২- দরজার ওপারে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র আর এপারে সাংবাদিকদের ক্যামেরা

দাঙ্গা পুলিশের এগারোতলার দিকে ধেয়ে আসা এবং আমার আসন্ন গ্রেফতার নিয়ে আমি কোনো উদ্বেগ অনুভব করছিলাম না। কিন্তু আমার দেশ যে পরদিন পাঠকের কাছে পৌঁছানো গেল না, এ কারণে উপস্থিত সবাই বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। আমার দেশ নিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের এই সম্পূর্ণ আইনবিরোধী কার্যকলাপ যে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিচার বিভাগেও শেষ পর্যন্ত টেকানো যাবে না, আমার মনে এই দৃঢ়বিশ্বাস সত্ত্বেও এতগুলো সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় বড় বিষণ্ন বোধ করতে লাগলাম।
এর মধ্যে পত্রিকার সকল সহকর্মী তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের কথা আমাকে জানাতে এলেন। তারা নিজেদের মধ্যে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমটি, আমার সঙ্গে গণগ্রেফতার বরণ করবেন এবং দ্বিতীয়টি, কোনো পরিস্থিতিতেই ফজরের নামাজের আগে আমাকে গ্রেফতার হতে দেবেন না। বিদেশি প্রভুদের অন্ধ সমর্থনে যে বেপরোয়া সরকার ক্রমেই গুম-খুনে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠছে, তাদের হাতে রাতের অন্ধকারে আমাকে কোনো অবস্থাতেই সমর্পণ করা হবে না। সহকর্মীদের এমন ভালোবাসার প্রকাশে চোখ শুকনো রাখব এমন সাধ্য কই? এদিকে এগারোতলায় তখন খাদ্য ও পানির সঙ্কট চলছে। নিচতলায় পুলিশের অবরোধের মধ্য দিয়ে কারও পক্ষে হেঁটেও উপরে ওঠা সম্ভব নয়। সরকার আমাদের ভাতে এবং পানিতে মারার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। রাত ১২টার মধ্যে এগারোতলার প্রবেশদ্বারের বাইরেটা সাদা পোশাকধারী এবং দাঙ্গা পুলিশে ভরে গেছে। দরজার ওপারে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র আর এপারে সাংবাদিকদের হাতে হাতে ক্যামেরা। এ এক অসম লড়াই।
সন্ধ্যা থেকে আমার অফিসে উপস্থিত ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি এবং অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজলকে অনুরোধ করলাম ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্যে, যাতে সাংবাদিকরা কেউ হতাহত না হয়ে আমার গ্রেফতারপর্ব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যায়। তারা প্রশ্ন করে জানলেন পুলিশের কাছে আদালতের কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নেই। ঢাকার জেলা প্রশাসক উপরের নির্দেশে রাত ১০টা পর্যন্ত তার কার্যালয় ‘বিশেষ প্রয়োজনে’ খোলা রেখে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের যে আদেশনামায় স্বাক্ষর করেছেন, তার কোনো অনুলিপি পর্যন্ত নেই। আছে কেবল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় হাসমত আলীর দায়ের করা কথিত এজাহার। আগেই উল্লেখ করেছি, দুপুর দুটো পর্যন্ত এনএসআই কার্যালয়ে হাসমত আলীকে আটকে রেখে দুটি কাগজে সই নেয়া হয়েছিল। তারই একটি গেছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। কোনো থানায় এজাহার দায়ের করতে হলে অভিযোগকারীকে সেখানে উপস্থিত হয়ে জিডি অথবা এফআইআর রুজু করা আইনত বাধ্যতামূলক। হাসমত আলী তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সারাদিনের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন এমন দাবি আমাকে গ্রেফতার করতে আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ করেননি। এদেশে আদালত থেকে জারি করা হাজার হাজার গ্রেফতারি পরোয়ানা মাসের পর মাস কোর্টে এবং থানায় পড়ে থাকে। বিশেষ তদবির ছাড়া সেগুলো বাস্তবায়নে পুলিশের কোনো আগ্রহ থাকে না। অথচ আমার ক্ষেত্রে একটি বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করামাত্র শত শত পুলিশ কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই জামিনযোগ্য ধারার মামলায় কোর্টের নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই গ্রেফতারের জন্যে ছুটে এসেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা পুরো অপারেশন মনিটর করছে। হয়তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন তত্পর হলে দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোনো সমস্যাই হতো না।
