৭০টি রাজনৈতিক দল 'নিখোঁজ' by কাজী হাফিজ

দেশের প্রায় ৭০টি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কোনো হদিস নেই। নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন শুরু হলে ২০০৮ সালে এ দলগুলোও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে না পারায় এগুলো নিবন্ধন পায়নি এবং নবম সংসদ নির্বাচনে অংশও নিতে পারেনি।
যদিও এসব দলের বেশির ভাগই অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার নির্বাচন কমিশন দল নিবন্ধনের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর আবেদনের শেষ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে কর্ম দিবস রয়েছে আর মাত্র চারটি। কিন্তু গতকাল সোমবার পর্যন্ত নিখোঁজ দলগুলোর মধ্যে একটি ছাড়া বাকিরা কেউ কমিশনে যোগাযোগ করেনি। এ অবস্থায় ২০০৮ সালের মতো 'কিংস পার্টি' গঠনের আশঙ্কা বা সম্ভাবনাও নেই। যে চারটি নতুন দল কমিশনে যোগাযোগ করেছে তাদের মধ্যে একটি 'এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি'- এই যুক্তিতে সময় বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে। ২০০৮ সালে মোট ১০৭টি দল আবেদন করে নিবন্ধন পেয়েছিল মাত্র ৩৮টি।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিখোঁজ দলগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করবে, এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, ওই সব দলের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরম সংগ্রহ করতে কেউ আসেনি। সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নতুন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট থেকেও গতকাল পর্যন্ত কোনো আবেদন করা হয়নি। সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার জানান, নাজমুল হুদা দল নিবন্ধনের শর্তের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছেন বলে তাঁকে জানিয়েছেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয় এমন দলগুলোর মধ্যে শুধু ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। দলের মহাসচিব ও প্রয়াত জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পৌত্র হাসরত খান ভাসানী কালের কণ্ঠকে জানান, নতুন দল হিসেবে নয়, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে অতীতে অংশগ্রহণকারী দল হিসেবেই তাঁরা নিবন্ধনের আবেদন জানিয়েছেন।
এ ছাড়া 'বাংলাদেশ নিউ সংসদ লীগ' ও বাংলাদেশ পিপল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামের অন্য দুটি নতুন দলও নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছে। আর বাংলাদেশ নিউ জেনারেশন পার্টি নামের একটি দল নির্বাচন কমিশনের কাছে এই মর্মে আবেদন করেছে যে, তারা নতুন দল গঠন করার পর এখনো সব কিছু গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এ জন্য দলের আহ্বায়ক জাহিদ ইকবাল ৩১ মে পর্যন্ত সময় বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন।
বাংলাদেশ নিউ সংসদ লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম গত রবিবার এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি এক সময় কুষ্টিয়াতে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন। দলের সভাপতি শাহীনুল ইসলাম নায়েমের বাড়ি ভেড়ামারায়।
'বাংলাদেশ পিউপল ডেমোক্রেটিক পার্টি'র নারীবিষয়ক সম্পাদক ঝর্ণা আক্তার বলেন, 'আমাদের দলের চেয়ারম্যান মো. বেলাল উদ্দিন। আমরা এক সময় জাতীয় পার্টিতে ছিলাম। সম্প্রতি নতুন দল গঠন করে নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী সব কিছুই করা হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, দল নিবন্ধনে ২০০৮ সালের চেয়ে এবারে শর্ত পূরণ অনেক কঠিন। আগে কেন্দ্রীয় অফিসসহ কম পক্ষে ১০টি জেলা এবং ৫০টি উপজেলাতে দলের অফিস ও কমিটি থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। পরে আইন সংশোধন করে কেন্দ্রসহ কমপক্ষে ২১ জেলায় ও ১০০ উপজেলা বা থানাতে দলের কার্যকর অফিস এবং প্রতি উপজেলা বা থানাতে কমপক্ষে ২০০ ভোটার সদস্য থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ৩১ ডিসেম্বরই দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন গ্রহণের শেষ সময়। সময় বাড়ানোর বিষয়ে কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সে সম্ভাবনাও কম।
কোন নির্বাচনে কত রাজনৈতিক দল : নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে মোট ১৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। এরপর ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯টি, ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আটটি, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৮১টি, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫৫টি এবং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ৩৮টি দল অংশ নেয়।
তবে নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছ এমন দলের সংখ্যা কম। ১৯৯১ সালে ৭৫টি দল নির্বাচনে অংশ নিলেও ১২টি দল বাদে অন্য দলগুলো একটি আসনও পায়নি। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১১১টি দল প্রতীক বরাদ্দের আবেদন জানায়। প্রতীক বরাদ্দ হয় ৯০টি দলের জন্য। এর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয় ৮১টি দল এবং আসন পায় মাত্র সাতটি দল। ২০০১ সালে অংশ নেওয়া ৫৫টি দলের মধ্যে আসন পায় ৯টি দল। ২০০৮ সালে ৩৮টি দলের মধ্যে আসন পায় আটটি দল। এর মধ্যে তিনটি দল জোটভুক্ত হিসেবে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়।
