১৮- সহকর্মীদের বললাম জেল আমি একাই খাটবো : যে কোনো মূল্যে আমার দেশ চালু রাখতে হবে

জেল আমি একাই খাটবো
আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলাম, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছাপার অপরাধে আমি কোনো অবস্থাতেই ক্ষমা চাইব না। পত্রিকার সহকর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তারাও চাইবেন না। আমি অমত করে তাদের বোঝালাম, সবাই মিলে জেলে গেলে স্বাধীন সাংবাদিকতার মহান আদর্শ হয়তো সমুন্নত রাখা যাবে; কিন্তু পত্রিকা চালানো কঠিন হবে। অতএব, জেল খাটতে হয়, সবার পক্ষ থেকে আমি একাই খাটবো। আমার সহকর্মীদের যে কোনোভাবে আমার দেশ-এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে হবে ...

আজ জুলাই ছয়, আমার জন্মদিন। সাতান্ন বছরের পরিণত জীবনে এমন বিচিত্র জন্মদিন কখনও আসেনি। পুরনো ঢাকায় মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী নানার ভাড়া করা বাড়িতে যখন জন্মেছিলাম, আমার মা তখনও ম্যাট্রিকের গণ্ডি পার হননি। তারপর অবশ্য আমাকে মানুষ করার পাশাপাশি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সাহসী নারীর সে এক দীর্ঘ জীবন-সংগ্রামের কাহিনী। ফজরের নামাজে আমার সেই মা এবং জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত একাকী স্ত্রীর হেফাজতের জন্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালাম। ভোরের গোসল শেষে অন্যদিন লুঙ্গি আর শার্ট পরলেও আজ পরিষ্কার পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে ফয়সালের সঙ্গে চা-পর্বে যোগ দিলাম। একটু আশ্চর্য হয়েই ফয়সাল আজ আদালতে আমার হাজিরা আছে কি-না জানতে চাইলে ঈষত্ হেসে মাথা নাড়ালাম। একটু রহস্য সৃষ্টি করে বললাম, আজ একটু সেজে-গুজে থাকতে ইচ্ছে হলো।
জন্মদিন হলেও আপনজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, আমিই তাদের জেলগেটে আসতে নিষেধ করে এসেছিলাম। তবে পারভীন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে যেভাবেই হোক কার্ড যে পাঠাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। বিকেলে সেই প্রতীক্ষার পালা শেষ হলো। জেল অফিসের রাইটার বাসা থেকে পাঠানো নতুন কাপড়, মিষ্টি, ফল এবং আকাঙ্ক্ষিত কার্ড নিয়ে এলে মনে হলো জন্মদিন আমার পূর্ণ হলো। সেলে ঢুকে আগে কার্ডগুলো একে একে খুললাম। বাল্যবন্ধু বাবলু, ছোট বোনসম বন্ধুস্ত্রী বেলী এবং ওদের একমাত্র মেয়ে সারাহ্’র কার্ড পেলাম। মায়েদের যুগে কার্ডের খুব একটা চল ছিল না। এবার দেখলাম আমার মাও পাঠিয়েছেন। কার্ড পেলাম না কেবল পারভীনের কাছ থেকে। প্রথমে ভেবেছিলাম, এভাবে জেল কর্তৃপক্ষের মারফত আমার স্ত্রী কার্ড পাঠাতে চায়নি। মুক্তি মিললে যদি দেখা হয় নির্জনে তখন হয়তো কার্ডখানা পাব। পরে জেনেছি, পারভীনের কার্ডের শুভেচ্ছা বক্তব্যের মধ্যে জালিম শাসকের সর্বনাশ কামনা করায় জেল কর্তৃপক্ষ সেটি আমার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। জন্মদিনের বিষণ্ন সন্ধ্যায় খবরে জানলাম, আদালত অবমাননা মামলায় সশরীরে হাজিরা দেয়ার ডাক পড়েছে খোদ আপিল বিভাগ থেকে। শুনে প্রসন্নই বোধ করলাম। এই অসাধারণ স্থান দেখার সৌভাগ্য সাধারণ জনগণের হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমার মতো আমজনতার ক্ষেত্রে সেই অসাধ্য সাধন ঘটতে চলেছে জুলাইয়ের আট তারিখে। হাইকোর্টের দু’জন আইনজীবী আদালত অবমাননার এই মামলাটি দায়ের করেছিলেন আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে। দুই আইনজীবীর এই বিশেষ উত্সাহের পেছনে আবার ছোট্ট একটি গল্প আছে।
শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতা গ্রহণ করেই তার মতো করে বিচার বিভাগ সাজিয়ে ফেলার মহত্ কর্মে রত হয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি সম্প্রতি হাইকোর্টে ১৭ জন নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই সুপারিশে অনুমোদন দিয়েছেন। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় এই ১৭ বিচারপতি কোন পক্ষভুক্ত, সেটা বোঝার জন্যে অন্তর্যামী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এদেশের বিচারব্যবস্থার সম্ভাব্য এই দণ্ড-মুণ্ডের কর্তাদের একজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে। সেই মামলায় তিনি এক নম্বর আসামি। অপর একজন তার ওকালতি জীবনে সুপ্রিমকোর্ট ভবনে বীরত্বের সঙ্গে স্বহস্তে এবং স্বপদে ভাংচুর চালিয়েছিলেন। খুনের মামলার কাহিনী এবং প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাংচুরের সচিত্র প্রতিবেদন আমার দেশ-এ ছাপা হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম উল্লিখিত দু’জনের বিচারপতি পদে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন। সেই থেকে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও তাদের হাইকোর্টে বিচারপতির আসনে বসার বিষয়টি ঝুলে আছে। স্বাধীন বিচার বিভাগের বাংলাদেশে তাদের বিচারপতি হওয়া বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে, এমন নির্বোধ প্রত্যাশা আমার অবশ্য নেই। বর্তমান প্রধান বিচারপতি কিছুদিনের মধ্যেই অবসরে যাচ্ছেন। তিনি শপথ গ্রহণ করাতে মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত যদি অসম্মতই থাকেন, তাহলে হয়তো পরবর্তী প্রধান বিচারপতিকেই এই মহত্ কার্যটি সম্পন্ন করতে হবে। তবে দু’জনাই বিচারপতি যে হবেন, এতে আমার মনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। লোকমুখে শুনেছি, আদালত অবমাননা মামলার বাদী হাইকোর্টের সম্ভাব্য বিচারপতিদ্বয়ের একজনের খুবই ঘনিষ্ঠজন। সুতরাং আমার বিরুদ্ধে তার ক্ষোভকে অসঙ্গত বলতে পারি না। বাদীর প্রসঙ্গ গেল, এবার যে সংবাদ ছাপানো নিয়ে মামলা, সে সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলি।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই নিম্ন আদালতের ওপর প্রশাসনের প্রভাবের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কমবেশি ওয়াকিবহাল। দুঃখের কথা হলো, দিনে দিনে সেই প্রভাব কমার পরিবর্তে দৃষ্টিকটুভাবে বেড়েছে। কাজেই দেশের সাধারণ নাগরিকের প্রশাসন ও নিম্ন আদালতের হয়রানি থেকে বাঁচার একমাত্র স্থল ছিল হাইকোর্ট। রাষ্ট্র ও সমাজে নানাবিধ অবক্ষয় সত্ত্বেও জনগণ একটা আস্থা অন্তত এতদিন ধরে রেখেছিল যে, হাইকোর্টে পৌঁছাতে পারলে মোটামুটি বিচার পাওয়া যায়। এক-এগারো বাংলাদেশে বেশুমার সঙ্কট সৃষ্টির পাশাপাশি উচ্চ আদালত সম্পর্কেও সাফল্যের সঙ্গে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি করতে পেরেছে। ২০০৭ সালের সেই অ্যাডভেঞ্চারের পালের গোদাদের কেবল আদালতকে নিয়ে ছেলে-খেলা করার অপরাধেই কঠোর সাজা হওয়া উচিত। রাষ্ট্রদ্রোহসহ অন্যান্য অপরাধ তো আছেই। জরুরি অবস্থার সময় হাইকোর্টের কোনো কোনো সাহসী, বিবেকবান বিচারপতি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে সেই সময় থেকে চেম্বার জজ আদালতে হাইকোর্টের রায় ‘স্টে’ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এক-এগারোর প্রদর্শিত সেই পদ্ধতি কেবল অনুসরণই করছে না, ব্যাপকতায় তাকেও বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে। এসব নিয়েই একটি তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন দুই আইনজীবী। আসামির তালিকায় আমিসহ যে পাঁচজন রয়েছেন, তারা হলেন প্রকাশক আলহাজ্ব হাসমত আলী, সিনিয়র রিপোর্টার অলিউল্লাহ নোমান, নিউজ এডিটর মুজতাহিদ ফারুকী এবং ডেপুটি এডিটর সৈয়দ আবদাল আহমদ।