প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদকে ফোন করলাম। তিনিই যে আমাকে এই পত্রিকাটি রক্ষার জন্যে অনেকটা জোর করে মিডিয়া জগতে নিয়ে এসেছিলেন, সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার অবর্তমানে পত্রিকা দেখা-শোনার দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানালাম। তার এবং তার স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও আমার অনুরোধ সামাদ ভাই ফেললেন না। কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম।
রাত ১টার দিকে বাসা থেকে ফোন এলো। মা এবং স্ত্রীর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিলাম। পুরনো ঢাকা থেকে শেফালী নামের আমার এক খালা সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেণ্ডারিয়ায় আমরা একসঙ্গে থাকতাম। তিনিও অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে আমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে বিদায় জানালেন। আমার মা সমস্তটা জীবন শিক্ষকতা করে একমাত্র সন্তানকে মানুষ করেছেন। তিনি জানেন বিনা অপরাধে জালিম সরকারের পুলিশ তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। সেই নৈতিক শক্তিতেই বোধহয় সেই দুঃখিনী মা নিষ্কম্প গলায় আমাকে মাথা উঁচু করে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে সাহস জোগালেন। শাশুড়ি এবং খালা-শাশুড়ির সামনে টেলিফোনে কথা বলার সময় আমার স্ত্রীর যথাসাধ্য আবেগ চেপে রাখার চেষ্টা বুকফাটা কান্নার চেয়েও করুণ শোনাল। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তাকে তেমন একটা সময় দিইনি। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। আর আজ চলেছি অজানার উদ্দেশে। কবে আবার দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কি-না জানা নেই। আমার ঘরভর্তি সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী। বিদায়ের মুহূর্তে নিজের আবেগ নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করব এমন পরিবেশ নেই। মাকে দেখার ভার স্ত্রীর কাঁধে অর্পণ করে মনে মনে ভাবলাম—ওর দায়িত্ব দেব সেই মানুষ কই? আমাদের সন্তান নেই, ওর কোনো ভাই নেই। পিতা থাকলেও অনেক বয়স হয়েছে। কন্যাকে দেখার জন্যে তার আর কত সময় অবশিষ্ট রয়েছে, সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। এবার সহকর্মীদের ডেকে আমাকে বিদায় দেয়ার অনুরোধ জানালাম। কিন্তু তারা কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। আমার পরম সুহৃদ, অগ্রজপ্রতিম কবি ফরহাদ মজহার সেই সন্ধ্যা থেকে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল সোহেল, ব্যক্তিগত সচিব শিমুল বিশ্বাস, শাম্মী আখতার এমপি এবং আরও পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দীর্ঘক্ষণ ধরে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। সবারই অভিন্ন বক্তব্য, এই রাতের আঁধারে আমার গ্রেফতার হওয়া নিরাপদ নয়। ক্রসফায়ার এবং গুম-খুন যে রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য আচরণ, সেখানে ফজরের নামাজের আগে আমার কোনো অবস্থাতেই যাওয়া চলবে না। সহকর্মী সাংবাদিকরা আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সম্পাদকের দরজা আগলে ঘরের বাইরে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে পড়ল। ওদিকে মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে পুলিশের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। রাত ৩টায় বিবিসি থেকে ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলাম। বেশ কিছুদিন