যেসব দলের খোঁজ নেই : ২০০৮ সালের শেষ দিকে যে ১০৭টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে তাদের মধ্যে ৬৮টি দল প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়। একটি দল- ফ্রিডম পার্টিকে নিবন্ধন দেওয়ার পর তা বাতিল করা হয়।
শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়া ৬৮টি দল হচ্ছে- নির্দলীয় জন আন্দোলন, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্য দল, বাংলাদেশ নয়া সমাজ দল, ফরওয়ার্ড পার্টি, গণ ঐক্য ফ্রন্ট (গাফ) বাংলাদেশ, বাংলাদেশ প্রগ্রেসিভ পার্টি, জনতার সংহতি, বাংলাদেশ জাতীয় তাঁতী দল, বাংলাদেশ জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাবলিক পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি, কোরআন ও সুন্নাহ বাস্তবায়ন পার্টি-বাংলাদেশ, ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু গণতান্ত্রিক পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ্, করাপশন ফ্রি পার্টি-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকান পার্টি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ ফ্রন্ট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, লিবারেল পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পিপলস্ পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ভাসানী, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পেশাজীবী ফোরাম, বাংলাদেশ জন-গণতান্ত্রিক দল, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কৃষক শ্রমিক ঐক্য জোট, পিপলস্ রিপাবলিকান পার্টি (পিআরপি), সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন, ইসলামী সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ দুনিয়া দল, বাংলাদেশ জাতীয় পিপলস পার্টি, পিপলস্ পার্টি অব বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, পাকমন পিপলস্ পার্টি, মুক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন, জনমুক্তি পার্টি, বাংলাদেশ হিন্দু লীগ, বাংলাদেশ রেভুলেশনারি পার্টি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-স্বনির্ভর পার্টি, বাংলাদেশ আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম, বাংলাদেশ দরিদ্র উন্নয়ন পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলামী পার্টি, জেনারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ভূমিহীন দল, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা জনতা ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক বাস্তুহারা লীগ, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, লোক দল, পিপলস্ অ্যাকশন পার্টি বাংলাদেশ, সোনার বাংলা পার্টি, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু ঐক্য ফ্রন্ট, জাতীয় জনতা পার্টি, জাতীয়তাবাদী ঐক্য মোর্চা, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিজম ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দল ও বাংলাদেশ জালালী পার্টি।
এসব দলের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে আঞ্চলিক দল এবং এ দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় হিসেবে চিহ্নিত করে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, আবেদনকারী ১০৭টি দল ছাড়াও সে সময় আরো অনেক দল আবেদন ফরম সংগ্রহ করে। কিন্তু নিবন্ধনের শর্ত পূরণ ব্যয়বহুল বিবেচনায় পরে পিছিয়ে যায়। এসব দলের মধ্যে বহুল আলোচিত কৃষক মোহাম্মদ সাদেকের বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনও ছিল। কৃষক মোহাম্মদ সাদেক তাঁর দল থেকে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, ৩৯ বার জাতীয় সংসদের বিভিন্ন আসনে নির্বাচন ও উপনির্বাচন এবং ৪ বার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেন। প্রায় সব নির্বাচনেই তাঁর জামানত হারানোর ঘটনা ঘটে। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দল নিবন্ধনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নামসর্বস্ব দলগুলোকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, '২০০৮ সালে খুব কম সময়ের মধ্যে আমাদের দল নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও দলগুলোর যোগ্যতা উপযুক্তভাবে যাচাই সম্পন্ন হয়নি। এবার কমিশনের হাতে প্রচুর সময় রয়েছে। দরকার হলে আরো সময় বাড়িয়ে এ কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
নিবন্ধিত সব দলও সক্রিয় নয়: কমিশন সূত্র জানায়, নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি দল তেমনভাবে সক্রিয় নয়। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সংলাপে কয়েকটি দল অংশ নেয়নি। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশনে দলের মহাসচিব হিসেবে একাধিক ব্যক্তি যোগাযোগ করায় কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য ঢাকার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে আগামী ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। এই সমস্যার কারণে সম্প্রতি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে এ দলকে বাদ রাখা হয়। ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন কমিশনকে জানায় দলের বর্তমান অবস্থা সংলাপে অংশ নেওয়ার মতো নয়। এদিকে নিবন্ধিত বেশ কয়েকটি দলের জেলা-উপজেলা অফিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হচ্ছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দল নিবন্ধনের শর্ত পূরণের জন্য সাইনবোর্ডসর্বস্ব বা একবারে নতুন দল নির্ধারিত সংখ্যক জেলা-উপজেলায় সাময়িক ঘরভাড়া নিয়ে দলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু নিবন্ধন পাওয়ার পর ওই সব সাইনবোর্ড আর দেখা যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.