শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে শিক্ষক সমিতি ॥ বুয়েটে আল্টিমেটাম- ০ ভিসি ও প্রোভিসির পদত্যাগ দাবি- ০ পদত্যাগ না করতে অটল ভিসি- ০ আন্দোলনে নতুন মোড়- ০ মৌলবাদীদের দাপট by বিভাষ বাড়ৈ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক নমনীয়তার সুযোগে খোদ উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করেই সমমনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামলেন বুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতারা। শিক্ষক সমিতির খোলস পাল্টে বিতর্কিত সেই নেতারাই ‘বুয়েট পরিবার’-এর ব্যানারে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে দিনভর মিছিল এবং
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অফিস-বাসভবন ঘেরাও করেছেন। শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অফিসে প্রবেশ করে তাৎক্ষণিক পদত্যাগের জন্য হুমকিও দিয়েছেন। এক পর্যায়ে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে আজ সকাল ১০টায় আবার মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। এদিকে আদালত, সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তিকর লিফলেট বিলি এমনকি শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে উগ্র মৌলবাদীদের একচেটিয়া দাপটে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। ইতোমধ্যেই উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য অপসারণ করে সরকারের দালাল এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতাদের দেখে নেয়া হবে বলে হুমকিও দেয়া হয়েছে। যদিও শিক্ষক নেতারা বিতর্ক এড়াতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলছেন, ‘সরকার বিরোধী নয়, এটা বুয়েট রক্ষার আন্দোলন।’
তবে অভিযোগ উঠেছে ‘বুয়েটের ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে চলছে বুয়েট অচলের পরিকল্পনা।’ গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে সতর্ক করে অন্তত চার মাস আগে এমন রিপোর্ট দেয়ার পরেও নেয়া হয়নি কোন কার্যকর পদক্ষেপ। বরং আদালতে অভিযুক্ত হলেও শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিবৃত্ত রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেয়ার পরেও অভিযুক্ত শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বিষয়ে শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল দর্শকের ভূমিকায়। এছাড়া সিন্ডিকেট, বুয়েট কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিচার বিভাগীয় কমিশনের দাবি দুই মাস ধরে করে আসলেও রহস্যজনকভাবে নীরব শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর এই সুযোগেই সাধারণ অনেক শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করে অনায়াসে ফায়দা লুটছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরপন্থী শিক্ষক সমিতি কেবল প্রগতিশীল শিক্ষক হওয়ার কারণে উপাচার্যকে হটানোর যে ঘোষণা দিয়েছিল যে কোন মূল্যে তা বাস্তবায়ন করতেই এবারের আন্দোলন। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পরেও সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের রেপরোয়া কর্মকা-ের বিষয়ে কঠোর অবস্থান না নেয়ার ফলেই সঙ্কট বড় আকার নিয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। তাঁরা হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পরেও শিক্ষক নেতার প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো এবং জামায়াত নেতা গোলাম আযমের সাবেক বডিগার্ড ও তার স্ত্রীর হলে হলে তৎপরতার বিষয়ে কঠোর অবস্থান না নেয়ার কারণেই আজ অযৌক্তিক আন্দোলনও বড় রূপ নিয়েছে। সাধারণ অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, কোন ব্যক্তিকে কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া কেবল গায়ের জোরে শাস্তি দেয়া যায় না। অথচ শিক্ষক সমিতি সংগঠনকে পুঁজি করে তাই করতে চাচ্ছে, যা সন্তানকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো এক ধরনের অপরাধ। শনিবার ক্যাম্পাসের ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদালতের আদেশ অনুসারে ভর্তি পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতেই শুক্রবার বুয়েট শিক্ষক সমিতি, সাধারণ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিঠি দেয় কর্তৃপক্ষ। আজ সোমবার ভর্তি পরীক্ষার জন্য একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক হওয়ার কথা। তবে আদালতের আদেশ অমান্য করেই গত তিন দিন ধরে বৈঠক ঠেকাতে মাঠে নামেন কয়েক শিক্ষক নেতা। আদালত ও সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তিকর লিফলেট বিলির পর শিক্ষক সমিতির সেই আলোচিত সহ-সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী, ড. মাহবুব রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া, ড. এহসান, ড. মাসুদ, হুমায়ুন কবীরসহ কয়েক নেতা গত দুদিন ধরে ফেসবুক ও মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামানোর আহ্বান জানান।
