২৫- টিআইবি যে বিচার বিভাগের হাঁড়ি হাটে ভাঙলো এখন তার কী হবে

টিআইবি কর্মকর্তারা আমার মতো নির্বোধ নন
...সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের ছক অনুযায়ী এক-এগারোর কুশীলবরা ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ যে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছে, সেটি ক্রমেই তার আসল চেহারা নিয়ে জনগণের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে। অবশ্য টিআইবির কর্তাব্যক্তিরা আমার মতো নির্বোধ নন। আসল জায়গার খুঁটি শক্ত না করে তারা নিশ্চয়ই বিচার বিভাগের দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করার হিম্মত দেখাননি। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, পর্দার অন্তরাল থেকে আঙ্কল স্যাম এতক্ষণে কলকাঠি নাড়তে শুরু করে দিয়েছে।...

কাশিমপুরের শীতের গল্প এতদিন শুধু পুরনো কয়েদিদের কাছে শুনেছিলাম। গত ক’দিনে টের পাচ্ছি শীত কাকে বলে। পরশু থেকে আবার জ্বরে কাহিল। জ্বরের সঙ্গে পুরনো সাইনাসের আক্রমণে নাক দিয়ে অবিরাম পানি ঝরছে। টিস্যুর বাক্স উজাড় হয়ে গেল, রুমাল আগেই ফেল মেরেছে, শেষ পর্যন্ত আদি-অকৃত্রিম গামছার শরণাপন্ন হয়েছি। কাদের ভাইয়ের (বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী) গামছার উপকারিতা জেলে এসে নানা কাজে টের পাচ্ছি। কয়েক ঘণ্টা পরপর একটা করে হিস্টাসিন ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করেও নাসিকানির্গত জলপ্রপাতে বাঁধ দেয়া তো যাচ্ছেই না, উপরি হিসেবে হিস্টাসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীর ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে।
আজ আবার শনিবার, সাপ্তাহিক দেখার দিন। গত সপ্তাহে পারভীন বলে গিয়েছিল এ সপ্তাহে ফরহাদ ভাই (কবি ফরহাদ মজহার) আর আদিলুর রহমান খান শুভ্রকে নিয়ে আসবে। অভিনয় করে হলেও ওদের সামনে শরীর সুস্থ প্রমাণ করতে হবে। অনেকটা আকস্মিকভাবেই পারভীনকে অন্য ধরনের কঠিন জীবন-সংগ্রামে নামতে হয়েছে। আমার অসুস্থতার উদ্বেগ তাকে এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবে দুর্বল করুক, এটা চাইতে পারি না। বাংলাদেশের শীতকাল আমার কাছে মনোরমই লাগে। এদেশে ক্ষমতাবান অথবা বিত্তশালীরা গ্রীষ্মকালেও স্যুট-টাই পরতে পছন্দ করেন। আর শীতকালে তো কথাই নেই। প্রতিদিন বিশ্বের নামি-দামি ব্র্যান্ডের কয়েক লাখ টাকা মূল্যের স্যুট না পরলে তাদের ইজ্জতই থাকে না।
আমার কাছে টাই বাঁধা এক বিষম ঝকমারি। বেসরকারি খাতে মোটামুটি আপন যোগ্যতায় দীর্ঘদিন উচ্চপদে চাকরি করেছি, আর সরকারে পুরোপুরি ‘চান্সে’ পাঁচ বছর অতি উচ্চ না হলেও গুরুত্বপূর্ণ পদেই ছিলাম। উভয় স্থানেই পৌষ মাসের শীতেও কেবল প্যান্ট-শার্টের ওপর দিয়েই চালানোর চেষ্টা করেছি। অথচ কাশিমপুরে পাঞ্জাবির ভেতরে উলের জামা এবং ওপরে পশমী চাদর জড়িয়েও ঠাণ্ডা সামলানো যাচ্ছে না। আর রাতে দুই কম্বল মুড়ি দিয়েও ঘুমানো মুশকিল। টয়লেট থেকে একবার ঘুরে এসে শুতে গেলে মনে হয়, এইটুকু সময়ের মধ্যেই কেউ বিছানায় ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে মামলার হাজিরা দিতে কক্সবাজার যাওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বদক্ষিণে হওয়ায় আশা করি সেখানে শীত তুলনামূলকভাবে কমই হবে। হাজিরা দিয়ে সুস্থ দেহে ফিরতে পারলে এবারের শীতকাল পার করতে পারভীনের কাছে সম্ভবত তিন নম্বর কম্বল চাইতে হবে।
জেলখানার সশ্রম কয়েদিদের নানারকম পদ রয়েছে। সেসব পদের নামও বিচিত্র। সেবক, পাহারা, মেট, রাইটার ইত্যাদি নাম দেখে কয়েদিদের স্ট্যাটাস ঠাহর করা হয়। এরা কারা অফিসসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাজ করে। প্রতি তিন মাস অন্তর তাদের আবার বদলিও করা হয়। বদলি মানে এই ওয়ার্ড থেকে ওই ওয়ার্ড আর কি! ঢাকা জেলে সর্বপ্রথম বিষয়টি জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম। আরে বাবা, সরকারি চাকুরেদেরও তো তিন বছর পর বদলি করা হয়, আর এখানে একেবারে তিন মাসেই! ঘনঘন বদলির হেতু জানতে চাইলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দুর্নীতি ঠেকানো এবং নিরাপত্তা বিধানের জন্যই নাকি জেলের এই রীতি। তিন মাসের অতিরিক্ত এক ওয়ার্ডে থাকলে কয়েদিরা ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে নানারকম বেআইনি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
