বিদেশে ঈদ বাণিজ্য :অনুপস্থিত বাংলাদেশ by শামীম আজাদ

শেষ রোজায় চন্দ্র রজনীতে এখানে একসঙ্গে প্রথম হুলস্থূলটা শুরু করে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। বিচিত্র এক সম্মিলিত সুরেলা হুঙ্কারে নজরুলকে নিয়ে তারা গোটা ইউরোপবাসীর ড্রইংরুমে লাফিয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায়_ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ আপনাকে আজ বিলিয়ে দেবার আসমানী তাগিদ।


তা আসমানী তাগিদ বা 'ইসলাম' বাণিজ্যের তাগিদ অথবা বিলেতি পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিক্রিয়ার তাগিদ যা-ই হোক না কেন_ সব মিলেই ইংল্যান্ডের ঈদ হয়ে উঠেছে এক মহাপরাক্রমশালী ইসলামী পার্বণ। ঈদমেলা, ঈদ ধামাকা, ঈদবাজার, ঈদমেহেদি, ঈদফ্যাশন, ঈদ রেসিপি ইত্যাদি নামের আয়োজন আর আহাজারিতেই জমে ওঠে ঈদ আনন্দ।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সব প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে গিয়ে ব্রিটেন এক সময় যে উদার নীতি গ্রহণ করেছিল; এ তারই ফল। গুরুদুয়ার, দেয়ালী ও হানুকার বিস্তারের মতো এখন এ দেশেই স্কুল ইউনিফর্মে ইসলামী উর্দি থেকে শুরু করে হালাল খাবার ও হিজাবের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ-মাদ্রাসা এবং নারীদের আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিও উঠছে। এসব উৎসবের দিনে কোনো কোনো অঞ্চলকে চেনাই যায় না যে, এটা বিলেত! ঈদের আগের রাতে লন্ডনের গ্রিন স্ট্রিট, ইলফোর্ড লেন, হোয়াইট চ্যাপেল রূপান্তরিত হয় ছোট ছোট ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে। শুধু এর বিস্তার নয়; সেই সঙ্গে বিলেতেও জন্ম নিয়েছে ইসলামী সন্ত্রাসী। অভিবাসী কানুন ক্রমে কড়া করেও হালে পানি নেই হোম অফিসের।
এক চন্দ্র রজনীতেই বাংলাদেশি নারী-পুরুষরা কেনে বিলেতে আমদানিকৃত চুমকি, জরি লাগানো সিনথেটিক পাকিস্তানি পাজামা-কুর্তা, ভারতীয় শাড়ি ও সালোয়ার, আরবি আলখেল্লা আর ফিলিস্তিনি প্যাটার্নের স্কার্ফ। তারা কেনে না বাংলাদেশি সুতি কিংবা শাল। না কেনে অপেক্ষাকৃত কম দামি টাঙ্গাইলের তাঁত বা মিরপুর সিল্ক। রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত গাড়ির হর্ন, এলোপাতাড়ি আড্ডা, পথে পথে মেহেদি, ঠাণ্ডা শরবত আর কুলফির সঙ্গে আসে ভিনদেশি ঈদ বাণিজ্যের এক মহাসুযোগও। বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে খোরমা-খেজুর, বাদাম, পেস্তা, সেমাই, মাংস, পান-সুপারি, মেহেদি, মিষ্টি, শাড়ি, সালোয়ার, পাঞ্জাবি ও অন্যান্য পোশাক। এর নগণ্য পরিমাণ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু ভোক্তার সিংহভাগই তারা। বিদেশের ঈদ বাণিজ্যে বাংলাদেশ নেই।
অথচ কেবল বিলেতেই আছে সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ। আর তাদের সবাই এই ঈদে কিনছে একই রকমের পোশাক-পরিচ্ছদ। সবাইকেই লাগে যেন এক পরিবারের বা এক দেশেরই জ্ঞাতি। তাদের বচন শোনা না গেলে তারা যে বাংলাদেশি_ তাও বোঝার উপায় নেই। আর আগে-পিছে 'যাযাকাল্লাহু'র জন্য কখনও তাও বোঝা যায় না। পুরো ইউরোপেই অনুরূপ পরিস্থিতি। বাংলাদেশি সব টেলিভিশনে ওই সব পণ্যেরই বিজ্ঞাপন আর তার বিস্তার। দু'একজন সেলিব্রেটি ছাড়া কেউ পরেন না দেশি পোশাক। তাই ঈদ এলে আমার চিৎকার করে ক্রন্দন আসে। আমার ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার জীবনঘষা আগুনেই তিন দশক আগে আমাদের দেশে যে দেশি ফ্যাশনের চল শুরু হয়েছিল; প্রায় এক দশকের কঠিন পরিশ্রমে, সাপ্তাহিক বিচিত্রার শাহাদত চৌধুরীকে কাণ্ডারী করে; গোটা বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে যে দেশি বস্ত্রের বান ডেকেছিল; আজ তার হাড়ে হাড়ে কেবল হাহাকার শুনি। কারণ এর আশানুরূপ বিস্তার হয়নি।
