প্রাথমিকেই ঝরছে ৪৮%- * পাবলিক পরীৰার সাফল্য মস্নান- * নেই নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান- * শিশুশ্রম, নিরাপত্তাহীনতা ও বাল্যবিবাহসহ আর্থিক কারণই বেশি দায়ী- * স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

বিভাষ বাড়ৈ প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও পঞ্চম শ্রেণী অতিক্রম করার আগেই শিৰা থেকে ঝরে পড়ে ৪৮ শতাংশ শিশু। ফলে ১০০ শিশুর মধ্যে নূ্যনতম প্রাথমিক শিৰার সুযোগ পাচ্ছে মাত্র ৫২ জন।
গত এক বছরে কেবল পঞ্চম শ্রেণী অতিক্রম করতেই বাদ পড়ে ৪ লাখ শিশু। অষ্টম শ্রেণী অতিক্রম করে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও গত ৫ বছরে এসএসসি পরীৰার আগেই ঝরে পড়েছে প্রায় ১৭ লাখ শিৰার্থী। প্রতি শিৰাবর্ষেই ঝরে পড়ার হার ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে মাধ্যমিক সত্মর অতিক্রম করে কলেজে ভর্তির পর উচ্চ মাধ্যমিক সত্মর অতিক্রম করার আগেই ঝরে পড়ে আরও ৪ লাখ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক শিৰা নিয়ে জনকণ্ঠের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শিৰা থেকে ঝরে পড়ার এই উদ্বেগজনক চিত্র। সরকারীভাবে নানামুখী উদ্যোগের পরেও শিৰার্থীদের অব্যাহত ঝরে পড়ার এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক আর ভয়াবহ বলে অভিহিত করেছেন দেশের বিশিষ্ট শিৰাবিদ ও শিৰা সংশিস্নষ্ট বিশেষজ্ঞরা। উদ্বিগ্ন সরকারের সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারাও। তাঁদের অভিমত, ঝরে পড়ার করম্নণ চিত্রের দিকে তাকালে পাবলিক পরীৰার সাফল্য মস্নান হয়ে যায়।
শিৰার এই গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যনত্ম যতটুকু গবেষণা হয়েছে তাও বেসরকারী পর্যায় পর্যনত্মই সীমাবদ্ধ। আবার যে গবেষণা হয়েছে তাও মূলত প্রাথমিক সত্মরকে ঘিরেই। বিভিন্ন শিৰা বোর্ড প্রতি শিৰাবর্ষে ঝরে পড়ার একটা সংখ্যা নির্ধারণের চেষ্টা করলেও ঝরে পড়ার কারণ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তেমন কোন কাজ হয়নি আজ পর্যনত্ম। তবে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যনত্ম ঝরে পড়াসহ শিৰাবঞ্চিতদের নিয়ে সরকারী ও বেসরকারীভাবে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা সকলেই মনে করছেন, যত কারণই আসুক না কেন পরিবারের আর্থিক সঙ্কটই ঝরে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ। পরিবারের অর্থনৈতিক যোগান দিতে শিশুশ্রমে যোগ দেয়া, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা সামাজিক সঙ্কটে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে শিৰা থেকে অব্যাহতভাবে ঝরে পড়ছে লাখ লাখ শিৰার্থী। শিৰার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট সকল সরকারী অফিস এবং দেশী ও আনত্মর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, প্রাথমিক শিৰার ব্যাপারে এডুকেশন ওয়াচই হলো সবচেয়ে বড়ও নির্ভরযোগ্য সূত্র। এৰেত্রে এডুকেশন ওয়াচের গবেষণাই সরকারের তথ্য প্রাপ্তির জায়গা। এছাড়া আরও কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকে ঝরে পড়া নিয়ে কাজ করলেও তাদের গবেষণা পদ্ধতি এবং এর ব্যাপ্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। তবে পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয় বলে মনে করে সকলেই। জানা গেছে, নানা সঙ্কটের মধ্যদিয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও পঞ্চম শ্রেণী অতিক্রম করার আগেই শিৰা থেকে ঝরে পড়ে ৪৮ শতাংশ শিশু। ফলে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে নূ্যনতম প্রাথমিক শিৰার সুযোগ পাচ্ছে মাত্র ৫২ শিশু। কেবল পঞ্চম শ্রেণীর এক বছরের চিত্রই সুখকর নয়। ২০০৯ সালের শুরম্নতে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল ২০ লাখ ১৭ হাজার ২৪২ শিশু। কিন্তু সমপ্রতি শেষ হওয়া সমাপনী