কয়েদিরা অবশ্য আমার কাছে উল্টো অভিযোগ করেছে। পোস্টিং বাণিজ্য কেবল জেলের বাইরেই হয় না, ভেতরেও নাকি হয়। তিন মাস পর বদলি ঠেকাতে হলে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে হয়। এই বদলি শুধু যে কয়েদিদের হচ্ছে, তাও নয়। হাজতিদেরও একই বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। হঠাত্ এক সকালে সুবেদার হয়তো কোনো এক ওয়ার্ডে গিয়ে হুকুম দিল—সব ফাইল করো, আজ ওয়ার্ড ভাঙা হবে। ফাইল করো অর্থ হচ্ছে আসামিদের যার যার জিনিসপত্র ঘাড়ে নিয়ে ওয়ার্ডের সামনের মাঠে এসে সারিবদ্ধভাবে বসতে হয়। তারপর সুবেদার সাহেব জানাবেন, এদের মধ্যে কাকে কোন ওয়ার্ডে গিয়ে নতুন করে সংসার পাততে হবে। অনেকটা ভাড়াটিয়ার বাড়ি বদল আর কি! ছেলেবেলায় ঠেলাগাড়িতে বাসার মালপত্র তুলে কতবার যে বাসা বদল করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু ছেলেবেলায়ই বা কেন, ছাব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনেও গুলশানে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে আসার আগপর্যন্ত অন্তত বারদশেক বাড়ি পাল্টেছি।
জেলের মধ্যে ডেরা পাল্টানোর হয়রানি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সুবেদারদের সঙ্গে একটা রফায় আসা। আসামিপ্রতি শ’তিনেক টাকা খরচ করলে পরবর্তী তিন মাসের জন্য নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। যে বন্দির তিনশ’ টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই তার কপাল পুড়লো, এখন নতুন ওয়ার্ডে গিয়ে বেচারাকে খাপ খাওয়াতে হবে। এভাবেই চক্রাকারে চলছে জেলজীবন। অসাধারণ কথাশিল্পী জরাসন্ধ তার ‘লৌহকপাট’-এ বন্দিদের জীবনের অনেক রকম সুখ-দুঃখের কাহিনী লিখেছেন পরম মমতা ও মুন্সিয়ানার সঙ্গে। কিন্তু কেন যেন জেলের ভেতরের জুলুমের চিত্র তার লেখায় তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি। হয়তো প্রশাসনের লোক ছিলেন বলেই জেলকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। আমার সুবিধা হলো, আমি তো এখানে আসামি হয়ে এসেছি। আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার আগেই পাশের ওয়ার্ডের দুই রাইটার এসে হাজির। তাদের ‘কামপাস’ নিয়ে আজ সকালে ‘কেসটেবিলে’ হাজির হতে বলা হয়েছে। আজ নাকি সেই ভয়াবহ ওয়ার্ড পরিবর্তনের দিন।
আমার কাছে দুই রাইটার অনুরোধ করতে এসেছে, যাতে আমি সুপারের কাছে ওদের বর্তমান ওয়ার্ডেই রেখে দেয়ার তদবির করি। কারাগারে আমার অবস্থা যে সাধারণ বন্দিদের চেয়েও অসহায়, সেকথা ওদের বোঝানো দুষ্কর। আমার সুপারিশে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। কর্তৃপক্ষ ধরে নেবে এই দুই কয়েদির সঙ্গে আমার নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। ফলে টাকা-পয়সা খরচ করে ওদের যাও বা এখানে থেকে যাওয়ার অথবা ভালো কোনো ওয়ার্ডে বদলির সম্ভাবনা ছিল, সেটাও যাবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো ওদের ঠাঁই হবে ফাঁসির আসামির ভয়াবহ সেলে। সর্বক্ষেত্রে এতো অন্যায়-অবিচারের পরও যে রাষ্ট্র টিকে থাকে, এই এক পরম বিস্ময়।
