সহিংস আচরণের নামও রাজনীতি! by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

মানুষের প্রতি মানুষের সহিংস আচরণের মাত্রা বর্তমান সময়ে মধ্যযুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। মধ্যযুগকে যখন অন্ধকারের যুগ বলা হতো তখন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি ও ধারণার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগে তত্ত্বের কদর ছিল।
জোর যার মুল্লুক তার- এমন ধারণার প্রচলন তখনকার সময়ে প্রযোজ্য ছিল। সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক চুক্তি মতবাদের আবির্ভাব এর পরে হলেও আধুনিক যুগে এসে মধ্যযুগের ভাবধারা 'জোর যার মুল্লুক তার' ধারণা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। কিছু মানুষের কর্মকাণ্ড, ধ্যান-ধারণা এমন যেন আমরা মধ্যযুগেই বসবাস করছি। সহিংস আচরণের প্রচণ্ডতা আমাদের পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শনে আমরা অনেক উৎকর্ষ সাধন করেছি এবং অনেক দূর এগিয়েছি। পাল্লা দিয়ে সামাজিক ও মানবিক গুণাবলি সুন্দরভাবে রপ্ত করতে পারছি না। ফলে সহিংস আচরণ, যা আমরা প্রতিনিয়ত করছি সেগুলোর সঙ্গে মধ্যযুগের বর্বরতার একটি ছোঁয়া পাচ্ছি।
সহিংস আচরণগুলো ব্যক্তিগত ও দলগত পর্যায়ে হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত সহিংস আচরণ ব্যক্তির নিজস্ব দুর্বলতা ও ব্যক্তিত্ব সমস্যার কারণে বেশি হয়ে থাকে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা কখনো কখনো ব্যক্তিগত সহিংস আচরণ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে জখম বা হত্যা করা এ পর্যায়ে পড়ে। একান্ত পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে যখন সহিংস আচরণ লক্ষ করি তখন ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা পাওয়ার মনোবৃত্তি কাজ করে। ভয়ও কাজ করে সহিংস আচরণ করার ক্ষেত্রে, কেননা রক্ষা করার জন্য অনেকে তো এগিয়ে আসবে না। কিন্তু দলগত সহিংস আচরণ করার ক্ষেত্রে সুবিধা বেশি। এ ধরনের আচরণের পেছনে ব্যক্তির নিজস্ব মোটিভ ও স্বার্থ যতটা না কাজ করে এর চেয়ে বেশি কাজ করে অন্যের স্বার্থ। নিজেকে জাহির করা এবং আর্থিক সামর্থ্য অর্জন করা এ কাজে সহজ। ব্যক্তিগত সহিংসতার ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় গুটিকয়েক মানুষ। কিন্তু দলগত সহিংসতার ফল অনেক মানুষকে ভোগ করতে হয়। রামুর বৌদ্ধমন্দিরে হামলায় শত শত মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে বৈকি। ভৌত অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়তো একটি সময় পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে; কিন্তু মনের গহিনে যে সহিংসতা লেপে আছে তা কি কখনো পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব? যে ছোট শিশুটি চোখের সামনে বৌদ্ধমন্দির ভাঙচুরের ঘটনা দেখেছে, তার বুকে কয়েক যুগ ধরে ক্ষত থাকবে। এ ক্ষত মুছে দেওয়া সম্ভব হবে না। বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের মানুষদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয় যখন মহান বিজয় দিবসে রামু ঘটনার মূল নায়ক তালিকাভুক্ত আসামি বিজয় দিবসে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পতাকা উত্তোলন করে ও ভাষণ দিয়ে বীরদর্পে চলে যান। অথচ গ্রেপ্তার হন না। এ কষ্ট তারা কোথায় রাখবে। বরাবরের মতো পুলিশের দায়সারা উত্তর; কিন্তু আমরা এ উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারি না, পারব না।
ফিরে আসি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে। একটি সংঘবদ্ধ মিছিল থেকে বিশ্বজিতের ওপর হামলা করা হয়েছে। হামলাকারীরা ছিল সশস্ত্র। ছিল ওপর মহল থেকে নির্দেশনা। এ সহিংসতা শাকিল কিংবা শাওনদের ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ কিংবা পারিবারিক কোনো বিরোধের কারণে হয়নি। হয়নি একান্ত নিজস্ব কোনো লোভ-লালসা কিংবা স্বার্থের জন্য। ঘটেছে পুরোপুরি রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির স্বার্থের কারণে। কেননা যারা এ কাজটি করেছে, তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বলীয়ান। তাদের গ্রেপ্তারে সাময়িকভাবে পুরান ঢাকার মানুষ স্বাস্তি পেলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়তো হবে না। অচিরেই আসামিরা জামিনে মুক্তি পেতে পারে কিংবা নতুন একটি দল তৈরি হবে যারা হয়তো ওদের চেয়েও ভয়ংকর হবে। সাধারণ মানুষ সহিংস আচরণ থেকে দীর্ঘমেয়াদে রক্ষা পাবে কি না সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দলগত সহিংস আচরণের পেছনে বড় ভাইদের প্রত্যক্ষ সাহায্য, সহযোগিতা ও নির্দেশনা যেমন থাকে, তেমনি থাকে নিজেদের জাহির করার উদ্দেশ্য। নইলে ভবিষ্যতে বড় ভাইদের আসন যে ফাঁকা থাকবে। আমরা যতই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি না কেন এরা কেউই ছাত্রলীগের কর্মী নয়, তা ধোপে টিকবে না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কর্মীর অভাব হয় না। কেননা বেশ সুযোগ-সুবিধা এ সময় পাওয়া যায়। আজ যখন পারিবারিক ইতিহাস খুঁজে বলা হয়, এরা কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামী পরিবার থেকে এসেছে, কারো ভাই শিবির কিংবা ছাত্রদলকর্মী কিন্তু এ কাজটি আমাদের ছাত্রলীগ বন্ধুরা নিজেদের দলে নেওয়ার আগে জানতে পারতেন না? এটি করেনি বিধায় আজকে দলের, সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হয়েছে। আর এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে কারো মন জয় করা যায় কি না, তা আমাদের জানা নেই।
দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় আট কোটি ভোটার। দেশ ভালো চললে, ভবিষ্যতে এরা এ সরকারকেই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে। কিন্তু কিছু সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যখন সরকারের অনেক ভালো অর্জন ম্লান হয়ে যায় তখন কষ্ট অনুভব করি। আমার মতো অনেক সাধারণ মানুষও ভাবে সরকারের শুরুটা ভালোই ছিল কিন্তু ক্রমে কেন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সরকার কি পারে না এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে। কোনো পথই কি নেই উত্তরণের। অবশ্যই রয়েছে এবং সরকারকে সেই পথেই হাঁটতে হবে। গুটিকয়েক লোকের জন্য পুরো অর্জন শেষ হয়ে যেতে পারে না। এরা সংখ্যায় কম। এদের দমন করতে পারলে বেশিসংখ্যক মানুষ আপনাদের বাহবা দেবে। পাশে দাঁড়াবে। আবারও ক্ষমতাসীন করবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.