পরীৰায় অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৫ জন। পরীৰার হলে উপস্থিত ছিল ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫ জন। আর পরীৰায় পাস করেছে সারাদেশে ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ শিশু। ফলে কেবল পঞ্চম শ্রেণী অতিক্রম করার আগেই নানা কারণে শিৰা থেকে প্রায় ৪ লাখ শিশুর ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিৰা অধিদফতরের কর্মকর্তারাসহ সংশিস্নষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এক বছরের যে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৮ শিশু পিছিয়ে পড়েছে সরকারীভাবে বিশেষভাবে নজর না দিলে তাদের অধিকাংশই ঝরে পড়বে শিৰা থেকে। তবে প্রাথমিক ও গণশিৰামন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি গুরম্নত্বপূর্ণ। তাই ফেল করাসহ পিছিয়ে পড়া শিৰার্থীদের সঙ্কট চিহ্নিত করে সঙ্কট সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ নেবে সরকার। এদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, পঞ্চম শ্রেণী পাস করলেও এর প্রায় অর্ধেকেরই মাধ্যমিক সত্মরে প্রবেশ করার আগেই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়।
পরিস্থিতি ভাল নয় মাধ্যমিক সত্মরেও। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাথমিক সত্মরে যত শিশু ভর্তি হয় তাদের ৮০ শতাংশই মাধ্যমিক সত্মর অতিক্রম করার আগেই ঝরে যায়। কেবল গত ২০০৬-০৭ শিৰাবর্ষ থেকে চলতি শিৰাবর্ষ পর্যনত্ম নবম ও দশম শ্রেণীতে ঝরে পড়ার চিত্রের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিভিন্ন শিৰা বোর্ড, শিৰা মন্ত্রণালয় এবং সংশিস্নষ্ট সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬-০৭ শিৰাবর্ষে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১২ লাখ ৫৯ হাজার ১০৫ নিয়মিত শিৰার্থী। তাদের লৰ্য ছিল, এসএসসি পরীৰায় অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু ২০০৮ সালের এসএসসি পরীৰায় এসে দেখা গেছে, এদের মধ্যে মাত্র ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৯ জন ফরম পূরণ করেছে। পরীৰার আগেই মাত্র দুই বছরের মধ্যে ঝরে পড়েছে ৬ লাখ ৬ হাজার ৩০৬ শিৰার্থী। এর আগে শিৰা বর্ষের তুলনায় ঐ বছর ঝরে পড়ার হার বেড়ে যায়। ২০০৫-০৬ শিৰাবর্ষে ছিল ৫৩ দশমিক ১৯ আর ২০০৬-০৭ শিৰাবর্ষে ঝরে পড়ার হার ৫৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর আগে ২০০৭-০৮ শিৰাবর্ষে ঝরে পড়ার হার কিছুটা কমলেও পরিস্থিতি সুখকর নয় মোটেই। ২০০৭-০৮ শিৰাবর্ষে নমম শ্রেণীতে নিবন্ধন করেছিল ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩৪ শিৰার্থী। কিন্তু ২০০৯ সালে এসএসসি পরীৰার জন্য ফরম পূরণের আগেই ঝরে পড়ে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৩১০ জন। ঝরে পড়ার হার ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩৪ জনের মধ্যে পরীৰায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৪ জন। এদিকে সারাদেশে সমপ্রতি শেষ হয়েছে আসন্ন এসএসসি পরীৰার ফরম পূরণের কাজ। শিৰা বোর্ডের কম্পিউটার সেকশনেই চলছে পরীৰার্থীদের পরিসংখ্যান সংগ্রহের কাজ। এখানও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০০৮-০৯ শিৰাবর্ষে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধিত ৫ লাখেরও বেশি শিৰার্থী আসন্ন পরীৰার আগেই শিৰা থেকে ঝরে পড়ছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কেবল ঢাকা শিৰা বোর্ডেই ঝরে পড়ার এই সংখ্যা ১ লাখের বেশি।