মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- বিধান নেই তবু মামলা পুনর্বিচারের আবেদন

আইনে পুনর্বিচারের বিধান নেই। তার পরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন জামায়াতে ইসলামীর তিন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পুনর্বিচারের আবেদন করছে আসামিপক্ষ। ইতিমধ্যে গতকাল বুধবার তারা একটি আবেদন জমা দিয়েছে।
বিচারসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা বিচার বিলম্বিত বা বানচাল করার অপকৌশল।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলাটি পুনর্বিচারের আবেদন জমা দেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। এ সময় তিনি বলেন, তাঁরা মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রেও একই ধরনের আবেদন জমা দেবেন। তবে আবেদন প্রস্তুত করতে দুই দিন সময় লাগবে। তিনটি আবেদনই একই ধরনের বলে তিনি এগুলো একসঙ্গে শুনানির আরজি জানান। ট্রাইব্যুনাল ২৪ ডিসেম্বর এসব আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে পুনর্বিচারের কোনো বিধান নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য তারা (আসামিপক্ষ) বিধিবহির্ভূতভাবে এসব আবেদন করছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারক পরিবর্তন বা আদালতের কাঠামো পরিবর্তিত হলে বিচারাধীন মামলা সর্বশেষ যে পর্যায়ে ছিল, সে পর্যায় থেকে শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৬(৬) ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো কারণে ট্রাইব্যুনালের কাঠামোতে পরিবর্তন এলে বা কোনো সদস্য বিচারকাজে অনুপস্থিত থাকলে, সে সময় থেকে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এমন কোনো সাক্ষীকে আবার সাক্ষ্য দিতে বা পুনঃশুনানির জন্য ডাকতে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য নন। ইতিমধ্যে যেসব সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল সেসব সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে কার্যক্রম চালাতে পারবেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মতে, যেভাবে পারে বিচার বিলম্বিত করার জন্য আসামিপক্ষ পুনর্বিচারের আবেদন করছে। তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও জানেন, বিশ্বের কোথাও বিচারক পদত্যাগ করলে নতুন করে মামলার বিচার শুরু হয় না। কিন্তু সময় নষ্ট করাই তাদের উদ্দেশ্য।’
গতকাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য ৬১২ পৃষ্ঠার আবেদন জমা দেওয়ার সময় আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে বলেন, পরে তাঁরা আরও ৫০০ পৃষ্ঠার নথি জমা দেবেন। ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজামী ও সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায়ও একই ধরনের আবেদন জমা দেবেন। আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি মামলাগুলোর কার্যক্রম মুলতবি করার আরজি জানান। ট্রাইব্যুনাল শুনানির জন্য ২৪ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন।
আবদুর রাজ্জাক পরে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, গত ১২ মে ব্রাসেলস থেকে আহমেদ জিয়াউদ্দিন অভিযোগ গঠনের বিষয়ে একটি খসড়া বিচারপতি নিজামুল হকের কাছে পাঠান। পরদিন গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেন, তার সঙ্গে আগের দিন পাঠানো খসড়ার হুবহু মিল রয়েছে। ওই আদেশের তারিখ ও সংখ্যা ছাড়া আর কিছু পরিবর্তন করা হয়নি। যেহেতু অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার শুরু হয়, এ জন্য পুনর্বিচারের আবেদন করা হয়েছে।
যে তিনটি মামলায় পুনর্বিচারের আবেদন করা হচ্ছে, তার মধ্যে সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটি কার্যক্রম শেষে রায়ের অপেক্ষায় আছে। অনেক দূর এগিয়েছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলাটিও। এ মামলায় আসামিপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। শুধু নিজামীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের মাত্র দুই সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
স্কাইপে আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে কথোপকথনের জের ধরে ওঠা বিতর্কের মুখে ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান বিচারপতি নিজামুল হক। আসামিপক্ষ তখনই জানিয়েছিল, তারা বিচারাধীন মামলাগুলো পুনর্বিচারের আবেদন করবে। দুই দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হলেও বিচারকাজ তেমন এগোয়নি। এর মধ্যে একদিন নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী জবানবন্দি দেন। তাঁকে আসামিপক্ষের জেরা বাকি আছে। বাকি মামলাগুলোর কার্যক্রমও আর এগোয়নি।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির অপসারণ চেয়ে আবেদন: একই ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুমের অপসারণ চেয়ে আবেদন করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। গতকাল সাকা চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক ও ফখরুল ইসলাম এই আবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেন। এতে জেয়াদ-আল-মালুমের বিরুদ্ধে আইনের ১১(৪) ধারায় আদালত অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ারও আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনটি শুনানির জন্য ২৩ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল মধ্যাহ্নবিরতির পর এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১৭তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের কথা ছিল। দুপুরে কার্যক্রম শুরু হলে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাকা চৌধুরী বলেন, কৌঁসুলিকে অপসারণের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মুলতবি করতে হবে। এ সময় তিনি উচ্চ স্বরে বলেন, ‘যারা চুরি করেছে, চোর ধরা পড়েছে, তাদের বিচার আগে হওয়া প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউটরদের মধ্যে নেক্সাস (পারস্পরিক সম্পর্ক) ছিল। এটা বিচার বিভাগের সততা, একাগ্রতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। আগে এইটার নিষ্পত্তি করতে হবে।’
ট্রাইব্যুনাল বসার নির্দেশ দিলেও সাকা চৌধুরী কথা বলতে থাকেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি পাল্টা বক্তব্য দিতে গেলে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে কিছুক্ষণ হট্টগোল হয়। পরে ট্রাইব্যুনাল কার্যক্রম ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাসগুপ্ত সার্বিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু করা হচ্ছে বিচার বিলম্বিত করার জন্য। আবেদন করতে বাধা নেই। তবে দেখতে হবে সেই আবেদনের কোনো আইনগত ভিত্তি আছে কি না।

No comments

Powered by Blogger.