত্কার, চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে বন্ধ গারদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলাম। বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কারণ সে রাতে বিদ্যুত্ ছিল না। তবে সাংঘাতিক ধস্তাধস্তি, চেঁচামেচি যে চলছে তার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। একাধিক কারারক্ষী দৌড়ে আমাদের সেলে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে যেতেই বুঝলাম, গণ্ডগোলটা ওই দিকেই চলছে। মিনিট পনেরো বাদে দেখলাম কবির ভরসাকে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাকে জেল হাসপাতালে রেখে আমাদের সেলের কারারক্ষী ফিরে এসে পুরো ঘটনাটি বলল। ঘটনার রাতে সেলে কবির ভরসার সঙ্গে আনোয়ার এবং ভাগ্নে মনির নামে আরও দু’জন বন্দি ছিল। তিনজনই ঘুমিয়ে আছে। হঠাত্ ভাগ্নে মনির দেখে, কবির ভরসা তার ওপর চেপে বসে ড্রাকুলার মতো গলা কামড়ে ধরার উপক্রম করেছে। চোখ খুলে সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখেই মনির আতঙ্কে চিত্কার করে উঠলে আনোয়ারেরও ঘুম ভেঙে যায়। তারপর শুরু হয় কবির ভরসার সঙ্গে বাকি দু’জনার ধস্তাধস্তি। এর মধ্যে কারারক্ষীরাও লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসে। গারদের তালা খুলে তারাও তখন সম্পূর্ণ উন্মত্ত কবিরকে সামলানোর চেষ্টায় শামিল হয়। তারপর সবাই মিলে তাকে বশে এনে সে রাতের মতো জেল হাসপাতালে নিয়ে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে অচেতন করে ফেলে রাখে।
এদিকে মনির নাকি তখনও ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। ফজলু মিঞার আজকের গল্পের পূর্ব পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, পুরো ঘটনাটি অতিরিক্ত মাদকসেবন সংক্রান্ত। কিন্তু, ফজলু মিঞা দাবি করে বসল ঘটনার রাতে বারোটার দিকে সাদা কাপড়ে আবৃত এক মূর্তিকে সাত নম্বর সেলের বারান্দা দিয়ে সে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে। অত রাতে কারারক্ষী ছাড়া জেলখানায় আর কারও পক্ষে হাঁটাহাঁটি করা সম্ভব নয়। কারারক্ষী যেহেতু ইউনিফর্ম পরিহিত থাকে, কাজেই সাদা কাপড়ে ঢাকা মূর্তি আর যেই হোক কারারক্ষী হতে পারে না। ফজলু মিয়ার স্বচক্ষে দেখার দাবি বিনা প্রতিবাদে মানতে হলে সাত নম্বর সেলে ভূতের অস্তিত্বও স্বীকার করতে হয়। স্বচক্ষে ভূত দেখার দাবিদারের সামনে আমি শুধু দুর্বলভাবে বললাম, আমার ঘরের তালা তো সবার শেষে লাগানো হয়। অনেক রাতেই সেলের আঙিনায় আমি একা একা হাঁটাহাঁটি করি, ভূতের সঙ্গে মোলাকাত তো এখনও হলো না। বলাই বাহুল্য ফজলু মিঞা আমার মন্তব্যের কোনো জবাব দেয়ার প্রয়োজন দেখলেন না। তার এক কথা, কবির ভরসাকে সে রাতে অবশ্যই ভূতে ধরেছিল। মনে মনে ভাবলাম, আজ রাত থেকে আরও দীর্ঘ সময় একা একা বারান্দায় কাটাতে হবে। ভূত বাবাজির দেখা পেলে তার সুখ-দুঃখের গল্প শুনতেও মন্দ লাগবে না।