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই ঝরে পড়ার হার কিছুটা কম। কিনত্মু তারপরেও ব্যাপক শিৰার্থীর ঝরে পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশিস্নষ্টরা। জানা গেছে, ২০০৬-০৭ শিৰাবর্ষে সকল বোর্ডে একাদশ শ্রেণীতে নিবন্ধন করে ৬ লাখ ৭ হাজার ৬৫৪ শিৰার্থী। যাদের মধ্যে ২০০৮ সালের এসএসসি পরীৰার আগেই ঝরে পড়ে ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৭। অর্থাৎ এসএসসি পাস করলেও মাত্র দুই বছরেই ঝরে গেছে ২৩ শতাংশেরও বেশি শিার্থী। ঝরেপড়া শিার্থীর হার সবচেয়ে বেশি ছিল কারিগরি বোর্ডে। এই হার ৪১ শতাংশেরও বেশি। এসএসসি ও সমমানের পরীায় পাস করার পর ২০০৭-০৮ শিাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন করে ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৮৬ নিয়মিত শিার্থী। অথচ ২০০৯ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীায় এই শিার্থীদের মধ্য মাত্র ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩২৬ জন অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ একাদশ শ্রেনীতে নিবন্ধন করেও ঝরে পড়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৬০ জন। ঝরে পরার হার কিছুটা কমে দাড়ায় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। ঝরে পরা শিার্থীদের ২০ দশমিক ২৯ শতাংশ ছাত্র এবং ১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছাত্রী। ঢাকা বোর্ডে ঝরে পড়ার হার ১৭ দশমিক ২৯ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ১৬ দশমিক ৭শতাংশ, কুমিল-া বোর্ডে ২৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, চট্টগ্রা্ম বোর্ডে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। মাদ্রাসা বোর্ডে ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ঝরে পড়ে ২৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিৰার্থী। আসন্ন এইচএসসি পরীৰার্থর্ীদের ফরম পূরণের কাজ অনেকটাই শেষ। এখনো শিৰা বোর্ডগুলো কাজ শেষ করতে পারেনি। তবে শিৰা বোর্ডগুলোর সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন পর্যনত্ম যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বলা যায় এবারো ঝরে পড়েছে ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি শিৰার্থী।
সকল পাবলিক পরীৰায় পাসের হার বৃদ্ধিসহ সার্বিক সাফল্যে সনত্মোষ প্রকাশ করলেও শিৰা থেকে অব্যাহত ঝরে পড়ার এই পরিস্থিতিকে শিৰার অগ্রগতির পথে অনত্মরায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টিতে সবসময়েই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন গণসাৰরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। প্রাথমিক শিৰাসহ শিৰার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা মনে করেন, ঝরেপড়া আমাদের সার্বিক শিৰার পথে একটি বড় অনত্মরায়। তিনি ভারতের মতো দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা চিহ্নিত করে শিশুদের জন্য দুপুরের খাবার নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন। এবং পুরো বিষয়ে স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে শিৰার্থীরা ঝরে পড়ছে তাদের একটা বড় অংশ হলো মেয়ে। এবং এর বেশিরভাগ শিৰার্থীই গ্রামের। সরকারের সংশিস্নষ্টরাও বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করেছেন। পরিস্থিতি উত্তরণকে গুরম্নত্বপূর্ণ বলে শিৰামন্ত্রী নূরম্নল ইসলাম নাহিদও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঝরেপড়া রোধ করার ওপর বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন। কেবল তাই নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণে সরকারের নেয়া যুগানত্মকারী সিদ্ধানত্মের অন্যতম কারণও শিৰার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধ করে শিৰায় তাদের ধরে রাখা। ঢাকা শিৰা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন আসন্ন এসএসসি পরীৰার আগেই কেবল ঢাকা বোর্ডে লৰাধিক শিৰার্থীর ঝরে পড়ার কথা উলেস্নখ করে বলেন, আমাদের শিৰার অগ্রগতির পথে ঝরে পড়ার বিষয়টি অত্যনত্ম উদ্বেগজনক। নানা কারণ থাকলেও অর্থনৈতিক কারণেই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন।

No comments

Powered by Blogger.