সাংবাদিক দম্পতি হত্যা- এবার এনামুলেই ‘সব রহস্য’ by গোলাম মর্তুজা

যুক্তরাষ্ট্রে ডিএনএ পরীক্ষা, ফরেনসিক পরীক্ষা, বন্ধুর সঙ্গে নিহত নারী সাংবাদিকের কথোপকথনের কৌশলী প্রচার, ‘সন্দেহভাজন’ সাতজনকে গ্রেপ্তার, শ খানেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ—সব ছাপিয়ে এখন সাগর-রুনি হত্যার ‘রহস্য আটকে আছে’ বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ুন ওরফে এনামুলে।
হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তকারী সংস্থাগুলো দফায় দফায় এই এনামুলকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। কিন্তু এখন আর তাঁকে খুঁজে পাচ্ছে না মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব)।
অনেকটা যেন সময়ের গর্ভে হারাতে বসা এই হত্যার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে গত রোববার সাংবাদিকদের প্রতীকী গণ-অনশন কর্মসূচির কারণে। একই দিনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় র্যা বের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেছেন, এনামুলকে ধরতে পারলেই রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব। তাঁকে খুঁজে পাওয়াই এখন তদন্তের প্রধানতম কাজ।
দুই মাস ধরে এই ‘প্রধানতম কাজটির’ বিষয়ে র্যা বের কোনো তৎপরতার তথ্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। শুধু গত ৯ অক্টোবর এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। অবশ্য এর পরে বা আগে দেশের কোনো থানায় এনামুলের ছবি পাঠানো হয়নি। পুলিশ বা র্যা বের ওয়েবসাইটেও তাঁর ছবিসংবলিত কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। তাঁকে ধরিয়ে দিতে নেই কোনো প্রচারণা। ফলে এনামুল দেশে না বিদেশে, জীবিত না মৃত, তা নিয়ে চিন্তিত তাঁর পরিবার।
তবে র্যা বের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এনামুলকে গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের তৎপরতা চলছে। তাঁর যুক্তি, যেখানে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করা হচ্ছে। তাঁকে ধরতে কোনো অভিযান চালানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ সে কোন জায়গায় আছে—এর সন্ধান পাওয়ার পরই তো অভিযান চালানো হবে। তাঁর সন্ধানই তো কেউ দিতে পারছে না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে র্যা ব-প্রধান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব দ্রুত ফরেনসিক ও ডিএনএ-বৃত্তান্ত বিশ্লেষণ প্রতিবেদন পাওয়ার আশা করছেন তাঁরা।
র্যা ব সূত্রগুলো জানায়, গত ১৮ এপ্রিল আদালতের নির্দেশে তদন্তভার নিয়েই র্যা ব ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। এরপর নিহতদের পরিধেয় কাপড়, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত ছুরিসহ কিছু আলামত ডিএনএ ও ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সরওয়ার মেঘের কাছ থেকে একাধিকবার ‘গল্পের ছলে তথ্য জানার চেষ্টা’ করা হয়। নিহত দম্পতির কর্মস্থল এটিএন বাংলা ও মাছরাঙা টেলিভিশন কার্যালয়ে গিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে।
সেপ্টেম্বর মাসে র্যা বের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো নমুনায় এক ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ-বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে। তারপর আর এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে এনামুলকে পলাতক উল্লেখ করে তাঁকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আরও জানানো হয়, এ মামলায় সাতজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন: রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ এবং সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী পলাশ রুদ্র পাল ও নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। এঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই গত আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যা ব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
