বড়দিনের দৃষ্টি ॥ শান্তি ও মিলনের কৃষ্টি by ফাদার প্যাট্রিক গমেজ

আজ ২৫ ডিসেম্বর, ২০১২ খ্রীষ্টাব্দ। প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বরে সারা বিশ্বের খ্রীষ্টবিশ্বাসীগণ যথোপযুক্ত ধর্মীয় অনুভূতি ও আনন্দ নিয়ে পালন করে প্রভু যীশুখ্রীষ্টের জন্মবার্ষিকী। আজ যীশুর জন্মদিন, শুভ বড়দিন।
আজ চারদিকে সাজসাজ রব : গির্জাঘর অতীব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে; গির্জঘরের ভিতরে বা বাইরে তৈরি করা হয়েছে যীশুজন্মের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে গোশালা, যেখানে দেখা যায় অভাবনীয় দারিদ্র্যের মাঝে শায়িত আছে সে-ই যীশুখ্রীষ্টের প্রতিকৃতি যিনি ঈশ্বরেরই দেহধারিত বাণী; ঈশ্বরের পূর্ণ প্রকাশ।
উপাসনা ও সামাজিক কৃষ্টি : বড়দিনের উপাসনা (মহাখ্রীষ্টযাগ) হয় ২৪ ডিসেম্বর রাতে এবং ২৫ ডিসেম্বর প্রত্যুষে ও সকাল বেলা। উপাসনার পর সবাই একে অপরকে শুভ বড়দিনের শুভেচ্ছা জানায় সেলাম করে, পদধূলি নিয়ে, কোলাকুলি করে, করমর্দন করে। ঘরে ঘরে তৈরি হয় মুখরোচক সুস্বাদু হরেক রকম পিঠা : চিতই, ফিলোজ, বিক্কে, কুলি, পাটি সাপ্টা, পাকন, ভাপা, আরো অনেক। পিঠার আসরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সবাই মিলিত হয়। আমাদের এই ভাইবোনেরা বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে আসে ভ্রাতৃত্বের টানে। বড়দিনের এমন চিত্র সত্যই অপূর্ব এক মিলন, ভ্রাতৃত্বেও নিদর্শন। এসবই হয়, কেননা আজ যে শান্তিরাজ যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিন, বড়দিন। বড়দিনে কীর্তন দল কীর্তন গেয়ে যীশুর জন্ম বারতা ছড়িয়ে দেয় আকাশে-বাতাসে সবার কাছে। তবে স্মরণ রাখি বড়দিন শুধু বাহ্যিকতায় ভরপুর নয়, এই মহোৎসবটিতে আছে একদিকে এক গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, ধর্মীয় আমেজ এবং আরেকদিকে আছে সবার প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান।

এক ঐতিহাসিক এবং অলৌকিক ঘটনা নিয়ে এই বড়দিন
যীশুর জন্ম অলৌকিক ও অভিনব : অলৌকিক এজন্যেই যে, সমস্ত ঘটনাটাই সম্পূর্ণভাবে ঐশশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। কোন মানুষের বা মানবীয় শক্তিতে নয়, ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা (রূহাঃ) তথা আত্মার শক্তিতে যীশুর এই মানব জন্ম নিষ্কলঙ্কা কুমারী মারীয়ার গর্ভে। অভিনব এই জন্যে যে, তাঁর এই মানবজন্ম নিতান্ত গরিবের বেশে, অসহায়, নিঃসহায়, নিরূপায়, গৃহহীন মানুষের সাথে একাত্ম হয়েই যেন যীশু জন্ম নিলেন বেথলেহেমের জীর্ণ-শীর্ণ এক গোশালায় (প্রসঙ্গ পাঠ : বাইবেল, লুকের মঙ্গল সমাচার ২ অধ্যায় ৬-৭ পদ)। আর তাঁর এই জন্ম-সংবাদ পেয়ে যারা ছুটে এসেছিল, তারা হলো সরল-সহজ ও নিতান্তই গরিব রাখাল দল (প্রসঙ্গ পাঠ : বাইবেল, লুকের মঙ্গলসমাচার ২ অধ্যায় ১৫-১৯ পদ)। এই বেথেলেহেমেই গোয়াল ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন যীশু। আর তখনই এই যীশুই যে মানুষের ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা তা ঘোষিত হয়েছিল স্বর্গদূতের মুখে : “আমি আজ তোমাদের এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদের নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন-তিনি সেই খ্রীষ্ট, স্বয়ং প্রভু” (লুক ২: ৯)।
এই অলৌকিক ও অভিনব জন্মে স্বর্গদূতবাহিনী ঈশ্বরের বন্দনা ক’রে গেয়ে উঠেছিল :
“জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয় !
ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহীত মানবের অন্তরে !”
বর্তমান বাস্তবতায় এবারের বড়দিন : ঈশ্বর স্বর্গ থেকে নেমে এলেন পাপী মানুষের সাথে মিলিত হতে। পাপ ব্যতীত সবদিক দিয়েই তিনি মানুষের মতো হলেন। মানুষের সাথে মিলিত হলেন মানুষ যেন আত্মায় নতুন হয়ে তাঁর সাথে মিলিত হতে পারে; শান্তি ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। আর হলো-ও তাই।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিভিন্ন অঙ্গনে এই ভ্রাতৃত্ব, এই ঐক্য, এই মিলন যেন মলিন হতে চলছে। সন্ত্রাস, খুন, হানাহানি, মর্মান্তিক আঘাত, সাম্প্রতিক ঘটনাবহুল বাস্তবতায় আমাদের মিলনের কৃষ্টিকে ভীষণভাবে ব্যাহত করে দিচ্ছে বৈকি! টিভির পর্দায় এমন চিত্র আমাদের অবাক করে দেয়! অনেককেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে, আরো অনেক পদক্ষেপ—। তবে বিবেকের প্রশ্ন : এটাই কি উত্তম পদক্ষেপ? এভাবেই কি শান্তি ও মৈত্রী রক্ষা করা সম্ভব?