আট তারিখে সকাল ন’টায় প্রিজন ভ্যান সুপ্রিমকোর্টের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। আমি খানিকটা অনিশ্চয়তায় রয়েছি। আসামিদের নিম্ন আদালতে নিয়ে তো প্রথমে কোর্ট গারদে তোলে। সুপ্রিমকোর্টে তেমন কোনো ব্যবস্থা আছে কি-না, আমার জানা নেই। এ বিষয়ে একেবারেই অনভিজ্ঞ কয়েকজন কয়েদি বলল, আমাকে নাকি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে হস্তান্তর করবে। তাতে দুশ্চিন্তা বরং বেড়েই গেল। পুলিশ সহ্য হবে, কিন্তু বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেলকে কিছুতেই সহ্য হবে না। শেষপর্যন্ত প্রিজন ভ্যান থামল অতিপরিচিত জায়গায় অর্থাত্ হাইকোর্টের মাজার পেরিয়ে আইনজীবীদের গাড়ি যেখানে থামে, সেই স্থানেই। বর্তমান সরকারের কল্যাণে জানুয়ারি মাস থেকে গ্রেফতার পর্যন্ত ছ’টি মাস বলতে গেলে হাইকোর্টেই কাটাতে হয়েছে। সেই সুযোগে প্রচুর আইনজীবীর সঙ্গে তো বটেই, উচ্চ আদালতের নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের সঙ্গেও এক প্রকার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। প্রিজন ভ্যান থেকে নামতেই পরিচিত মুখগুলো এমন সহাস্যে আমাকে সালাম এবং সমস্বরে অভ্যর্থনা জানাতে লাগল যে, ক্ষণিকের তরে ভুলে গেলাম আমি প্রায় অর্ধশত মামলার দাগী (!) আসামি। একজন জুনিয়র আইনজীবী পাশ থেকে বলে উঠলেন, মাহমুদ ভাই আপনি তো এ জায়গা চেনেনই, আমরা সোজা প্রধান বিচারপতির এজলাসে যাব। সেখানে পৌঁছেই মনে হলো আপনজনদের মধ্যে এসে পড়েছি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, আমার অনুজপ্রতিম মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবী আদিলুর রহমান খান রীতিমত শোরগোল করে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বন্দি হওয়ার পর এমন আনন্দঘন মুহূর্ত আর পাইনি। প্রথমেই আইনজীবীদের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজি সেশন। আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলাম, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছাপার অপরাধে আমি কোনো অবস্থাতেই ক্ষমা চাইব না। পত্রিকার সহকর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তারাও চাইবেন না। আমি অমত করে তাদের বোঝালাম, সবাই মিলে জেলে গেলে স্বাধীন সাংবাদিকতার মহান আদর্শ হয়তো সমুন্নত রাখা যাবে; কিন্তু পত্রিকা চালানো কঠিন হবে। অতএব, জেল খাটতে হয়, সবার পক্ষ থেকে আমি একাই খাটবো। বাক্, চিন্তা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধ করার সরকারের সব হীন চেষ্টাকে পরাভূত করে আমার সহকর্মীদের যে কোনোভাবে আমার দেশ-এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাই আমার যুক্তি মেনে নিলেন; সিদ্ধান্ত হলো তারা ক্ষমা চাইবেন।
এবার ব্যারিস্টার মওদুদ এগিয়ে এসে আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের শেষ চেষ্টা করলেন। তার যুক্তি, আমার এতগুলো মামলা রয়েছে, আপিল বিভাগের বিচারপতিরা রুষ্ট হলে সেসব মামলায় ন্যায়বিচার পেতে সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও অসংখ্য মামলার ভারে ন্যুব্জপ্রায়। তাদের স্বার্থও দেখা প্রয়োজন। ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন, জন্মাবধি আমার ঘাড়ের রগ যথেষ্ট পরিমাণে বাঁকা। মওদুদ ভাইয়ের যুক্তি প্রদর্শন সত্ত্বেও মাফ না চাওয়ার সিদ্ধান্তে আমি অটল রইলাম। মওদুদ ভাইকে বললাম, মাফই যদি চাইব তাহলে একমাত্র কলমকে সম্বল করে এক-এগারো থেকে তাবত্ বিদেশি শক্তির সমর্থনপুষ্ট অসীম ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে এই দীর্ঘ লড়াই করার মূল্য আর কি অবশিষ্ট থাকে? রফিক ভাই চুপ করে এতক্ষণ আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। তিনি এবার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন—মওদুদ, আমি মাহমুদকে কুড়ি বছর ধরে চিনি। আমি জানতাম, ও কিছুতেই মাপ চাইবে না। মওদুদ ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। এর মধ্যেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের আসন গ্রহণের সময় হয়ে গেল। আমারও দেশের লর্ডশিপদের চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হলো। আমাদের মামলার শুনানির সময় হলে ব্যারিস্টার মওদুদ দাঁড়িয়ে আমি ছাড়া অভিযুক্ত বাকি চারজনের ক্ষমা চাওয়ার কথা জানালেন। আমার পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বললেন, আমরা সময়মত শোকজের জবাব দেব। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি আর একটু খোলাসা করার জন্যে প্রশ্ন করলেন, তার অর্থ কি আপনার মক্কেল মামলা কনটেস্ট (Contest) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ব্যারিস্টার রফিক ইতিবাচক জবাব দিতেই প্রধান বিচারপতির ভ্রূ ঈষত্ কুঞ্চিত হয়ে গেল। রফিক ভাই শোকজের জবাব দেয়ার জন্য সময় প্রার্থনা করলে মামলার শুনানির পরবর্তী তারিখ আগস্টের ১২ ধার্য করা হলো। আইনজীবীদের সঙ্গে আদালত চত্বরেই আমার প্রাথমিক আলোচনার সুযোগ চাওয়া হলে প্রধান বিচারপতি সেটাও মঞ্জুর করলেন।
প্রধান বিচারপতির এজলাস থেকে বার হতেই আরেক নাটক। পুলিশ আমাকে তখনই জেলে ফিরিয়ে নিতে চায়। রফিক ভাই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, মাহমুদুর রহমান তার আইনজীবীদের সঙ্গে এক ঘণ্টা আলোচনা করে তবেই প্রিজন ভ্যানে ফিরবে। আমার অ্যাসকর্ট এবং কোর্ট পুলিশ রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আর তর্ক করার সাহস করল না। সদলবলে চললাম সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতির কক্ষের দিকে। প্রধান বিচারপতির এজলাস থেকে দূরত্ব একেবারে কম নয়। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা সেই দীর্ঘ পথে নানা বিষয়ে আমাকে অনবরত প্রশ্ন করছেন আর আমাদের ঘিরে হাঁটছেন। আসামির সংবাদমাধ্যমের কাছে বক্তব্য দেয়ার আইনগত বাধা রয়েছে। আমি বিচারাধীন মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে কেবল বললাম, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই সর্বপ্রকার নির্যাতনকে উপেক্ষা করে অব্যাহত থাকবে। বার সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের কক্ষে ঢুকে দেখি, সেখানেও সাংবাদিকরা ভিড় করে আছেন। আমাকে মাঝখানে রেখে রফিক ভাই এবং মওদুদ ভাই তাদের দু-একটি প্রশ্নের জবাব দিলেন। মওদুদ ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী আমি নিশ্চুপ বসে রইলাম। বাসা থেকে আমার জন্যে কিছু খাবার পাঠানো হয়েছিল। খাওয়ার পরিবেশ না থাকলেও সবার অনুরোধে অন্তত চোখে দেখতে হলো। সহকর্মী অলিউল্লাহ নোমান জানতে চাইল আমার স্ত্রীকে আদালতে আসতে বলবে কি-না। পারভীন এখানে এলে আমাকে অন্তত একনজর দেখে যাওয়ার সুযোগ পেত। ততক্ষণে আমার ওঠার সময় হয়েছে। তাই স্ত্রীর সঙ্গে আর সাক্ষাত্ সম্ভব হলো না। বার সভাপতির কক্ষের বাইরে এসে দেখি সাদা পোশাকের পুলিশে করিডোর ভরে গেছে। তারা সম্ভব হলে ঘরে ঢুকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সবাই