একই সঙ্গে সাধারণ শিক্ষক ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের হুমকি দিয়ে বলেন, কেউ সরকার ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসলে তার সমস্যা হবে। পুরো কর্মকা-ে এবার সমিতির সভাপতি নমনীয় থাকলেও সক্রিয় হন সেক্রেটারি অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান। আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদালত ভর্তিসহ শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর জন্য আদেশ দেয়ায় এবার সমিতির নেতারা শুরু থেকেই ‘বুয়েট পরিবার’-এর ব্যানারে সক্রিয় হন। পরিকল্পনা অনুসারেই শনিবার দুপুর ১১টার দিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফের আন্দোলনে নামেন তাঁরা। সকাল থেকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলের পর দুপুর ১টার দিকে উপাচার্যের বাড়ির সামনে তাঁরা অবস্থান নেন। উপাচার্যের বাসভবন বেলা ৩টা পর্যন্ত তাঁরা ঘেরাও করে রাখেন। এদিকে কয়েক শিক্ষক নেতা ‘এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হবে’ এমন দাবি নিয়ে প্রবেশ করেন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অফিসে। তাঁরা দু’জনেই এতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর তাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন। তাই রাষ্ট্রপতিই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। এ সময় শিক্ষক নেতারা এক ঘণ্টা সেখানেই অবস্থান নেন। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী সেখানে প্রবেশ করেন। তাতে শিক্ষক নেতারা আপত্তি তুললে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বের হয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বলেন, আসলে আন্দোলনকারীরা চাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগরের মতো এখানেও কিছু একটা ঘটুক। পরে ছাত্রলীগের ওপর দোষ চাপিয়ে সঙ্কট তৈরি করবেন। অন্যদিকে শিক্ষক নেতাদের নেতৃত্বেই উপচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে থাকে শিক্ষার্থীরা। তারা ঘোষণা দেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় আরও কঠোর আন্দোলন। আদালতের আদেশের বিষয়ে পরিকল্পনা অনুসারে তাঁরা উত্তর দেন, আদালত তো শিক্ষকদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলেছেন, আমাদের না। আর শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমানের উত্তর, সমিতি কোন আন্দোলন করছে না, যাঁরা করছেন তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা করছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম আবারও বলেছেন, আমি তো কোন অন্যায় করিনি। কোন অপরাধ পাওয়া যায়নি। একটি অভিযোগও যদি প্রমাণিত হয় তাহলে যে কোন শাস্তি আমি মেনে নেব।
এদিকে আদালত, সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তিকর লিফলেট বিলি ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে উগ্র মৌলবাদীদের একচেটিয়া দাপটে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। উপাচার্য ও উপাচার্যের অপসারণ করে সরকারেরর দালাল এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতাদের দেখে নেয়া হবে বলে হুমকিও দেয়া হয়েছে। তবে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বুয়েটে প্রগতিশীল শক্তির সঙ্কটের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছেন তাঁরা। এক শিক্ষক রাতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হতাশার সুরে বলেন, আজ বুয়েটে আমাদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অবস্থা এমন হবে যে, ভবিষ্যতে বুয়েটে কেউ ভয়েও আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেবে না। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পবেন না। সতর্ক করার পরেও অভিযুক্তদের বিষয়ে সরকারের নমনীয়তায় অবাক গোয়েন্দা সংস্থার কর্তকর্তারাও। প্রগতিশীল শক্তির এই আক্ষেপের কথা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, প্রায় চার মাস আগে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রগতিশীল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের নিয়োগের ফলে জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীর প্রভাবিত শিক্ষক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়াই বুয়েটে অস্থিরতার মূল কারণ। অনিয়ম নয়, বরং মহাজোট সরকারবিরোধী মৌলবাদী আদর্শের অনুসারীরা অধিপত্য বিস্তার করতেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বুয়েটকে অশান্ত করছেন। বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির মাত্র ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৮ ভাগ শিক্ষক মোটামুুটি নিরপেক্ষ। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষক সমিতির অধিকাংশই সরকারের ঘোরতর বিরোধী এবং তাঁরাই হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন।
অভিযোগ উঠেছে অধ্যাপক মাহবুব রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়ার বিরুদ্ধে। মাহবুব রাজ্জাক ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের দেহরক্ষী ছিলেন বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই অভিযোগ তোলেন। সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ হিলালী হাফিজুর রহমান রানার বিরুদ্ধে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তুলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, সমিতির অন্যতম নেতা মাসুদ হেলালী সরাসরি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যিনি একাধিকবার সংগঠনের কাজেই দেশের বাইরে সফর করেছেন। এরই মধ্যে রাজধানীতে লিফফেট বিলি করার সময় নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের আটক রাশেদুল ইসলাম রানা ও আহমেদ সাজিদ হাসান শহিদের পক্ষে সাফাই গেয়ে পল্টন থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার অভিযোগ উঠেছে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান ও নেতা অধ্যাপক ড. মোঃ সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান রানা তাঁর ফেসবুক ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেন। স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন তুই বুয়েটকে খাবি.... পারবি না...আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছি শিকারী। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করব, তারপর তোর পেটে। তারপর তোর মাথা কেটে বুয়েটের গেটের সামনে টানিয়ে রাখব। যাতে আর কোন হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না হয়।’