আগে এখানে আড়ং ছিল, এখন নেই। নিভু নিভু করে জ্বলছে নগরদোলা আর মিতালী। যারা স্বকীয়তা বজায় রাখতে চান, তারা দেশ থেকে পোশাক আনিয়ে নেন অথবা ওই ক'টি দোকানেই ভিড় করেন। স্ট্রিট মার্কেটে বাংলাদেশি পোশাক বিক্রেতাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, আপা, আমাদের দেশি শাড়ির কম দাম। তাদের ঈদ বাজেট অনেক। এত কম দামে তারা ঈদ করবে না। এটা একটা কথা হলো?
আমি চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠানে সাবিনা ইয়াসমীন ও রুনা লায়লার গায়ে চুমকি, জরির প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে দেশে ফোন করেছিলাম। সে আমার স্নেহভাজন এক বিখ্যাত ডিজাইনার। বলেছিলাম, 'ওরা যা পরবেন তাই তো ফ্যাশন হয়ে যাচ্ছে! তাদের কেন দেশি শাড়ি দাও না? তোমাদের বিজ্ঞাপনও তো হয়।' উত্তরে সেও অনুরূপ কথাই বলেছিল। তারা একটা নির্দিষ্ট দামের নিচে শাড়ি পরেন না। এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আর আগে না হলেও আজকাল সাবিনা ইয়াসমীনকে দেখছি, তিনি পরছেন দেশি শাড়ি। কী যে মনোহর লাগছে!
এ দেশে ঈদ বাণিজ্য মৌসুমে এখন মূলধারার বিপণিকেন্দ্রও মনোহর হয়ে ওঠে এথনিক সাজে। বিলেতে বসবাসকারী অনাবাসী মানুষের সব সাধ পূর্ণ করতে এরা এমন ব্যবসা করেন যে, এটি হয়ে উঠেছে এ দেশের ক্রিসমাসের মতোই আরেকটা ব্যবসা মৌসুম। এখন খাঁটি ব্রিটিশ সুপার মার্কেটগুলোর 'এশিয়ান' র‌্যাকগুলোও ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি পণ্যে। সেখানেও আমরাই মূল খদ্দের হলেও মূল বাণিজ্য হচ্ছে অন্যদের। অথচ কাঁঠাল থেকে শুরু করে কবুতর, শাক, শুঁটকিসহ তিব্বত স্নো, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি_ সবই কিন্তু আসছে। এসবের ক্রেতা মূলত বাংলাদেশিরাই। এমনকি দেশের মানুষ এখন বিলেতে বেড়াতে এসে বলেন, একটু কৈ-কাতল আর পেটলা পাবদা, সরপুঁটি খাওয়াও দেখি! দেশের সব মাছ তো তোমরা বিদেশিরাই খেয়ে ফেলছ হে! সত্যি এ এক বিশাল বাণিজ্য এখন! একে কেন্দ্র্র করে ইবকো ফুড, ক্রাউন তো ব্যবসা-বাঘ হয়ে গেছে। দেশে বসেছে ফ্যাক্টরি আর এখানে হচ্ছে কর্মসংস্থান। পরিবর্তনটা এলো না পোশাকের ক্ষেত্রে।
নারী এশিয়ান ম্যাগাজিন জামদানি নিয়ে এমন উদ্যোগ নিতে চলেছে। কিন্তু প্রমোশনের
সঙ্গে সরবরাহ নিশ্চিত করাটাও কঠিন কাজ। বিদেশে দেশি পোশাক প্রচলনের উজ্জীবনী মহান ভূমিকাটা একযোগে দেশি ফ্যাশন হাউস, বিলেতের টিভি, সংবাদপত্র এবং ব্যবসায়ী, বিলেতি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিলে এ কাজটা করতে হবে। আমার ধারণা, দেশে দেশি প্রচলনের জন্য আমরা যেভাবে একযোগে সবাই সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করেছি, এখানেও তা করার সুযোগ আছে। সঙ্গে
করতে হবে আরও অনেক কাজ। না হলে আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি চলে যাবে আমারই আঙিনা দিয়া!

শামীম আজাদ :কবি, কলাম লেখক
ও শিক্ষাবিদ
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.