বুঝতে পারলাম, ওপরের চাপ উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা আর সহ্য করতে পারছে না। বিলম্ব না করে অসংখ্য আইনজীবী ও সমসংখ্যক পুলিশ পরিবৃত হয়ে ভিড় ঠেলে অতিকষ্টে দোতলা থেকে নেমে প্রিজন ভ্যান পর্যন্ত পৌঁছালাম। ভ্যানের চারপাশে তখন সাদা পোশাকে এবং ইউনিফর্মধারী শ’খানেক পুলিশ। সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতির কক্ষে আমি যতক্ষণ রফিক ভাই এবং অন্যান্য আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, সেই সময়ের মধ্যে প্লাটুনের পর প্লাটুন অতিরিক্ত পুলিশ সুপ্রিমকোর্টে আনানো হয়েছে। তাদের শশব্যস্ত অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন আমি আর মিনিট পাঁচেক সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে অবস্থান করলেই মহাজোটের মহা পরাক্রমশালী সরকারের পতন ঘটে যাবে।
জালিম শাসকরা যে ভীরুই হয়ে থাকে, আরও একবার তার প্রমাণ পেলাম। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে ঢুকে দেখি সেখানে আগে থেকেই ওয়াকিটকি হাতে অতিরিক্ত দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা মহাবিরক্ত চেহারা নিয়ে অপেক্ষমাণ। দরজায় তালা না লাগিয়েই প্রিজন ভ্যান সুপ্রিমকোর্ট এলাকা ত্যাগ করায় বিস্ময়ের সঙ্গে খানিকটা আতঙ্কও বোধ করছিলাম। প্রিজন ভ্যান বার কাউন্সিল ভবনের সামনে এসে থেমে গেল। বাইরে কয়েক ডজন পুলিশের উত্তেজিত কণ্ঠের চিত্কার- চেঁচামেচির শব্দ পাচ্ছি। ভেতরের দুই সাদা পোশাকধারী দরজার কাছে গিয়ে খানিকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে ফিরে এলো। আন্দাজ করছি পরবর্তী করণীয় নিয়ে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আরও মিনিট দশেক অপেক্ষার পর সাদা পোশাকধারীদ্বয় নেমে গেলে প্রিজন ভ্যানের দরজায় অবশেষে তালা পড়ল। তখনও বুঝতে পারছি না আমি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে যাচ্ছি, নাকি আমাকে অন্য কোনো গুপ্তস্থানে নেয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রমনা পার্কের মোড় থেকে প্রিজন ভ্যান ইউ টার্ন নিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে যেতেই বুঝলাম নাজিমউদ্দীন রোডেই ফিরছি। জেলে ফিরে দেখলাম, সঙ্গে যে পুলিশ হাবিলদার অ্যাসকর্ট হয়ে গিয়েছিল তার চেহারাটা মলিন। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বেচারা প্রায় কেঁদে ফেলল। এর মধ্যেই তাকে নাকি সাসপেন্ড করা হয়েছে। তার অপরাধ প্রধান বিচারপতির এজলাস থেকে আমাকে সরাসরি প্রিজন ভ্যানে না তুলে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে বার সভাপতির কক্ষে যেতে দেয়া। বাংলাদেশের প্রশাসনে দরিদ্র নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারা বড়ই অসহায়। এদের ওপরেই বড় কর্তাদের যত চোটপাট। প্রধান বিচারপতি যেখানে আদেশ দিয়েছেন, আমি জেলে ফেরার আগে এক ঘণ্টা আইনজীবীদের সঙ্গে মামলা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারব, সেক্ষেত্রে একজন হাবিলদারের সেটা আটকানোর ক্ষমতা কোথায়? বেচারার দুর্ভাগ্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে স্থির করলাম, মুক্তজীবনে কখনও দেখা হলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। সাত নম্বর সেলে ফিরে দেখি আমার সব প্রতিবেশী ততক্ষণে রেডিও মারফত আমার মাফ না চাইবার গল্প জেনে গেছে। তারা আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি ফিরতেই সেলে রীতিমত হইচই করে আনন্দোল্লাস শুরু হলো। বন্দিজীবনে এই ক্ষণিক আনন্দের মূল্য অসীম।

No comments

Powered by Blogger.