চট্টগ্রামে পানিসংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে আর্সেনিক-দূষণ by শিশির মোড়ল ও প্রণব বল

বন্দরনগর চট্টগ্রামে পানিসংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে আর্সেনিক-দূষণ। চাহিদা মেটাতে ব্যবহূত অগভীর নলকূপের একটি বড় অংশের পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) বলছে, মহানগরের চাহিদার ৪০ শতাংশ পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ২০১৩ সাল থেকে পানির চাহিদা আরও ২৭ শতাংশ পূরণ হবে। তবে আর্সেনিক-সমস্যা মোকাবিলা তো দূরের কথা, এ বিষয়ে কোনো তথ্য ওয়াসা বা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) কাছে নেই।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত প্রথম আলোকে জানান, মহানগরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে ওয়াসা পানি সরবরাহ করতে পারে না। অন্যদিকে নগরের অনেক এলাকার পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া গেছে। বড় উদ্যোগ না নিলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে।
চাহিদা অপূর্ণই থাকছে: ওয়াসার সূত্র বলছে, মহানগরে দৈনিক পানির চাহিদা ৫০ কোটি লিটার। ওয়াসা গড়ে প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। এর মধ্যে ১০ কোটি লিটার আসে হালদা নদী থেকে। মোহরা পানি শোধনাগার এ পানি ব্যবহারের উপযোগী করে। বাকি ১০ কোটি লিটার ভূগর্ভস্থ পানি। ৯০টি গভীর নলকূপের সাহায্যে এ পানি তোলা হয়।
শহরের কোনো কোনো এলাকায় সপ্তাহে মাত্র একবার পানি দেয় ওয়াসা। কিছু এলাকায় দেয় সপ্তাহে দুবার। সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহ করার পরিবর্তে খণ্ডকালীন (রেশনিংয়ের মাধ্যমে) পানি সরবরাহ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
নগরের দক্ষিণ ও মধ্য হালিশহরে চার দিন ধরে ওয়াসার পানির সরবরাহ নেই। স্থানীয় বাসিন্দা শাকিলুজ্জাহান খান জানান, মাঝেমধ্যে সপ্তাহে একবারও পানি পাওয়া যায় না। এ সময় তাঁরা ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা দিয়ে ওয়াসার এক গাড়ি পানি কিনে আনেন।
পানিসংকটের একই রূপ নগরের লালখান বাজার, আসকারদীঘির পাড়, হালিশহর বি ব্লক, কে ব্লক, কর্ণফুলী কমপ্লেক্স, বাগঘোনার মতো এলাকাগুলোতেও রয়েছে। আসছে শুষ্ক মৌসুমে এ সংকট তীব্র হবে।
বাগঘোনা এলাকার মো. আলম জানান, প্রতিদিন এখানে রাস্তার কলে কিছুক্ষণ পানি আসে। এর জন্য সবাই লাইন ধরেন। পানিসংকটের সময় তাঁরা কাছের ওয়াসা কার্যালয়ে লাইন ধরে পানি নিয়ে আসেন।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তপন দাশ বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে দুই হাজার ১৮০টি গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে ওয়াসা। তবে এগুলো খুব ছোট। মূলত বাড়ির মালিক নিজের প্রয়োজনে এগুলো বসিয়েছেন। এতে চাহিদা কিছু পূরণ হয়। ব্যক্তিপর্যায়ের এসব নলকূপ চাহিদার কত শতাংশ পূরণ করে, তারও কোনো হিসাব নেই ওয়াসার কাছে।
চাহিদা পূরণের উদ্যোগের কথা জানতে চাইলে প্রায় সব কর্মকর্তা বাস্তবায়নাধীন কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের কথা বলেন। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার আর্থিক সহায়তায় চলমান এ প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা। তপন দাশ বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দৈনিক আরও সাড়ে ১৩ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০ কোটি লিটার পানির চাহিদা থেকেই যাবে। এর মধ্যে শহরের জনসংখ্যাও বাড়বে। বর্তমানে শহরের জনসংখ্যা ৫০ লাখের কিছু বেশি।
আর্সেনিকের শিকার বন্দরনগর: চার বছর ধরে মহানগরের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নিয়ে গবেষণা করছেন স্বপন কুমার পালিত। ২০০৮ সালে ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটি থেকে ১০টি করে অগভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করেছিলেন তিনি ও তাঁর গবেষণা দল। ওই গবেষণায় দেখেছিলেন, সাতটি ওয়ার্ডের (পূর্ব ষোলশহর, উত্তর হালিশহর, দক্ষিণ কাট্টলি, পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া ও উত্তর আগ্রাবাদ) অগভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ১০ পিপিবি, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৫০ পিপিবি।
স্বপন পালিত প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পরপর অনেকেই অনেক কিছু করার কথা বলেছিলেন। বাস্তবে কিছুই হয়নি।
২০০৯ সালে ৬ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সব অগভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করেন স্বপন কুমার। তখন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের (পূর্ব ষোলশহর) ২২৩টি এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের (উত্তর হালিশহর) ৪২৬টি অগভীর নলকূপের যথাক্রমে ৯৮ ও ৭৮টিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ওয়াসার জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে আর্সেনিক নেই। নিজেদের ও বুয়েটের পরীক্ষাগারে একাধিকবার পানি পরীক্ষা করে তাঁরা এটা নিশ্চিত হয়েছেন।
অগভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের কাছে চট্টগ্রাম শহরের কোনো তথ্য নেই। তাঁরা সিটি করপোরেশনে (সিসিসি) যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। সিসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন জানান, দূষিত অগভীর নলকূপের পানির বিষয়ে নিজস্ব কোনো তথ্য তাঁদের নেই।

No comments

Powered by Blogger.