ধরে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির সংবাদ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচারে ক্ষমতাসীনদের প্রতি পক্ষপাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারে প্রিন্ট মিডিয়ায় যে বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানেও আমার দেশ পত্রিকার জন্যে বরাদ্দ প্রায় থাকে না বললেই চলে। কিন্তু ফোনের ওপারের মহিলার কণ্ঠস্বর এবং প্রশ্ন করার ধরন আজ যথেষ্ট সহানুভূতিশীল মনে হলো। ফ্যাসিবাদ ও মানবাধিকারের প্রশ্নে আমার দেশ পত্রিকার নৈতিক অবস্থান তুলে ধরলাম। আমাদের অবরুদ্ধ অবস্থার যথাসম্ভব বর্ণনা দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার লড়াইয়ে বিবিসিসহ মুক্তবিশ্বের সকল গণমাধ্যম এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী মানুষের সমর্থনের আহ্বান জানালাম। সেই সাক্ষাত্কার বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। সাক্ষাত্কারপর্ব শেষ না হতেই শেষবারের জন্যে স্ত্রীর ফোন পেলাম। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশের হেফাজতে চলে যাব জানাতেই পারভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। থানায়, আদালতে কিংবা কারাগারে মা এবং সে যেন কোনোদিন আমাকে দেখতে না যায়, মিনতিভরে সেই অনুরোধ করলাম। ফ্যাসিবাদী সরকারের সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করার মতো মনোবল আমার রয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমার প্রিয়জনের অপমান সইতে পারব না। দেড় বছরের শাসনামলে প্রমাণিত হয়েছে ন্যূনতম শালীনতা, সৌজন্যবোধও এদের মধ্যে নেই। বারবার করে পারভীনকে বললাম, তোমাদের কষ্ট হবে জানি, তবু আমার এই শেষ অনুরোধটুকু রক্ষা কোরো।
নিরস্ত্র মানুষের সব বাধা শেষরাত সাড়ে ৩টার মধ্যেই ভেঙে গেল। ঘরের বাইরে চেয়ার ছুড়ে ফেলা, সাংবাদিকদের লাঠিপেটা এবং অগ্রসরমাণ বুটের আওয়াজ পেলাম। কয়েকজন বোধহয় দরজা আগলে রাখার শেষ চেষ্টা করেছিল। দাঙ্গা পুলিশের সবল ধাক্কায় সবাই ছিটকে পড়ল ঘরের ভেতরে। ডজন দুয়েক পুলিশের চাপে আমার সামনের টেবিলটা প্রায় গায়ের ওপর উঠে এলো। ফরহাদ ভাই সামান্য আহত হলে বললাম, আর নয়। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারদিক থেকে পুলিশের আগ্রাসী হাত এগিয়ে এলো আমার দিকে। সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ তখনও ফজরের নামাজ পর্যন্ত সময় চাইছে। অনুরোধ রক্ষা হবে না বুঝতে পেরে আমি কেবল শেষবারের জন্যে অজু করতে চাইলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সংলগ্ন বাথরুম থেকে অজু করে এসে বললাম, আমি তৈরি। চারদিকে অশ্রুর বন্যা। অগুনতি পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে। মুখে হাসি ধরে রেখেছি। নইলে সহকর্মীরা আরও ভেঙে পড়বে। লিফট বন্ধ হলো। চালকের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখেও পানি। লিফট নিচতলায় নামলো। সেখানেও অত রাতে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষ অপেক্ষা করে আছে। এমপি পাপিয়া, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলনেত্রী শিরিন এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সোহেলকে বোধহয় চিনতে পারলাম। তখনও স্লোগান চলছে। গাড়িবারান্দার সামনেই একটি সাদা, দরজা খোলা, মাইক্রোবাস আমার জন্যে অপেক্ষমাণ। কাছে এগোতেই ভেতর থেকে একজন হাত বাড়িয়ে সজোরে ভেতরে টেনে নিল। আমাকে মাঝখানে ঠেলে দিয়ে আরও একজন মাইক্রোবাসে উঠল। চালকের পাশেও দেখলাম অপর এক কর্মকর্তা। মুহূর্তের মধ্যে মাইক্রোবাস ছুটে চলল শেরাটন হোটেলের দিকে। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই। কেউ কোনো কথা বলছে না। জিজ্ঞাসা করাও অর্থহীন। বাংলামোটরের মোড়ে ইউটার্ন নেয়ার পর ওয়্যারলেসে কথা শুরু হলো। আবারও সোনারগাঁও হোটেল পেরিয়ে এবার উত্তরে ছুটতে লাগলাম। ছুটন্ত গাড়ির ভেতর থেকে মনে হলো বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার ইমারতের নিচতলায় তখনও বেশ লোকজন। আমাকে কি দেখতে পেয়েছে তারা? ভাবছিলাম, থানায় নিচ্ছে নাকি দেশবাসী কালই ক্রসফায়ারের মিছিলে আরও একজন বেড়ে যাওয়ার একঘেয়ে গল্প শুনবে? মিনিট দশেকের মধ্যেই জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করলাম। সঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তারা ওয়্যারলেস অথবা মোবাইল ফোনে নির্দেশ দেয়া-নেয়া ছাড়া আমার সঙ্গে একটি বাক্যও বিনিময় করেনি। ভোর ৪টার দিকে একবার ভুলের পর চালক গাড়ি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রবেশ করল। জায়গাটি অপরিচিত। আগে কখনও এখানে আসার কারণ ঘটেনি। মাইক্রোবাস থেকে নামলাম। কেউ কোনো কথা বলছে না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেই এগিয়ে গেলাম ডিউটি অফিসারের ঘরের দিকে। চেয়ার টেনে বসেও পড়লাম। ডিউটি অফিসার এবং শিল্পাঞ্চল থানা থেকে আগত আমার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আবদুল আহাদ প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় নিল পারস্পরিক কাগজপত্র লেখা এবং সই-সাবুদ সমাপ্ত করতে। ফজরের আজান শুনতেই পাশে মেঝেতে নামাজ পড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। একজন কনস্টেবল দয়াপরবশ হয়ে একটি জায়নামাজ নিয়ে এলো। নামাজ শেষ হলে আইও আহাদ দুই-একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করল। আমার গ্রেফতারে বিলম্ব নিয়ে বেশ অনুযোগও শুনলাম। কর্মকর্তাটির কথা বলার ভঙ্গি যথেষ্ট তির্যক। অভদ্র হয়তো বলা যাবে না তবে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছিল প্রতিটি বাক্যে। সাড়ে ৫টার মধ্যেই আমাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো। জীবনে প্রথমবারের মতো থানার হাজতে পা রাখলাম।
হাজতটি বেশ বড়। এক কোণে আধা-মানুষ সমান উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা প্রাতঃকৃত্যের জায়গা। পাশে ধূলি-ধূসরিত কালো রঙের ময়লা কম্বল পড়ে আছে। ওই কম্বল পেতে বসার চেয়ে নোংরা মেঝেতে বসা অনেক ভালো। যতক্ষণ শরীরে কুলায় পায়চারি করে সময় কাটানোই মনস্থ করলাম। আমার দিকে একবার তাকিয়ে ডিউটি অফিসার চলে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরে এলো একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে। তার হাতে একটা চেয়ার। গারদের তালা খুলে চেয়ারটা দিয়ে বলল—স্যার, এখানে বসে সময় কাটান। প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ জানালাম। বসার আয়োজন তো হলো। কিন্তু মশা এবং ভ্যাপসা গরমের যুগপত্ আক্রমণে সময় কাটানো কঠিন। ডিউটি অফিসার খানিক বাদে একটা মশার কয়েল এনে গারদের লোহার দরজার ওপারে জ্বালিয়ে আমাকে বলল—স্যার, দরজার কাছে এসে বসেন, গরম এবং মশা দুটোই কম লাগবে। আমাদের গারদের ভেতরে কয়েল দেয়ার নিয়ম নেই। পুলিশ কর্মকর্তাটির সৌজন্যে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। আমাকে পাহারা দেয়ার জন্যে একজন সেন্ট্রি গারদের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। ছেলেটির সঙ্গে টুকটাক গল্প করতে করতে ৮টা বাজল। কৌতূহলবশত থানার অন্যান্য সেন্ট্রিও উঁকি দিয়ে আমাকে দেখে গেল। এর মধ্যেই ক্যান্টিন থেকে নাস্তা এলো। দুটো ছোট পরোটা, ডিমভাজি এবং লেবু দেয়া এককাপ রঙ চা। আগের রাত থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। ডিমভাজি দিয়ে একটা পরোটা এবং চা খেলাম। চায়ের স্বাদটা চমত্কার লাগল।
