১৬- সেক্টর কমান্ডার জয়নাল আবেদিনের ভাগ্যে ডিভিশনটা আজও জোটেনি

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা
গ্রেফতার হওয়ার পরবর্তী পঁচিশ দিনের বন্দিত্বকালে চারপাশে চোখ মেলে দেখার মতো হুঁশ ছিল না। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার জন্যে জেলে আসার মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও রিমান্ডে নিয়ে আমাকে নির্যাতন করা হবে, এটা বিশ্বাস হয়নি। আওয়ামী লীগের চরিত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা যে কতখানি তীব্র, তা জেলে এসে মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার জয়নাল আবেদীনের অবস্থা দেখে আবারও উপলব্ধি করলাম...

বাংলাভাষায় জেলজীবন বিষয়ক সাহিত্যকর্মের মধ্যে জরাসন্ধের লৌহকপাট যে সর্বাধিক জনপ্রিয়, এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের আর দশজন কিশোরের মতোই স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই উপন্যাসটির সব খণ্ড পড়া হয়ে গিয়েছিল। জেলজীবনকে জরাসন্ধ দেখেছিলেন একজন জেল কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আর আমার মতো আসামি হয়ে সত্যেন সেন লিখেছিলেন রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ। যতদূর মনে পড়ে, সেই বামপন্থী রাজনীতিক ও সাহিত্যিকের উপন্যাসও পড়েছিলাম স্কুলজীবনেই।
লৌহকপাটে মানবজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার গল্প পড়ে কৈশোরের স্বপ্নিল চোখ দিয়ে জীবনকে দেখার চেষ্টা করতাম। অপরদিকে সত্যেন সেনের লেখা এক ধরনের রোম্যান্টিক বিপ্লববাদিতায় হৃদয় আচ্ছন্ন করেছিল। কিন্তু উপন্যাস পড়া আর বিপ্লবের কল্পনা করা পর্যন্তই সার। মুক্তিযুদ্ধকালীন কয়েকজন বন্ধু মিলে হাতে লিখে পত্রিকা বের করে পাকবাহিনীর নজর এড়িয়ে সদরঘাটের মোড়ে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে সেগুলো বিলি করা ছাড়া ছাত্রজীবনে কখনও রাজনীতির সংস্পর্শে আসিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে মন দিয়ে লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হওয়াটাই প্রধান কর্তব্য বিবেচনা করে ছাত্ররাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থেকেছি। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মুজিববাদী ছাত্রলীগ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে ঝড় তোলা জাসদই ছিল ছাত্ররাজনীতির প্রধান দুই শিবির। এর বাইরে অন্তত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৪ পর্যন্ত মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের একটা শক্ত অবস্থান ছিল। কিন্তু সিপিবি এবং মোজাফফর ন্যাপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গাঁটছড়া বাঁধার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের মধ্যে মস্কোপন্থীদের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেয়ে জাসদ একমাত্র প্রতিবাদী রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়।
বুয়েটে আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের জানুয়ারির একেবারে প্রথমে। আমি শেরেবাংলা হলে সিট পেয়েছিলাম। সে সময়ে চিন্তা-চেতনায় খানিকটা বামঘেঁষা ছিলাম বলে প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠলেও তাদের আপসকামিতায় বিরক্ত হয়ে জাসদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। তবে সে সময়ে ইউকসু’র ভিপি এবং বর্তমানে গণফোরাম নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেমের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার গ্রেফতার হওয়ার বছরখানেক আগপর্যন্ত কাশেম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। যাই হোক, বুয়েটে