দ্বিতীয় গল্পটি কনডেম সেল অর্থাত্ ফাঁসির আসামিরা যেখানে থাকে, সেই ৮ নম্বর সেলের ভূত সম্পর্কিত। ফজলু মিয়া তখন সেই কনডেম সেলের কাছাকাছি কোনো এক সেলে থাকতেন। এক রাতে তার ঘুম আসছিল না। গভীর রাতে তিনি হঠাত্ দেখলেন, এক বিশাল সাদা রংয়ের বিড়াল সেলের আঙিনায় বসে আছে। তিনি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখের সামনে সেই সাদা রংয়ের বিড়াল অবগুণ্ঠিত মহিলাতে রূপান্তরিত হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে সেল থেকে বেরিয়ে গেল। পরের গল্পও যথেষ্ট লোমহর্ষক। তবে এবারের ঘটনাটির চাক্ষুস দর্শক জেলের এক মিঞা সাহেব অর্থাত্ কারারক্ষী। গভীর রাতে সেই মিঞা সাহেব ডিউটি দিচ্ছে। এমন সময় তার মনে হলো, দূরে সেই কনডেম সেলের কাছাকাছি কাঁধে লাশ নিয়ে কয়েকজন নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। জেলখানায় এত রাতে লাশ কাঁধে নিয়ে চলা এক অসম্ভব ঘটনা। কারারক্ষীটি হাঁক দিতেই খাটিয়া বহনকারীরা থেমে গেল। দ্রুত পা চালিয়ে একটু এগিয়েই কারারক্ষী দেখল, লাশ কাঁধে যারা যাচ্ছিল তাদের কারোরই কাঁধের ওপরে মাথা নেই। কন্ধকাটা ভূত চোখের সামনে দেখে জ্ঞান হারাবে না এমন বীরপুরুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারারক্ষী বেচারাও মুহূর্তে ভূতলশায়ী হলো।
ফজলু মিয়ার সঙ্গে এবার গল্পে যোগ দিল দীর্ঘদিন মার্কিন মুলুকে কাটানো এবং সে দেশেরই নাগরিক ফয়সাল আনসারী। তার কাহিনীকে ঠিক ভূতের বলা যাবে না, তবে ভৌতিক নিঃসন্দেহে। ফয়সালও বছর তিনেক কনডেম সেলে ছিল। সেই সময় দুটো বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী সে নিজে। দুটো ঘটনারই পরিণতি কারারক্ষীর আকস্মিক করুণ মৃত্যুতে। প্রথমজন ভরদুপুরে ডিউটিরত অবস্থায় বুকে হাত দিয়ে সেলের প্রধান ফটকের দিকে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টায় দুই-এক পা এগিয়েই মাটিতে পড়ে যায়। অন্য কারারক্ষী এগিয়ে এসে দেখে ততক্ষণে তার নাক-মুখ দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হাসপাতালে নেয়ার পর সেই কারারক্ষী মারা যায়। দ্বিতীয় ঘটনার সময় এবং স্থান অভিন্ন। তবে, এবারের মৃত্যু আরও আকস্মিক এবং দ্রুত। কারারক্ষীটি হঠাত্ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লে সহকর্মীরা এসে দেখে, সে ততক্ষণে মারা গেছে। চিকিত্সাশাস্ত্রে দুই ঘটনারই নিশ্চয়ই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা রয়েছে। হয়তো প্রথমজন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে এবং দ্বিতীয়জন হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু, কনডেম সেলের মতো এমনিতেই ভীতিকর জায়গায় পর পর দুটো আকস্মিক মৃত্যুতে অতিপ্রাকৃত গল্পের ডাল-পালা গজানোটাই স্বাভাবিক। আমাদের সাত নম্বর সেলের কারারক্ষী এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে ফজলু মিঞা আর ফয়সালের গল্প শুনছিল। এবার সে বলে উঠলো, জেলে ভূত আছে কিনা জানি না, তবে বাবা মাক্কুশাহ্ আছেন, তিনি আমাদের গরিব কারারক্ষীদের বড় মায়া করেন। আমি জানতে চাইলাম, মাক্কুশাহ্ আবার কে?
নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগার ঘেঁষে একটা মাজার রয়েছে। ছাত্র জীবনে পুরনো ঢাকা থেকে এই রাস্তা দিয়েই রিকশা করে পলাশীর বুয়েট যাওয়ার পথে মাজারটি একাধিকবার চোখে পড়েছে। আজ শুনলাম, ওই মাজারটি একজন কামেল সাধকের এবং তারই নাম বাবা মাক্কুশাহ্ (র.)। কিংবদন্তি রয়েছে যে, ব্রিটিশ আমলে এই জেল তৈরির সময় মাজারটি ভাঙার প্রাণপণ চেষ্টা সফল হয়নি। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, আমি দেখেছি কারারক্ষী এবং বন্দিরা ওই মাজারে শায়িত অজানা ব্যক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে।
দরিদ্র কারারক্ষীদের প্রতি কেমন করে বাবা মাক্কুশাহ্ তার মমতা প্রদর্শন করেন, সেই গল্প শুনলাম কারারক্ষীটির কাছ থেকে। কারারক্ষীদের জীবন বড় কষ্টের। একে তো বেতন কম, তদুপরি হাড়-ভাঙা খাটুনি। ঘুমের সময়েরও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। হয়তো রাত নটায় ডিউটি শেষ করে ব্যারাকে ফিরে গোসল, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবে একটু শুয়েছে, পেয়াদা গিয়ে হাজির। রাত বারটা অথবা তিনটা থেকে আবার তিন-ঘণ্টার ডিউটি করতে হবে। বছরের পর বছর এই কাজ করে বেচারা কারারক্ষীরা যে বাঁচে কী করে, সেটাই প্রশ্ন। মানুষের শরীর তো, তাই গভীর রাতে ডিউটিরত অবস্থাতেই কারারক্ষীরা কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়ে।
সুবেদার, ডেপুটি জেলার, জেলার রাতে এই সময় ঘুমন্ত কারারক্ষীদের ধরার জন্য মাঝে-মধ্যে রাউন্ডে বার হয়। ধরা পড়লে কঠোর সাজা তো আছেই, সেই সঙ্গে সার্ভিস-বুকে চিরস্থায়ী কালো দাগ। কারারক্ষীদের মধ্যে অনেকেরই বিশ্বাস, গভীর নিশীথে জেলখানার বড় সাহেবরা ঘুমন্ত কারারক্ষীদের হাতে-নাতে ধরে যাতে রিজিকের ক্ষতি করতে না পারে, সেই জন্য আলতো স্পর্শে বিপদ ঘটার আগেই তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেন বাবা মাক্কুশাহ্। অনেক কারারক্ষী নাকি কাঁচা ঘুম ভেঙে দেখেছে দূরে ছায়ার মতো কেউ হেঁটে যাচ্ছেন। আমার পক্ষে ভূতের গল্পের মতোই এই গল্পেও বিশ্বাস-স্থাপন কষ্টসাধ্য হলেও কারারক্ষীর চোখে-মুখে গভীর বিশ্বাসের অভিব্যক্তি দেখে আর তর্ক করতে মন চাইল না। শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে একজন শান্তি পেলে সেই শান্তি নস্যাত্ করার কোনো অধিকার তো আমার নেই। তাছাড়া আল্লাহর এই পরম বিস্ময়কর মহাজাগতিক সৃষ্টির কীইবা আমি জানি? গল্প করতে করতে কখন দুটো বেজে গেছে খেয়ালই করিনি। সেবক সালাহউদ্দিন মধ্যাহ্নভোজনের তাড়া দিতেই আমাদের আড্ডা ভঙ্গ হলো। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রশাসন এবং ‘স্বাধীন বিচারবিভাগ’ যৌথ অপারেশন চালিয়ে আমার দীর্ঘ জেলবাসের বন্দোবস্ত করেছে। নতুন করে কোনো মামলায় সাজা না হলেও ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত তো এখানে থাকছি। এর মধ্যে জেলখানার ভূত অথবা বাবা মাক্কুশাহ্র সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হয়েও যেতে পারে। সেই বাসনা নিয়েই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আড্ডা ভেঙে আপন সেলে ঢুকলাম।

No comments

Powered by Blogger.