সময় আর কাটতে চায় না। ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হচ্ছি। গেঞ্জি-শার্ট ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। দেয়ালঘেরা প্রাতঃকৃত্যের জায়গায় গোসল হয়তো করা যেত; কিন্তু সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো কাপড় নেই। ঘামের গন্ধে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগছে। এর মধ্যেই দুপুরে ভাত খাওয়ার প্রস্তাব এলো। এ অবস্থায় খাওয়ার রুচি হলো না। আরও এককাপ লেবু চা চেয়ে খেলাম। বসে বসে ভাবছিলাম আইন অনুযায়ী তো আমাকে আজই কোর্টে হাজির করার কথা। জামিন না পাই, আপনজনরা অন্তত জানবে আমি এখনও বেঁচে আছি। পরক্ষণেই মনে হলো, এক-এগারোর সরকার অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ আদালতে সোপর্দ না করেই অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখেছিল। অসহায় আত্মীয়স্বজন তখনকার ক্ষমতাবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে প্রিয়জনের হদিসের জন্যে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সেই অবৈধ সরকারেরই ফসল। চোখ বুজে একমনে আল্লাহর কাছে সবরের প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম। বিকাল সাড়ে ৩টায় গারদের তালা খোলা হলো। শুনলাম আমাকে আদালতে নেয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যান এসেছে। প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয় সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের অপরাধে দায়ের করা মানহানি মামলার হাজিরা দিতে গ্রেফতার হওয়ার দু’সপ্তাহ আগে সিএমএম আদালতে গিয়েছিলাম। সেদিন সহকর্মী সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান সঙ্গে ছিল। আদালতে প্রিজন ভ্যানে আসামিদের গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বড় কষ্ট লেগেছিল। এক আসামির স্ত্রীকে দেখেছিলাম কোলের ছেলেটিকে উঁচু করে ধরে আছে যাতে প্রিজন ভ্যানের মধ্যে থাকা পিতা তার সন্তানকে একটু স্পষ্ট করে একনজর দেখতে পায়। দৃশ্যটি বিশ্ববিখ্যাত ‘স্পার্টাকাস’ ছবির মতো লেগেছিল, যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী, ক্রুশবিদ্ধ স্পার্টাকাসের সামনে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী সদ্যোজাত পুত্রকে দু’হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে ছিল। যতবার ছবিটি দেখেছি, অবধারিতভাবে ওই দৃশ্যে চোখে পানি এসেছে। আমি নোমানকে ভাঙাচোরা প্রিজন ভ্যানে আসামিদের অসুবিধা নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে বলেছিলাম। তখন কি জানতাম এত শিগগির আমাকেই প্রিজন ভ্যানে উঠতে হবে? ভেতরে ঢুকে দেখি বসার কোনো সুযোগ নেই। লোহার বেঞ্চের কাঠামো থাকলেও প্লাইউডের সবগুলো তক্তা ভাঙা। ভ্যানটির উচ্চতাও বেশ কম মনে হলো। ফলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুরনো ঢাকার সিএমএম কোর্ট পর্যন্ত দীর্ঘ পথ ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে থেকে পা এবং ঘাড় দুটোই ব্যথা করে ফেললাম। ভিআইপি সড়ক দিয়ে আমার দেশ পার হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল আমার সহকর্মীরা কি অফিসে আছে, নাকি ফ্যাসিবাদের পুলিশ সবাইকে বার করে দিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে? আরও একটি চিন্তা সমস্ত পথ মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমাকে যে মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, সেটি জামিনযোগ্য। অতএব চরম পক্ষপাতদুষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকেও এই মামলায় অন্তত জামিন দিতেই হবে। কিন্তু শত শত দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে এত কাণ্ড করে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই, মাত্র একরাতের জন্যে আমাকে গ্রেফতার করেননি। জামিন পাওয়া যাবে না এমন মামলা গত চব্বিশ ঘণ্টায় সম্ভবত দায়ের করা হয়েও গেছে। মামলার অভিযোগটি কী হবে, অনেক ভেবেও তার কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। বাংলাদেশের পুলিশ বানোয়াট মামলা তৈরিতে কতটা সিদ্ধহস্ত, সেটা ঠাহর পেতে আর মাত্র একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। জনসন রোড থেকে সিএমএম কোর্টের দিকে প্রিজন ভ্যান বাঁক নিতেই অসংখ্য লোকের গগনবিদারী স্লোগানের আওয়াজ শুনতে পেলাম।

No comments

Powered by Blogger.