জাসদ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলেও সরাসরি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উত্সাহ বোধ করিনি কখনও। আজকের ক্ষমতাসীন মহাজোটভুক্ত জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বছর ছয়েক সিনিয়র ছিলেন। সে সময়ের ডাকসাইটে, বিপ্লবী জাসদ নেতার বর্তমানের মুজিব-বন্দনা শুনলে মনে হয় ভিন্ন ব্যক্তির মুখের কথা শুনছি। জাসদ সভাপতি এবং আমি কেবল একই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ভিন্ন সময়ে হলেও একই বিভাগেরও ছাত্র ছিলাম। আমরা উভয়েই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আরও একজন প্রথম সারির জাসদ ছাত্রনেতাও সে সময় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। তিনি শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ৭ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত জাসদের ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সিপাহী বিপ্লবের সমর্থনে যে বিশাল জঙ্গি মিছিল হয়েছিল, তার নেতৃত্বদানকারীরা আজ যখন মরহুম শেখ মুজিব প্রসঙ্গ উঠলে গদগদ হয়ে অশ্রুবিসর্জন করেন, তখন হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না। যা হোক, ব্যক্তিগতভাবে নিরামিষ ছাত্রজীবন কাটানোর ফলে কোনোদিন রাজনীতি সম্পৃক্ততার কারণে জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। অতঃপর দীর্ঘ পেশাজীবী জীবনের চড়াই-উতরাই পার হয়ে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে সরকারি দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেও তার পরিণতি কোনোদিন নাজিমউদ্দীন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগার হতে পারে, সেটাও চিন্তার অতীত ছিল। সরকারি দায়িত্বের সেই পাঁচ বছর কেবল নিজে দুর্নীতিমুক্ত থাকিনি, আমার সহকর্মীদেরও দুর্নীতিমুক্ত থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছি। বিনিয়োগ বোর্ড এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় বিন্দু পরিমাণ আপস করিনি। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও আমাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা ও সমর্থন করেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যেদিন স্বকর্ণে রেডিওতে তার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলাম। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তার অসাধারণ সত্ জীবনযাপন তরুণ বয়সে আমাদেরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল। চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে মিডিয়ায় দুর্নীতির ব্যাপক প্রচারণা থাকলেও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিন্নতর ছিল। জ্বালানি উপদেষ্টার কাজ করার সময় বকেয়া বিল এবং অন্যান্য অভিযোগে বিএনপি’র এমপিদের বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও একবারের জন্যেও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী আমাকে কোনো প্রশ্ন করেননি। নাইকোর বিষয়ে আমার কঠোর অবস্থানকেও বেগম খালেদা জিয়া নির্দ্বিধায় সমর্থন করেছেন। এসব কারণেই এক-এগারোর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমাকে অন্তত বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক জরুরি সরকার এবং জেনারেল মইন গংয়ের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করায় জীবনে সর্বপ্রথম জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় ২০০৭ সালে। সেই সরকারের দুই বছরের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই আমার সঙ্গে সরকারের এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলতে থাকে। ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের রাজনৈতিক দোসররা ২০০৮-এর ডিজিটাল নির্বাচনে একচেটিয়া বিজয় লাভ করলে কারাগার-জীবন অবধারিত হয়ে ওঠে। মহাজোটের ক্ষমতাগ্রহণ থেকে আমার গ্রেফতার পর্যন্ত নির্বাচিত সরকারের দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ সম্পর্কিত মার্কিন নীতি এবং ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার বিরোধিতা করে আমার লেখালেখি অব্যাহত রাখার ফলে সরকার নিশ্চিত হয়ে যায় আমাকে গ্রেফতার এবং নির্যাতন করা হলে তাদের তেমন কোনো আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়তে হবে না। বাস্তবে ঘটেও ঠিক তা-ই। আমি গ্রেফতার হওয়ার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলেও একটি জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকা সরকার কর্তৃক অন্যায়ভাবে বন্ধ এবং তার সম্পাদককে গ্রেফতার করা নিয়ে গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার ধ্বজাধারী রাষ্ট্রটির ঢাকাস্থ দূতাবাস থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। এ ধরনের ফ্যাসিবাদী আচরণ কোনো সুশীল (?) পত্রিকার ক্ষেত্রে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে করা হলে নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর হুঙ্কারে সরকারের টিকে থাকাই দায় হয়ে যেত। গ্রেফতার হওয়ার পরবর্তী পঁচিশ দিনের বন্দিত্বকালে চারপাশে চোখ মেলে দেখার মতো হুঁশ ছিল না। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার জন্য জেলে আসার মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও রিমান্ডে নিয়ে আমাকে নির্যাতন করা হবে, এটা বিশ্বাস হয়নি। চৌদ্দ দিনের রিমান্ডের যাতনা এবং দশ দিনের স্বাধীন বিচার বিভাগের নাটক মনটাকে এতটাই বিষণ্ন করে তুলেছিল যে, ওই চব্বিশ দিন আমার অস্তিত্বের বাইরের পৃথিবী অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাছে ব্যক্তির অসহায়ত্ব নিয়ে লেখালেখি করা আর নিজে প্রত্যক্ষ করার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। এ সময়ের মধ্যে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি মন জুড়ে থেকে মনঃকষ্ট বাড়িয়েছে মাত্র। জুন মাসের ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় রিমান্ড শেষে ঢাকা জেলের সাত নম্বর সেলের কুঠুরিতে ফিরে নতুন করে অনুভব করলাম এই বিশাল পৃথিবীর একেবারেই অকিঞ্চিত্কর, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হয়ে আমার জীবন্ত অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান। সেই অস্তিত্বের বিশাল অংশজুড়ে এখন সাত নম্বর সেলে আমার প্রতিবেশীরা এবং কারা প্রশাসনের ব্যক্তিরা। কারা প্রশাসন নিয়ে গল্প বলার আগে পাঠকের সঙ্গে প্রতিবেশীদের পরিচয় করানোটাই উত্তম।
নামে সাত নম্বর সেল হলেও এখানে কক্ষের সংখ্যা ছয়টি। নামকরণের সময় সেলের সংখ্যা সাত থাকলেও পরবর্তী সময়ে জেলখানার সীমানা প্রাচীর খানিকটা ভেতরে নিয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে। প্রাচীরের জায়গার সংকুলান করতে তখন সাত নম্বর সেলটিকে ভেঙে ফেলতে হয়। একটি সেল কমে গেলেও নামকরণ বদলে ফেলা সম্ভব হয়নি। কারণ সাত নম্বর সেলের একেবারে পাশে আগে থেকেই ছয় কক্ষবিশিষ্ট ছয় নম্বর সেল নির্মিত ছিল। কালক্রমে জেনেছি, ছয় নম্বর সেল একসময় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের সেল থাকলেও এখন সরকার ঘোষিত টিটি বা টপ টেররদেরই সেখানে প্রধানত জায়গা হয়। তবে আমার জেলজীবন শুরু হওয়ার আগেই সেসব টপ টেররকে কাশিমপুর কারাগারে চালানে পাঠানো হয়েছে। সেই চালানের পেছনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক জেলখানা সফরের সম্পর্ক ছিল। মাস দুয়েক আগে তিনি জাঁকজমকের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘুরে গেছেন। পাঠক আবার মনে করবেন না দলের ভিআইপিদের ভবিষ্যতের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে তিনি এখানে এসেছিলেন। প্রার্থনা করি, এক-এগারোর মতো দুর্দিন তাদের জীবনে যেন আর না আসে। আর যদি দুর্ভাগ্যক্রমে এসেও যায়, তাহলে সেই বিশেষ সময়ের মতোই বিশেষ অট্টালিকার ব্যবস্থাও আশা করি হয়ে যাবে। ফালতু কথা বলে প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ক্রোধান্বিত করার পরিবর্তে তার কারাগার দর্শনের উদ্দেশ্য বলে ফেলি। প্রধানমন্ত্রীর পিতা পাকিস্তানি আমলে ঢাকা জেলের যে কক্ষে দীর্ঘদিন বন্দি ছিলেন, সেই ঐতিহাসিক এলাকাটি এবং চরম নিন্দনীয় জেলহত্যার নির্মম শিকার চার জাতীয় নেতার স্মৃতিবিজড়িত বন্দিশালা মিলে তাদের পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই মিউজিয়াম উদ্বোধন করতেই এসেছিলেন। তার জেল পরিদর্শনকালে কারা কর্তৃপক্ষ টিটিদের এখানে রাখা নিরাপত্তার স্বার্থে সমীচীন বিবেচনা না করায় দল বেঁধে তাদের কাশিমপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়েছে। জেলের পরিভাষায় এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘চালান’ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় নম্বরের গল্প বাদ দিয়ে এবার সাত নম্বর সেলে ফিরে আসি।
সাত নম্বর সেলের এক নম্বর কক্ষের বাসিন্দা দু’জন। মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন এবং ফজলু মিঞা। মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন কেবল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাই নন, মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষপর্যায়ে তিনি মেজর জলিলের কাছ থেকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাট এবং তত্কালীন আওয়ামী নেতাদের চোরাচালান প্রতিরোধ করতে গিয়ে মেজর জলিল ছাড়া দ্বিতীয় যে সেক্টর কমান্ডার চাকরিচ্যুত এবং গ্রেফতার হয়েছিলেন, তিনিই জয়নাল আবেদিন। আশির দশকে মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সন্ত্রাসের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গোটা তিনেক মামলা ঝুলছে। বর্তমান সরকার নিজেদের সর্বক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি হিসেবে প্রচার করে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও সাবেক এই সেক্টর কমান্ডারের ভাগ্যে আজ পর্যন্ত জেলে ডিভিশনটা পর্যন্ত জোটেনি। অথচ সরকারি আইন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সব সেক্টর কমান্ডারের আদালতের নির্দেশনা ছাড়াই ডিভিশন প্রাপ্য। আওয়ামী লীগের চরিত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা যে কতখানি তীব্র, তা জেলে এসে এই মুক্তিযোদ্ধার অবস্থা দেখে আবারও উপলব্ধি করলাম। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মেজর (অব.) জয়নালের লাঠিতে ভর দিয়ে গণ-টয়লেটে যাওয়া এবং চৌবাচ্চার ধারে বসে অতি কষ্টে কাপড় কাচার দৃশ্য আমাকে বড় বেদনা দেয়। জয়নাল ভাইয়ের সেলমেট আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ফজলু মিঞা হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি। পুরনো ঢাকার অর্থশালী ব্যবসায়ী লোকটির হাঁপানির অসুখ রয়েছে। রাতে আমার ঘর থেকেই তার কাশির আওয়াজ অনবরত শুনতে পাই। এই ক’দিনেই টের পেয়ে গেছি অর্থ এবং রাজনৈতিক সংযোগের জোরে জেলখানায় ফজলু মিঞার যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। লোকটি মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিনকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকবার উল্লেখ করেছি, দুই নম্বর কক্ষে আমার আশ্রয় মিলেছে। তিন নম্বর ঘরে তিনজন থাকে। একজনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বাবু (সিনিয়র) যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অস্ত্র মামলায় জেলে এসেছে। রিমান্ডে নানারকম নির্যাতনের গল্প জেলে এসে ওর কাছ থেকেই প্রথম শুনেছি। দ্বিতীয় আসামির নামও বাবু। তবে সে হোন্ডা বাবু নামেই বেশি পরিচিত। জেলে তারও প্রভাব-প্রতিপত্তি চোখে-পড়ার মতো। এখন পর্যন্ত টিটিতে প্রমোশন না হলেও এলাকার উঠতি সন্ত্রাসী। যথেষ্ট সুদর্শন তরুণটি এই পথে না এসে এফডিসিতে ঘোরাঘুরি করলে সম্ভবত বাংলাদেশের অনেক নায়কের ভাত মেরে দিত। দুই বাবুই হাজতি হলেও তাদের রুমমেট একজন কয়েদি। হাজতি আর কয়েদির পার্থক্যটা এখনও বয়ান করা হয়নি। আদালতে সাজা না হওয়া পর্যন্ত বিচারাধীন বন্দিকে জেলে হাজতি বলা হয়। যেমন আমি এখন পর্যন্ত হাজতি। মামলায় সাজা হওয়ামাত্র হাজতিদের কয়েদিতে প্রমোশন হয়। তিন নম্বর ঘরের কয়েদি ছেলেটির নাম মনির। সর্বাঙ্গে ভয়াবহ সব আঘাতের চিহ্ন তার অতীত সন্ত্রাসী জীবনের সাক্ষ্য দিচ্ছে। একটি কব্জি প্রায় বিচ্ছিন্ন। অপারেশন করে কোনো রকমে জোড়া লাগানো হয়েছে। অপরাধ জগতে তার সম্ভবত একজন বিখ্যাত মামা রয়েছে, যে কারণে সাত নম্বর সেলে তার পরিচিতি ভাগ্নে মনির নামে।
চার এবং পাঁচ নম্বর কক্ষে যথাক্রমে দু’জন এবং একজন করে বন্দি। চার নম্বরে আছে রংপুর জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও শিল্পপতি করিমউদ্দিন ভরসার বড় ছেলে। সে তার আপন ছোট ভাইকে টাকা-পয়সা সংক্রান্ত ঝগড়ার পরিণতিতে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করে জেলে এসেছে। দেখলেই বোঝা যায়, বিত্তশালী পিতার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেটি ভয়াবহ রকম নেশাগ্রস্ত। দীর্ঘদেহী তরুণটি ভীতিকর, অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টি নিয়ে সেলের সবার দিকে তাকিয়ে থাকে; কিন্তু বাক্যালাপ করে কদাচিত্। স্বল্প সময়ের কারাজীবনেই জেনে গেছি এখানেও নাকি এই ধনীপুত্রকে নেশাদ্রব্য ইয়াবা সরবরাহ করার লোকজন রয়েছে। করিমউদ্দিন ভরসার ছেলের রুমমেট আনোয়ার অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে এসেছে। কারওয়ান বাজার এলাকার তরুণটি নিম্ন আদালতে জামিনের চেষ্টায় রয়েছে। পাঁচ নম্বর ঘরের বাসিন্দা ফয়সাল আনসারী। বাংলাদেশে জন্মলাভকারী মধ্যবয়সী মার্কিন এই নাগরিক তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুকে হত্যার অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তার নিহত বন্ধুটিও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ছিল। হত্যাকাণ্ডটি শেখ হাসিনার আগেকার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় ঢাকায় সংঘটিত হয়েছিল। সে গ্রেফতার হয়েছিল সম্ভবত ২০০০ সালে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের একেবারে শেষে এসে নিম্ন আদালতে তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়। জেনারেল মইনের আমলে ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। দশ বছরের বেশি জেল খাটা হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির ক্ষমা অথবা অন্য কোনো উপায়ে জামিনের চেষ্টা করছে। মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন এবং ফয়সাল আনসারীর সঙ্গে গল্পগুজব করেই আমার প্রধানত সময় কাটছে। সাত নম্বর সেলের শেষ ঘরটিতে যে তিনজন আসামি থাকে, তারা সবাই হাজতি। এদের মধ্যে একজন মুক্তজীবনে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের মাঝারি পর্যায়ের নেতা ছিল। একমাত্র তার সঙ্গেই করিমউদ্দিন ভরসার পুত্রের বন্ধুত্ব। সেলের লোকজনের ঘোরতর সন্দেহ, এই বন্ধুত্বের পেছনে নেশার ব্যাপারটাই ক্রিয়াশীল। সাত নম্বর সেলে আমাদের এই বারো জনেরই ঘরবসতি।

No comments

Powered by Blogger.