এ ঘটনায় মামলা হলে তদন্ত হয়। ডিবির তদন্তে প্রমাণিত হলে আদালত গ্র্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু তাকে আটক করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান ছিল তাতে ঝামেলা বাড়তে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘এ ধরনের অবস্থানের কারণেই প্রভাষক হাফিজুর রহমান রানা তাঁর ফেসবুক ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার ন্যায় স্পর্দ্ধা দেখায় মর্মে প্রতীয়মান হয়।’
তবে অভিযোগ উঠেছে ‘বুয়েটের ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে চলছে বুয়েট অচলের পরিকল্পনা।’ গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে সতর্ক করে অন্তত চার মাস আগে এমন রিপোর্ট দেয়ার পরেও নেয়া হয়নি কোন কার্যকর পদক্ষেপ। বরং আদালতে অভিযুক্ত হলেও শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিবৃত্ত রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেয়ার পরেও অভিযুক্ত শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বিষয়ে শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল দর্শকের ভূমিকায়। এছাড়া সিন্ডিকেট, বুয়েট কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিচার বিভাগীয় কমিশনের দাবি দুই মাস ধরে করে আসলেও রহস্যজনকভাবে নীরব শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর এই সুযোগেই সাধারণ অনেক শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করে অনায়াসে ফায়দা লুটছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরপন্থী শিক্ষক সমিতি কেবল প্রগতিশীল শিক্ষক হওয়ার কারণে উপাচার্যকে হটানোর যে ঘোষণা দিয়েছিল যে কোন মূল্যে তা বাস্তবায়ন করতেই এবারের আন্দোলন। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পরেও সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের রেপরোয়া কর্মকা-ের বিষয়ে কঠোর অবস্থান না নেয়ার ফলেই সঙ্কট বড় আকার নিয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। তাঁরা হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পরেও শিক্ষক নেতার প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো এবং জামায়াত নেতা গোলাম আযমের সাবেক বডিগার্ড ও তার স্ত্রীর হলে হলে তৎপরতার বিষয়ে কঠোর অবস্থান না নেয়ার কারণেই আজ অযৌক্তিক আন্দোলনও বড় রূপ নিয়েছে। সাধারণ অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, কোন ব্যক্তিকে কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া কেবল গায়ের জোরে শাস্তি দেয়া যায় না। অথচ শিক্ষক সমিতি সংগঠনকে পুঁজি করে তাই করতে চাচ্ছে, যা সন্তানকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো এক ধরনের অপরাধ। শনিবার ক্যাম্পাসের ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদালতের আদেশ অনুসারে ভর্তি পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতেই শুক্রবার বুয়েট শিক্ষক সমিতি, সাধারণ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিঠি দেয় কর্তৃপক্ষ। আজ সোমবার ভর্তি পরীক্ষার জন্য একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক হওয়ার কথা। তবে আদালতের আদেশ অমান্য করেই গত তিন দিন ধরে বৈঠক ঠেকাতে মাঠে নামেন কয়েক শিক্ষক নেতা। আদালত ও সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তিকর লিফলেট বিলির পর শিক্ষক সমিতির সেই আলোচিত সহ-সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী, ড. মাহবুব রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া, ড. এহসান, ড. মাসুদ, হুমায়ুন কবীরসহ কয়েক নেতা গত দুদিন ধরে ফেসবুক ও মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামানোর আহ্বান জানান।
একই সঙ্গে সাধারণ শিক্ষক ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের হুমকি দিয়ে বলেন, কেউ সরকার ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসলে তার সমস্যা হবে। পুরো কর্মকা-ে এবার সমিতির সভাপতি নমনীয় থাকলেও সক্রিয় হন সেক্রেটারি অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান। আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদালত ভর্তিসহ শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর জন্য আদেশ দেয়ায় এবার সমিতির নেতারা শুরু থেকেই ‘বুয়েট পরিবার’-এর ব্যানারে সক্রিয় হন। পরিকল্পনা অনুসারেই শনিবার দুপুর ১১টার দিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফের আন্দোলনে নামেন তাঁরা। সকাল থেকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলের পর দুপুর ১টার দিকে উপাচার্যের বাড়ির সামনে তাঁরা অবস্থান নেন। উপাচার্যের বাসভবন বেলা ৩টা পর্যন্ত তাঁরা ঘেরাও করে রাখেন। এদিকে কয়েক শিক্ষক নেতা ‘এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হবে’ এমন দাবি নিয়ে প্রবেশ করেন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অফিসে। তাঁরা দু’জনেই এতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর তাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন। তাই রাষ্ট্রপতিই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। এ সময় শিক্ষক নেতারা এক ঘণ্টা সেখানেই অবস্থান নেন। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী সেখানে প্রবেশ করেন। তাতে শিক্ষক নেতারা আপত্তি তুললে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বের হয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বলেন, আসলে আন্দোলনকারীরা চাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগরের মতো এখানেও কিছু একটা ঘটুক। পরে ছাত্রলীগের ওপর দোষ চাপিয়ে সঙ্কট তৈরি করবেন। অন্যদিকে শিক্ষক নেতাদের নেতৃত্বেই উপচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে থাকে শিক্ষার্থীরা। তারা ঘোষণা দেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় আরও কঠোর আন্দোলন। আদালতের আদেশের বিষয়ে পরিকল্পনা অনুসারে তাঁরা উত্তর দেন, আদালত তো শিক্ষকদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলেছেন, আমাদের না। আর শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমানের উত্তর, সমিতি কোন আন্দোলন করছে না, যাঁরা করছেন তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা করছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম আবারও বলেছেন, আমি তো কোন অন্যায় করিনি। কোন অপরাধ পাওয়া যায়নি। একটি অভিযোগও যদি প্রমাণিত হয় তাহলে যে কোন শাস্তি আমি মেনে নেব।
এদিকে আদালত, সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তিকর লিফলেট বিলি ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে উগ্র মৌলবাদীদের একচেটিয়া দাপটে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। উপাচার্য ও উপাচার্যের অপসারণ করে সরকারেরর দালাল এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতাদের দেখে নেয়া হবে বলে হুমকিও দেয়া হয়েছে। তবে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বুয়েটে প্রগতিশীল শক্তির সঙ্কটের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছেন তাঁরা। এক শিক্ষক রাতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হতাশার সুরে বলেন, আজ বুয়েটে আমাদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অবস্থা এমন হবে যে, ভবিষ্যতে বুয়েটে কেউ ভয়েও আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেবে না। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পবেন না। সতর্ক করার পরেও অভিযুক্তদের বিষয়ে সরকারের নমনীয়তায় অবাক গোয়েন্দা সংস্থার কর্তকর্তারাও। প্রগতিশীল শক্তির এই আক্ষেপের কথা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, প্রায় চার মাস আগে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রগতিশীল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের নিয়োগের ফলে জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীর প্রভাবিত শিক্ষক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়াই বুয়েটে অস্থিরতার মূল কারণ। অনিয়ম নয়, বরং মহাজোট সরকারবিরোধী মৌলবাদী আদর্শের অনুসারীরা অধিপত্য বিস্তার করতেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বুয়েটকে অশান্ত করছেন। বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির মাত্র ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৮ ভাগ শিক্ষক মোটামুুটি নিরপেক্ষ। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষক সমিতির অধিকাংশই সরকারের ঘোরতর বিরোধী এবং তাঁরাই হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন।
অভিযোগ উঠেছে অধ্যাপক মাহবুব রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়ার বিরুদ্ধে। মাহবুব রাজ্জাক ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের দেহরক্ষী ছিলেন বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই অভিযোগ তোলেন। সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ হিলালী হাফিজুর রহমান রানার বিরুদ্ধে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তুলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, সমিতির অন্যতম নেতা মাসুদ হেলালী সরাসরি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যিনি একাধিকবার সংগঠনের কাজেই দেশের বাইরে সফর করেছেন। এরই মধ্যে রাজধানীতে লিফফেট বিলি করার সময় নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের আটক রাশেদুল ইসলাম রানা ও আহমেদ সাজিদ হাসান শহিদের পক্ষে সাফাই গেয়ে পল্টন থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার অভিযোগ উঠেছে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান ও নেতা অধ্যাপক ড. মোঃ সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান রানা তাঁর ফেসবুক ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেন। স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন তুই বুয়েটকে খাবি.... পারবি না...আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছি শিকারী। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করব, তারপর তোর পেটে। তারপর তোর মাথা কেটে বুয়েটের গেটের সামনে টানিয়ে রাখব। যাতে আর কোন হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না হয়।’
এ ঘটনায় মামলা হলে তদন্ত হয়। ডিবির তদন্তে প্রমাণিত হলে আদালত গ্র্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু তাকে আটক করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান ছিল তাতে ঝামেলা বাড়তে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘এ ধরনের অবস্থানের কারণেই প্রভাষক হাফিজুর রহমান রানা তাঁর ফেসবুক ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার ন্যায় স্পর্দ্ধা দেখায় মর্মে প্রতীয়মান হয়।’
No comments