র্যা বের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা এই মামলাটি নিয়ে চরম বিব্রত। এর আগে এপ্রিল মাসে আদালতে এই মামলা তদন্তে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে তদন্তভার ছেড়ে দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এনামুল-বৃত্তান্ত: ডিবি ও র্যা ব সূত্র জানায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতির লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ, ডিবি ও র্যা ব সাগর-রুনিরা যে ভবনে থাকতেন, তার নিরাপত্তাকর্মী ‘হুমায়ুন’কে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এপ্রিলে র্যা ব তদন্তভার নেওয়ার অন্তত তিন মাস পরে জানতে পারে যে তাঁর আসল নাম এনামুল। হুমায়ুন তাঁর ছদ্মনাম, কুড়িগ্রামের ভুয়া ঠিকানা দিয়ে তিনি চাকরি নিয়েছিলেন।
সাগর-রুনি রাজাবাজারে যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেই ভবনটির নিরাপত্তা রক্ষায় চুক্তিবদ্ধ ছিল শেরেখোদা সিকিউরিটি সলিউশন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানটি ‘হুমায়ুন কবীর’ ও পলাশ রুদ্র পালকে ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়। সব জায়গায় ‘হুমায়ুনের’ স্থায়ী ঠিকানা ছিল কুড়িগ্রামের উলিপুর।
র্যা ব সূত্র জানায়, তদন্তভার পেয়ে র্যা ব জানতে পারে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের দোহালিয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেখানে গিয়ে র্যা ব খুঁজে পায় তাঁর বাবা কালা মিয়াকে। কালা মিয়া ‘হুমায়ুনের’ ছবি দেখে বলেন, ‘এ তো আমার ছেলে। তবে তাঁর নাম হুমায়ুন নয়, মো. এনামুল।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুরস্কার ঘোষণার আগেই ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে নিজ গ্রাম থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা একটি কালো মাইক্রোবাসে করে এনামুলের বাবা কালা মিয়াকে ধরে নিয়ে যান। ২০ দিন পরে ভৈরব সেতুর কাছে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফিরে এসে কালা মিয়া জানিয়েছিলেন, এনামুলের খোঁজ জানতে ২০ দিন ধরে তাঁকে আটকে রেখে চাপ দেওয়া হয়েছিল। তবে কারা তাঁকে ধরে নিয়েছিল, তা বলেননি তিনি।
ঘন ঘন কর্মস্থল বদল: র্যা ব কর্মকর্তারা বলছেন, এনামুলের ১৮ মাসের (ফেব্রুয়ারির আগের) ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, তিনি ঘন ঘন কর্মস্থল পরিবর্তন করেছেন। একজন নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যা তাঁদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে।
শেরেখোদা সিকিউরিটিতে যোগ দেওয়ার পর ২০১০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মণিপুরীপাড়ার মডার্ন সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে কাজ করেছিলেন এনামুল। এই হাসপাতালের ব্যবস্থাপক বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে আমাদের এখানে এক মাস কাজ করেছে। তাকে ভালো হিসেবেই জানতাম।’
২০১০ সালের ৭ নভেম্বর মাত্র এক দিনের জন্য ইন্দিরা রোডের ইস্টার্ন গার্ডেন অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে কাজ করেন এনামুল। ওই বছরের ৮ থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি পান্থপথের ‘গগন শিরীষ’ নামের একটি আবাসিক ভবনে কাজ করেছিলেন। এরপর কয়েক মাস তাঁর কোথাও কাজ করার তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত টঙ্গীর একটি কারখানায়, ১৪ থেকে ৩১ জুলাই আগারগাঁওয়ের মনিকা টাওয়ারে এবং ১ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় ইন্দিরা রোডের ইস্টার্ন টাওয়ারে দায়িত্ব পালন করেন এনামুল।
এরপর তিনি ২০১২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে কলতান বলে একটি ভবনে দুই-তিন দিন দায়িত্ব পালন করেন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁকে রাজাবাজারে সাগর-রুনিরা যে ভবনে থাকতেন সেখানে নিয়োগ করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে ওই বাসায় সাগর-রুনির লাশ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে শেরেখোদা সিকিউরিটির কর্মকর্তা কাজী মাহমুদ হাসান বলেন, হুমায়ুন (এনামুল) তো নিজের ইচ্ছায় কর্মস্থল পরিবর্তন করতেন না। কোম্পানি যখন যেখানে প্রয়োজন তখন তাঁকে সেখানে নিয়োগ করত। তবে দেড় বছরে কর্মস্থলগুলো থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাননি বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, তবে তাঁর একটি বদ-অভ্যাস ছিল, ঘুমাতেন বেশি। আবার ছুটিতে গেলে সহজে আসতেন না।
কাজী মাহমুদ হাসান দাবি করেন, নিয়োগের সময় হুমায়ুনের (এনামুল) ঠিকানা নিয়মানুযায়ী যাচাই করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.