পিতার স্বপ্ন পূরণ করলেন কন্যা ॥ সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারী- ২৬ হাজার ১৯৩ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

শিক্ষকদের দুই দশকের আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সারাদেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষকের মহাসমাবেশে ঐতিহাসিক এ ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, এসব বেসরকারী বিদ্যালয়ের এক লাখ চার হাজার শিক্ষক সরকারী শিক্ষক হয়ে গেলেন। একই সঙ্গে আগামী ২০১৪ সালের জানুয়ারি নাগাদ দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণ জাতীয়করণেরও ঘোষণা দেন তিনি। দুই দশকের দাবি পূরণ করতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করে শিক্ষকদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, আজ আমার পিতার একটি স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হলাম। আপনাদের দীর্ঘদিনের তপস্যা আজ স্বার্থক হলো। আগামীতে সরকারী তহবিল পাবার আশায় এখন যত্রতত্র স্কুল গড়ে তুললে হবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে সরকারিভাবে। কোথায় প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে তা আমরা দেখব।
ঐতিহাসিক এ ঘোষণায় এ সময় প্যারেড স্কয়ারে নির্মিত বিশাল শামিয়ানা ছাড়িয়ে লক্ষাধিক শিক্ষক দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার ৪০ বছর পর তারই কন্যার এ ঘোষণায় আনন্দে অসংখ্য শিক্ষকের চোখে পানি এসে যায়। শিক্ষকদের ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ’ু সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো প্যারেড স্কয়ার। শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, জাতির জনকের ঘোষণার এত বছর পর আজ আপনি দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভাবলেন। এ ঋণ আমরা কোন দিন ভুলব না। অনেক কষ্ট করেছি। এখন সংসার চলবে। সম্মান নিয়ে বাচঁতেও পারব। শেখের বেটিকে (প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে প্রথমেই সংগঠনের মহাসচিব এম মুনছুর আলী স্বাগত বক্তৃব্য রাখেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দীন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিন ধাপে ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয়ে কর্মরত এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষক সরকারী শিক্ষক হবেন। তবে ঘোষণা আজই। এর মধ্যে চলতি ১ জানুয়ারি থেকেই ২২ হাজার ৯৮১টি নিবন্ধিত (এমপিওভুক্ত) বিদ্যালয়েরে ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। স্থায়ী-অস্থায়ী পাঠদানের অনুমতি পাওয়া, কমিউনিটি এবং সরকারী অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষক আগামী ১ জুলাই থেকে এ সুবিধা পাবেন। সর্বশেষ তৃতীয় স্তর আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত ও পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষমাণ ৮৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। শেখ হাসিনা শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা চেয়েছিলেন শুধু রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ। আমরা যে শুধু এমপিওভুক্ত রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করছি তা নয়। আমরা স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিও বহির্ভূত কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরকারী অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এনজিও বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত বিদ্যালয় এবং স্থাপিত কিন্তু চালুর অনুমতির অপেক্ষাধীন বিদ্যালয়সমূহ সরকারী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। প্রথম ধাপের জন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হবে এক শ’ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপের জাতীয়করণের জন্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সরকারের বাড়তি ৩৭১ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ধাপে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৫১ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে।
শিক্ষকদের জাতি গড়ার মূল কারিগর অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষকরাই একটি জাতিকে গড়ে তুলতে পারেন। স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষক-কর্মচারীসহ ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জাতির পিতা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারলে, আমরা কেন পারব না। শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সালে শিক্ষকরা এই দাবিতে অনশন করেন। আন্দোলনে একজন শিক্ষক যখন মারা গেলেন তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যিনি এখনকার বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর সুগন্ধা কার্যালয়ে একটি উৎসব করছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার স্বাক্ষরতার হার বাড়িয়ে গেলেও পরে বিএনপি আমলে তা কমে যায়। এখন ভর্তির পর ঝরে পড়া রোধ করতে শিশুদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে, বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এই সরকারকে শিক্ষাবান্ধব সরকার আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় শিক্ষকদের প্রতি আন্তরিক। তাই আমরা শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। নিজ উদ্যোগে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম আরও জোরদার করার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা হাত পাততে চাই না, আত্মনির্ভরশীল হতে চাই।’ তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, শুধু পড়ালেই হবে না। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। এবার ২৭ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে- জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে অনেক মা-বাবা বই কিনতে পারত না। আমরা বিনামূল্যে বই দিচ্ছি। এটা কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষেই সম্ভব। এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৭২০টি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শাখা খোলা হয়েছে। চলতি বছর থেকে শতভাগ বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে। তিনি বলেন, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে মূল বেতনের ১০০ শতাংশ প্রদান করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, চাকরি জাতীয়করণ রেজিস্টার্ড বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকদের বহুদিনের দাবি। আমরা জানি, এর একটা যৌক্তিকতা রয়েছে। তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু আপনারা জানেন, এজন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখন সরকারী হয়ে গেছে বলে স্কুলে না গিয়ে বাসায় বসে থাকবেন- তা হবে না। আপনাদের মনে রাখতে হবে, আপনারা যে টাকা পাচ্ছেন তা জনগণের টাকা। আমি আশা করছি, আপনাদের প্রতি সরকারের এ আন্তরিকতার প্রতিদান দিতে আপনারা আপনাদের সর্বোচ্চ শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন।
বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয়করণের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই সমিতি বিলুপ্ত হলো। এই সমিতির সকল সদস্য এখন থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সদস্য। তিনি শিক্ষকদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করার অনুরোধ জানান। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন বলেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ওই সময় এসব বিদ্যালয়ের এক লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষককের চাকরি সরকারী হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরও এক হাজার ৫০৭টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঐতিহাসিক ঘোষণা দিলেন। প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন বলেন, শিক্ষকদের প্রায় দুই দশকের আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরিসমাপ্তি ঘটল আজ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এতবড় কাজ কেবল বঙ্গবন্ধুর কন্যার পক্ষেই সম্ভব। এদিকে ঐতিহাসিক এ ঘোষণায় এ সময় প্যারেড স্কয়ারে নির্মিত বিশাল শামিয়ানা ছাড়িয়ে লক্ষাধিক শিক্ষক দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। শিক্ষকদের ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ’ু সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো প্যারেড স্কয়ার। সাতক্ষীরার আশাশুনী উপজেলার হরিয়াটি উত্তরপাড়া রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পঞ্চানন কুমার ম-ল। আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না। বলছিলেন, অনেক কষ্ট করেছি। এখন সংসার চলবে। সম্মান নিয়ে বাঁচতেও পারব। শেখের বেটিকে (প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ। ঝিনাইদহ থেকে এসেছিলেন শেখ মামুন। তিনি বলছিলেন, ২০ বছর শিক্ষকতা করেছি। অনেক কষ্ট, দুঃখ দেখেছি। ধার-কর্য করেছি। এখন বাকি জীবনটুকু ভালভাবে বাঁচতে পারব। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খানপুর রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মতিন বলেন, অনেক আশা নিয়া ঢাকায় আইলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বপ্ন পূরণ করলেন। মরণের আগ পর্যন্ত আমরা তাঁর কাছে ঋণী থাকব।
জানা গেল, শিক্ষক নেতারা জানান, প্রায় ২ হাজার এক শ’ বাসে করে শিক্ষকরা ঢাকায় আসেন। বাসগুলো মিরপুর, আগারগাঁও ও এর আশপাশ এলাকায় রাস্তায় অবস্থান নেয়। এতে এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। কিন্তু লাখো শিক্ষকের আনন্দের খবরে যানজটের দুর্ভোগের কথা কেউ আমলেই নেয়নি। তীব্র শীত উপেক্ষা করে অনেক শিক্ষক সপরিবারে সন্তান নিয়ে প্যারেড স্কয়ারে জড়ো হয়। প্রচ- শীতে ১৫/২০ জন শিক্ষক অসুস্থও হয়ে পড়েন। এরপরও পরম-প্রাপ্তি শিক্ষকদের সবকিছুকেই যেন ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন মঞ্চে উঠেন তখন পুরো প্যারেড স্কয়ারেই বিরাজ করে নিস্তব্ধ নীরবতা। বেলা পৌনে একটায় তিনি যখন শিক্ষকদের স্বপ্নের সেই ‘জাতীয়করণ’ ঘোষণা দিলেন তখন মহানন্দে অসংখ্য শিক্ষকের চোখে পানি এসে যায়। কেউ কেউ কেঁদেও ফেলেন। বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মহাসচিব মুনছুর আলী বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে শিক্ষক সমাজ প্রধানমন্ত্রীর ঋণ শোধ করতে চায়। আমরা আগামীতে আবারও এই সরকারকে দেখতে চাই।

No comments

Powered by Blogger.