জিএসপি রক্ষায় সরকারের জোর তৎপরতা by আবুল কাশেম

যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা টিকিয়ে রাখতে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। দেশটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদের প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে আলোচনা ও তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ককাসের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ ক্রাউলি, হোয়াইট হাউসের সিনিয়র ডিরেক্টর নিকোলাস ডিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ৪ জানুয়ারি কংগ্রেসম্যান স্যান্ডার মার্টিন লেভিনের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি। এসব আলোচনায় জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি। একইভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ১৩ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকের পর সরকারের বক্তব্য চূড়ান্ত করা হবে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ওই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়খ্যাত ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ বা ইউএসটিআরে পাঠানো হবে।
কংগ্রেসম্যান মার্টিন লেভিনের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদেরের আলোচনার একটি ফ্যাক্স বার্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এসেছে। জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরতে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আগামী ১৩ জানুয়ারি বৈঠক ডেকে গতকাল একটি নোটিশ ইস্যু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করবে- এমনটি মনে করছে না সরকার। মূলত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিই দেশটির উদ্দেশ্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও (দি আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন) দায়ের করা মামলাটির শুনানি দুই বছর পর পর হয়ে থাকে। গত বছর ২৪ জানুয়ারি শুনানি হওয়ার পর ২০১৪ সালে তা হওয়ার কথা থাকলেও আগামী মার্চেই পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করছে দেশটি। তা সত্ত্বেও দূতাবাসের মাধ্যমে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও নানা প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
কংগ্রেসম্যান মার্টিন লেভিনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে ফ্যাক্স বার্তায় একরামুল কাদের বলেছেন, এই কংগ্রেসম্যান মূলত ওয়েজ অ্যান্ড মিনস কমিটির সব ধরনের শুল্ক কর, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় গার্মেন্ট সেক্টরের উন্নয়নে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ, মজুরির বাইরে শ্রমিকদের দেওয়া স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সহায়তাসহ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন তিনি। এ ছাড়া তাজরীন ফ্যাশনসের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ সম্পর্কেও অবহিত করেন তিনি। আলোচনার সময় বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা রাষ্ট্রদূতকে জানান মার্টিন লেভিন।
ইউএসটিআরের কাছে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার বিপক্ষে যে ১২ কংগ্রেসম্যান আবেদন করেছেন, তাঁদের অন্যতম জোসেফ ক্রাউলির সঙ্গে ২১ ডিসেম্বর সাক্ষাতের পর ঢাকায় পাঠানো ফ্যাক্স বার্তায় রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, 'তখন ক্রাউলি আমাকে জানান- কয়েকজন কংগ্রেসম্যান আছেন, যাঁরা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করার পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এটা শুধু গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নয়, বরং শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম চুক্তি বা টিকফা স্বাক্ষর না করাসহ অন্য অনেক ইস্যুর সমন্বিত ফল।'
এ সুবিধা বহাল রাখতে শ্রমিক অধিকার রক্ষায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি আলোচিত টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করা ও শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত।
এদিকে জিএসপি সুবিধা বহাল রাখতে ১৩ জানুয়ারি যে বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তার জন্য ইস্যু করা নোটিশে বলা হয়েছে- 'পোশাকশিল্পে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়া এবং সর্বশেষ তাজরীন গার্মেন্ট কারখানায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে পোশাক শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ২১ ডিসেম্বর বিষয়টি পত্র মারফত জানিয়েছেন। শ্রম অধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ইউএসটিআরের প্রধান রন কির্ক সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী বরাবর একটি পত্র পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া ইপিজেড ও এর বাইরের তৈরি পোশাক শিল্প এবং মৎস্যশিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এএফএল-সিআইও ২০০৭ সালে আনা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএসটিআর অফিস সম্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার, স্থগিত বা সীমিত করার বিষয়ে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মতামত দাখিলের অনুরোধ করেছে।'
ওই সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং হিমায়িত খাদ্য ও চিংড়ি রপ্তানিকারক সমিতির প্রতিনিধিদের ডেকেছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ।

No comments

Powered by Blogger.