মরণকাঠি ও জিয়নকাঠির মহাজোট সরকার by মো. জাকির হোসেন

রূপকথার গল্প পড়ার বয়সে গল্পে পড়েছিলাম রাজকন্যাকে অপহরণ করে পাতালপুরীতে নিয়ে গিয়েছে দানবরাজ। পাতালপুরীতে রাজকন্যার সিথানে ও পৈথানে দুটি কাঠি রাখা হয়েছে। এর একটি মরণকাঠি ও অন্যটি জিয়নকাঠি। মরণকাঠি সিথানে রাখলে রাজকন্যা ঘুমের অতল রাজ্যে তলিয়ে যান।


পৃথিবী কিংবা পাতালপুরীতে কী ঘটছে সবই তাঁর জানার বাইরে। জিয়নকাঠি পৈথান থেকে সিথানে নেওয়া মাত্রই রাজকন্যা জেগে ওঠেন। চারদিকে কোথায় কী ঘটছে তা জানা ও বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সিথানে মরণকাঠি থাকা অবস্থায় কী কী ঘটেছে সে বিষয়ে তাঁকে সত্য-মিথ্যা যা-ই জানানো হোক না কেন, তা যাচাই করে দেখার সুযোগ নেই। দানবরা রাজকন্যার চার পাশে কয়েক স্তরের বেষ্টনী গড়ে তুলেছে, যাতে বাইরে থেকে কোনো তথ্য রাজকন্যার কাছে পৌঁছাতে না পারে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারেও মরণকাঠি-জিয়নকাঠির খেলা চলছে। একদল মানুষ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর মরণকাঠির ইন্দ্রজালের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর চার পাশে কয়েক স্তরের পাহারা বসানো হয়েছে, যাতে বাস্তবতার রাজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রধানমন্ত্রীর ধারে-কাছেও ঘেঁষতে না পারে। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্যই তিনি যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছেন না। জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন সঠিকভাবে অনুভব করতে পারছেন না। অথচ দেশের কোটি কোটি মানুষ চায় সব ইন্দ্রজাল ছিন্ন করে প্রধানমন্ত্রী জনগণের ভাষা অনুধাবন করুন।
কোনো এক ইন্দ্রজালের মায়ায় সম্মোহিত সরকার দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে যে বিপর্যয় চলছে, ইউনিপেটু, ডেসটিনি, হলমার্কসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান যে ভয়াবহ আর্থিক অনাচার করেছে, তা মোহগ্রস্তের মতো চেয়ে চেয়ে দেখেছে। জনগণের মনের ভাষা বুঝে সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। ফলে কয়েক লাখ মানুষ ভয়ানক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। কিছুদিন আগে সরকার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা এত দিন তৃতীয় শ্রেণীর পেশাজীবী ছিলেন। মাধ্যমিক স্কুলের অনেক শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন, এটি মাধ্যমিক শিক্ষকদের সঙ্গে ভয়ানক তামাশা। কেউ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে এটিকে শিক্ষকদের সঙ্গে নজিরবিহীন প্রতারণা বলে উল্লেখ করেছেন। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলেছেন, মাধ্যমিক শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার ডিগ্রি অথবা স্নাতকসহ মাস্টার ডিগ্রিধারী। মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে কি শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণীর পেশায় যোগ দিয়েছিলেন? শিক্ষকদের দ্বিতীয় যুক্তি হলো, মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকে শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছেন। সিথানের মরণকাঠির প্রভাবেই কি তাহলে সরকার এমন তালগোল পাকানো ঘোষণা দিল? স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পদ্মা সেতু নির্মিত না হলে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের অবস্থান যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হতো এর চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন এবং এ নিয়ে সরকারের তুঘলকি কর্মকাণ্ডে। যদি ধরেও নিই, পদ্মা সেতুতে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি, এর পরও দুর্নীতির প্রচেষ্টার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগ দেশ এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য কি মঙ্গলজনক হতো না? আমাদের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর দেশপ্রেম জাগ্রত হতে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পদত্যাগ করতে একটু বেশিই সময় লেগে গেল না কি? দেরিতে হলেও এটি অবশ্য আমাদের ইংরেজি ব্যাকরণ শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা লাভ বয়ে এনেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে 'ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল' এই একই ইংরেজি ট্রান্সলেশন করতে করতে ইংরেজি ব্যাকরণ যখন ভীষণ একঘেয়েমিতে ভুগছিল, মন্ত্রীর বিলম্বিত পদত্যাগের মাধ্যমে তা থেকে মুক্তির একটা পথ পাওয়া গেল। ইংরেজি ট্রান্সলেশনে এখন সংযোজন হতে পারে 'মন্ত্রীর দেশপ্রেম জাগ্রত হইবার পূর্বেই দেশের সর্বনাশ হইয়া গেল' কিংবা 'আবুল হোসেন পদত্যাগ করিবার পূর্বেই আওয়ামী লীগের ইমেজ ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া গেল।' মরণকাঠির ইন্দ্রজালের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হয়তো এই তথ্য পৌঁছায়নি যে পদ্মা সেতু নিয়ে নষ্টামির বিতর্ক ওঠার অনেক আগে থেকেই আবুল হোসেন ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-হেলপারদের মুখের পরিভাষা হয়ে উঠেছিলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি, বাসের হেলপার ড্রাইভারকে চিৎকার দিয়ে বলছে, 'ওস্তাদ ডাইনে প্লাস্টিক, বাঁয়ে আবুল।' হেলপারকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি প্লাস্টিক মানে প্রাইভেট কার আর আবুল মানে রাস্তার খানা-খন্দ। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা শেষে বিশ্বব্যাংকের শর্তপূরণের পথে হাঁটা আগুন নিয়ে খেলার সমতুল্য নয় কি? সরকারের এই দ্বিচারিতায় যদি মালয়েশিয়া সরকার আহত বোধ করে এবং ক্ষুব্ধ হয় তা কি আরেক সর্বনাশ ডেকে আনবে না? মানুষ বলে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার তো এর চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ছিল। তবে কী কেউ মরণকাঠির ইন্দ্রজালে আটকে অদক্ষতাকে সরকারের আড়াল করে সরকারকে অযোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করছে?
সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে গ্যালপের জরিপে উঠে এসেছে, তিন-চতুর্থাংশ জনগণের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রয়েছে। প্রশ্ন হলো, গ্যালপের জরিপ যে মরণকাঠির ইন্দ্রজালের অংশ নয় তা কি নিশ্চিত হওয়া গেছে? সরকার নিজেই তো নানা সময়ে অভিযোগ করেছে যে সরকারের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে। তা ছাড়া ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা প্রকাশ আর তাঁর সরকারের ওপর আস্থা প্রকাশ এক নয়। আবুল হোসেনের বিলম্বে পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের যুক্তি হতে পারে চলমান নেতিবাচক, আক্রমণাত্মক ও প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের পত্রপাঠ মাত্র আবুল হোসেনকে বিদায় দিলে বিএনপি এটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ভয়ংকর ইস্যুতে পরিণত করত। অন্যায় ফায়দা লোটার চেষ্টা করত।
বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার 'অ্যাসেট রিকুভারি হ্যান্ডবুক' শীর্ষক যৌথ প্রকাশনার ৫৩ ও ১৯৬ পৃষ্ঠায় বিরোধীদলীয় নেতার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। হাওয়া ভবনের হাওয়াই তেলেসমাতি জনসাধারণের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বংলাদেশ থেকে যে হারে অর্থ পাচার হয়েছে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এর চেয়ে অনেক বেশি হারে পাচার হয়েছে। এ ১০ বছরের মধ্যে বিএনপি বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে মহাজোট সরকারের অবস্থান হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকার কারণে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও নির্বাচন থেমে থাকবে না। সরকারের ধারণা, বিএনপি না এলেও এরশাদের জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। এ ধরনের আত্মঘাতী পরিকল্পনার পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। তা ছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওপর আস্থা রাখাও কি সমীচীন হবে?
আজকের লেখা পড়ে কোন দল আমার ওপর বেশি ক্ষুব্ধ হবে জানি না। তবে ক্ষোভ নিবারণে সহায়ক একটি গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। বরফজমা শীতের মধ্যে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পাখিটির উড়তে খুব কষ্ট হচ্ছিল। একপর্যায়ে পাখিটির ডানায় বরফ জমে যায়। ডানা ঝাপটাতে না পেরে পাখিটি একটা মাঠের মধ্যে পড়ে যায়। পাখিটি মাঠের মধ্যে পড়ে অসহ্য শীতে মৃত্যু যন্ত্রণায় যখন ছটফট করছিল তখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটি গরু তার ওপর প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করে। সদ্যোপতিত গোবরের উষ্ণতায় পাখিটি সুস্থ হয়ে ওঠে। হঠাৎ পাওয়া উষ্ণতায় পাখিটি আনন্দিত হয়ে গান গাইতে শুরু করে। এমন সময় মাঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া বিড়ালের কানে গানের আওয়াজ ভেসে আসে। বিড়ালটি অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয় গোবরের নিচ থেকে গানের আওয়াজ আসছে। বিড়ালটি গোবরের নিচ থেকে পাখিটিকে টেনে বের করে খেয়ে ফেলে। মরাল অব দ্য স্টোরি হলো, যারা তোমার ওপর শিট নিক্ষেপ বা (সমালোচনা) করে তারা প্রত্যেকেই তোমার শত্রু নয়। যারা শিটের ভেতর থেকে তোমাকে টেনে বের করে তারা প্রত্যেকেই তোমার বন্ধু নয়। এবং তুমি যখন গভীর সংকটে পড়ো তখন মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয়।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
zhossain@justice.com

No comments

Powered by Blogger.