টিআইবি গতকাল বাংলাদেশে গত তিন বছরের দুর্নীতির ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতিতে উচ্চ আদালত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই ‘কৃতিত্ব’ প্রদর্শনের পর আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগের পতনের জন্য আর কোনো গভীরতর গর্ত বোধহয় অবশিষ্ট থাকল না! ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক মন্তব্য-প্রতিবেদনে লিখেছিলাম, জেনারেল মইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এদেশের বিচার বিভাগে যে পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে তা দ্রুততর হয়ে এখন সেখান থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। টিআইবি’র প্রতিবেদন সেই পচে যাওয়া উচ্চ আদালতের দুর্গন্ধের তীব্রতা গতকাল জনগণের কাছে তুলে ধরেছে। উচ্চ আদালতের অনিয়মের সংবাদ ছাপিয়ে আমি নাকি মাননীয় বিচারপতিদের মর্যাদাহানি করেছিলাম। টিআইবি’র প্রতিবেদন প্রকাশের প্রেক্ষিতে বুঝলাম, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করলে আদালতের মান যায়, অথচ দুর্নীতি করলে সেই মান যথাস্থানে থাকে। ‘Truth is no defence’ ডকট্রিন অনুসারে আমি দীর্ঘ সাত মাস ধরে জেল খাটছি।
এখন টিআইবি যে বিচার বিভাগের হাঁড়ি হাটের একেবারে মাঝখানে ভেঙে দিল, তার কী হবে? তাহলে কি টিআইবি কর্মকর্তারাও জেলের ভাত খাবেন? সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম রাগান্বিত হয়ে আমাকে Path finder নামে অভিহিত করেছিলেন। সত্যের Path finder হতে পেরে আজ আমার প্রকৃতই গর্ববোধ হচ্ছে। আদালত নিয়ে সাহস করে লেখার সময় আমি একাকী ছিলাম। অবশেষে অন্যরাও এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। একজন মজলুমের এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। এরপর আল্লাহর কাছে তাঁর অপার রহমতের জন্য বাকি জীবন ধরে শুকরিয়া আদায় করলেও আমার কৃতজ্ঞতার যথাযথ প্রকাশ হবে না।
টিআইবির জরিপে পুলিশ বিভাগ বাংলাদেশে তিন বছরের দুর্নীতিতে রানার্সআপ হয়েছে। যে রাষ্ট্রে আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্নীতিতে প্রথম দু’টি স্থান অধিকার করে, সেখানে নাগরিকরা কতখানি জুলুমের শিকার, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি হয়েছে, তার সঙ্গে এই দুর্নীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই রাষ্ট্রব্যবস্থার খোলনলচে সম্পূর্ণভাবে বদলাতে না পারলে জনগণের ভাগ্যের উন্নতির কোনো আশা নেই। গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশ মার্কিন-ভারতের অত্যন্ত পছন্দের দুই তাঁবেদার সরকার দ্বারা শাসিত হচ্ছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যেসব কূটনীতিক দিন-রাত আমাদের সুশাসনের সবক দিতেন, তাদের কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের হোতারাও ডিজিটাল নির্বাচনের পর থেকেই গর্তে লুকিয়েছেন। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সব আয়োজন সম্ভবত সমাপ্তির পথে।
টিআইবি-বিচার বিভাগ দ্বন্দ্ব বেশ জমে উঠেছে। কুমিল্লা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এক ‘স্বাধীন’ ম্যাজিস্ট্রেট আজ সকালে টিআইবি’র চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং সিনিয়র ফেলো ওয়াহিদ আলমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে বিকেলে আবার নিজেই সেটি খারিজ করেছেন। সকাল-বিকেলের দুই পরস্পরবিরোধী আদেশের মধ্যে কোনটি নিজের ইচ্ছায় আর কোনটি ওপরের নির্দেশে দেয়া হয়েছে, সেই উটকো প্রশ্ন তাকে কোনো সাংবাদিক করার সুযোগ পাননি। চট্টগ্রাম সিএমএম আদালত মানহানির একই প্রকৃতির দু’টি মামলা আমলে নিয়ে টিআইবি’র শীর্ষ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে। ঝিনাইদহে যুবলীগের এক ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ সেখানকার টিআইবি কার্যালয়ে গিয়ে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে এসেছে।
সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের ছক অনুযায়ী এক-এগারোর কুশীলবরা ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছে, সেটি ক্রমেই তার আসল চেহারা নিয়ে জনগণের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে। অবশ্য টিআইবি’র কর্তাব্যক্তিরা আমার মতো নির্বোধ নন। আসল জায়গার খুঁটি শক্ত না করে তারা নিশ্চয়ই বিচার বিভাগের দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করার হিম্মত দেখাননি। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, পর্দার অন্তরাল থেকে আঙ্কল স্যাম এতক্ষণে কলকাঠি নাড়তে শুরু করে দিয়েছে। সরকারে তাদের প্রতিনিধি ড. গওহর রিজভী এখনও চুপচাপ বসে আছেন এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। বাজি ধরে লিখতে পারি, শেষপর্যন্ত হাফিজউদ্দিন খানদের কিছুই হবে না।
হীরার কাছ থেকে শুনলাম, বাংলাদেশে ২০১০-এর সার্বিক অবস্থার ওপর প্রচারিত প্রতিবেদনে বিবিসি রেডিওতে কাল রাতে নাকি আমার প্রসঙ্গ এসেছে। আমার গ্রেফতার ও নির্যাতন, আমার দেশ বেআইনিভাবে বন্ধ করা, আদালত অবমাননা মামলায় নজিরবিহীন সাজা ইত্যাদি সবই নাকি বিবিসি’র সান্ধ্যকালীন আয়োজনে আলোচিত হয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম, মুক্ত দুনিয়া আমাকে এতদিনে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে। যাই হোক, টিআইবি’র রিপোর্টের পর আপিল বিভাগের লর্ডশিপদের সামনে আরও একবার দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষাটা বেড়ে গেছে। এবার সুযোগ পেলে বলতাম, ক্ষমা না চাওয়ায় আপনারা এতো রাগান্বিত হয়েছিলেন; কিন্তু দেশের চ্যাম্পিয়ন দুর্নীতিবাজ সংস্থার কাছে দেশের কোনো বিবেকসম্পন্ন নাগরিক কি ক্ষমা চাইতে পারে? এরপরও আপনাদের ‘সুউচ্চ’ মর্যাদার আর কোনো কিছু কি অবশিষ্ট আছে? তবে সেই সুযোগ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। আমার সাজার মেয়াদের পাঁচ মাস চলছে। এখন পর্যন্ত রায় লেখার কোনো খবর নেই। অলিউল্লাহ নোমান যেমন রায়ের চেহারা না দেখেই সাজার মেয়াদ পূর্ণ করে জেল থেকে গেছে, আমার পরিণতিও ক্রমেই সেই দিকে যাচ্ছে।
কাল রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ছোটগল্পের সম্ভার গল্পগুচ্ছ দ্বিতীয় খণ্ড পড়ছিলাম। সেখানে ‘মেঘ ও রৌদ্র’ নামের গল্পে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আইন-আদালতের চিত্র অপূর্বভাবে ফুটে উঠেছে। গল্পের নায়ক শশীভূষণ ইংরেজ পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের জুলুমের প্রতিবাদ করায় তাকে ‘পুলিশের কর্তব্যে ব্যাঘাত’ সৃষ্টির অপরাধে পাঁচ বছরের জেল দেয়া হয়। কাকতালীয়ভাবে আমারও ৪৯টি মামলার মধ্যে দু’টি ‘পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা’ দেয়ার মামলা রয়েছে। সেই গল্প থেকে দু’টি ক্ষুদ্র অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। কবিগুরু লিখছেন :
এক. “নায়েব মহাশয় তাহার নামে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন অপরাধ ও দাবীতে নালিশ রুজু করিয়া দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া পরামর্শের জন্য শশীভূষণকে কিছু বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিলেন।”
দুই. “জেল ভালো। লোহার বেড়ি মিথ্যা কথা বলে না, কিন্তু জেলের বাহিরে যে স্বাধীনতা আছে সে আমাদিগকে প্রতারণা করিয়া বিপদে ফেলে। আর যদি সত্সঙ্গের কথা বল তো জেলের মধ্যে মিথ্যাবাদী কৃতঘ্ন কাপুরুষের সংখ্যা অল্প, কারণ স্থান পরিমিত—বাহিরে অনেক বেশী।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণিত ব্রিটিশ শাসিত বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো তফাত্ আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছি না। যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কোথায় যেন পড়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক, বিশিষ্ট পণ্ডিত প্রফেসর আনিসুজ্জামান তারও শিক্ষক। ধারণা করছি, রবীন্দ্রনাথের গল্প-গ্রন্থ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও পড়া আছে। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের নায়েবের কাছ থেকেই তিনি সম্ভবত ভিন্নমতাবলম্বীদের শায়েস্তা করার অভিপ্রায়ে জেলায় জেলায় মামলা করার কৌশলটি রপ্ত করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.