বড়দিনের আহ্বান : মিলনের কৃষ্টি গঠন
পবিত্র বাইবেলে দেখি ত্রাণকর্তা মশীহ পৃথিবীতে এলে শান্তি ও সম্প্রীতির যে পরিবেশ বা রাজ্য গড়ে উঠবে সে চিত্র প্রতীকী ভাষায় প্রবক্তা ইসাইয়া ফুটিয়ে তুলেছেন। “তখন নেকড়ে বাঘ মেষশাবকের সঙ্গে বাস করবে, চিতাবাঘ শয়ে থাকবে ছাগলছানার পাশে। বাছুর আর সিংহের বাচ্চা একসঙ্গেই চরে বেড়াবে; ... গোরু আর ভালুক তখন মিলেমিশেই থাকবে, তাদের বাচ্চারা-ও পাশাপাশি শয়ে থাকবে” (প্রবক্তা ইসাইয়া ১১ঃ১-৫)। “তখন এক জাতি আর অন্য জাতির বিরুদ্ধে তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়াবে না, রণকৌশল আর শিখবে না কখনো” (প্রবক্তা ইসাইয়া ২ঃ৫) ।
যীশুর আগমনে আগমনে এই শান্তির রাজ্য বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর মধ্য দিয়ে তিনি সব জাতি-গোষ্ঠিকে এক করে তুলেছেন; অন্ধকে, বধিরকে, খঞ্জকে সুস্থ করেছেন। পাপীকে ক্ষমা করেছেন। ছোট-বড়-ধনী-গরিব সবাইকে আপন করে নিয়েছেন। এমন মিলনের কৃষ্টি বাস্তবায়ন করতেই এবারের বড়দিন আমাদের সবাইকে আহ্বান জানায়।

বড়দিন আমার উৎসব সবার
বাংলাদেশ কৃষ্টি-সংস্কৃতির দেশ। বহু যুগ ধরেই এই দেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলনের কৃষ্টি নিয়ে বসবাস করে আসছে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একক ও আপন আপন ধারায় ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যে ঈদ, পূজো, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন, ইস্টার পালন করে ; তবে ধর্মীয় দিক দিয়ে একক; কিন্তু উৎসবে অংশ নেয় সবাই। ঈদ, পূজো, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন হোক, উৎসবের আনন্দে অংশগ্রহণ সবার। এখানেই বাংলাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য। খ্রীষ্টবিশ্বাসী সবাই ধর্মীয় উৎসব বড়দিন পালন করছে; কিন্তু এই উৎসবে অংশ নিচ্ছে সবাই বিশেষভাবে উৎসবের মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে; কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে অংশ নিয়ে। বড়দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়, পিঠা খাওয়ার আসরে, এমন কি বড়দিনের কীর্তনে মিলিত হয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনেরা। বড়দিনের এমন আন্তঃধর্মীয় মিলন-চিত্র বড়দিনের এই সত্যকেই ধ্বনিত করে : বড়দিন শান্তি ও মিলনের দিন, বড়দিন শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনের দিন। বড়দিন আমার, উৎসব সবার।

বড়দিনের প্রত্যাশা ও শুভ কামনা
বড়দিন শান্তি ও মৈত্রীর দিন; শান্তি ও মৈত্রীর মহোৎসব। আসুন আমরা সবাই এই বড়দিনে প্রত্যাশা করি আমাদের প্রত্যেকের জন্য ও আমাদের দেশের জন্য এই শান্তি ও মৈত্রী। সর্বান্তকরণে প্রচেষ্টা চালাই এই শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনের জন্য। এবারের বড়দিনে আমরা আমাদের দেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সবার জন্য প্রার্থনা করি বড়দিনের শান্তি-আশীর্বাদ যেন বর্ষিত হয় আমাদের দেশের সবার উপর। এবারের বড়দিনের শুভ কামনা : আমাদের দেশ যেন হয় দুর্নীতিমুক্ত দেশ; শান্তি ও মৈত্রী, মিলনের কৃষ্টি এবং সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের দেশ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সবার প্রতি শুভ বড়দিনের শুভেচ্ছা! শুভ বড়দিন ! Merry Christmas !


লেখক : ক্যাথলিক ধর্মযাজক
প্রাক্তন ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল
ক্যাথলিক বিশপস্ কন্ফারেন্স অব বাংলাদেশ (সিবিসিবি), ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.