সিডও সনদের ধারা সংরক্ষণ-ধরি মাছ না ছুঁই পানি

মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূরীকরণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সিডও সনদ গৃহীত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর। কার্যকর হয় ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও সনদ অনুমোদন করে। কিন্তু আজও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা পূর্ণ অনুমোদন হয়নি।


কেন? বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন সাকিলা মতিন মৃদুলা

কী আশ্চর্য! ধরি মাছ না ছুঁই পানি! বিশাল সমুদ্রে ছোট্ট চোরাবালি। পা ফসকে পড়ে না গেলে কিছুই না। কিন্তু হঠাৎ যদি পা ফসকেই যায় তবে ফেরার আর পথ নেই। 'নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ আর বাংলাদেশ'_ সম্পর্কটা বলা যায় এমনই। সনদের সঙ্গে আছি আবার নাই। অনুমোদনও করছি আবার কিছু কিছু সংরক্ষণও করছি। নাচতে নেমে ঘোমটা টানা। ৩০টি ধারার মাত্র দু-একটি। নাইবা করলাম অনুমোদন। কী এসে যায় তাতে? কিন্তু এখানেই তো চোরাবালি। পা আটকালে ডুবে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
'নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ' ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, ্তুঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ অষষ ঋড়ৎসং ড়ভ উরংপৎরসরহধঃরড়হ অমধরহংঃ ডড়সবহ্থ সংক্ষেপে ঈঊউঅড। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরও প্রয়োজন হয় আলাদা করে নারীর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সিডও সনদ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয় সিডও সনদ। একজন মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূরীকরণে এ সনদ এক রক্ষাকবচ। সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডও বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৮৫টিরও বেশি দেশ সিডও সনদ অনুমোদন বা গ্রহণ করেছে। সিডও সনদ অনুমোদনের এক বছরের মধ্যে এবং পরবর্তী সময়ে ৪ বছর অন্তর সিডও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জাতীয় প্রতিবেদন জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে পেশ করার বিধান রয়েছে। সিডও সনদ ৩০টি ধারা সংবলিত। এই ৩০টি ধারা তিন ভাগে বিভক্ত। ১ থেকে ১৬ ধারা_ নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কিত, ১৭ থেকে ২২ ধারা_ সিডও কর্মপন্থা ও দায়িত্ব বিষয়ক, ২৩ থেকে ৩০ ধারা_ সিডও প্রশাসন সংক্রান্ত। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও সনদ অনুমোদন করে। কিন্তু প্রথম থেকেই ছিল সংরক্ষণ। বাংলাদেশ ১৩(ক) এবং ১৬-১(চ)_ এই দুটি ধারায় প্রথমে সংরক্ষণ আরোপ করে। পরে এসব ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে তা অনুমোদন করে। কী ছিল সেখানে? ধারা ১৩(ক)তে বলা হয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নারীর বৈষম্য দূরীকরণে পারিবারিক কল্যাণের অধিকারের কথা। ১৬-১(চ)তে অভিভাবকত্ব, প্রতিপালকত্ব, ট্রাস্টিশিপ ও পোষ্য সন্তান গ্রহণ এবং বিরাজমান আইনের ধারায় শিশুদের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের বিষয়ে বলা আছে। শুরু থেকেই কোথায় একটা কিন্তু! গলায় আটকে যাওয়া কাঁটার মতো। না পারা যায় গেলা, না পারা যায় ফেলা। দেব কিন্তু কিছু রেখে দেব। কেন এই প্রবণতা? যুক্তি কী? জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কিংবা বিরুদ্ধাচরণ তো নয়। তবে কেন সুযোগ সন্ধানীদের প্রশ্রয় দেওয়া? ফোকর পেলেই যে নারীর স্বাধীনতাবিরোধীরা জেঁকে বসবে। বাংলাদেশ তো সুযোগ সন্ধানীদের আশ্রয় কিংবা প্রশ্রয় কোনোটাই দেয় না। ইতিহাস তো তাই বলে।
এ তো গেল শুরুর কথা। আর বর্তমান? ১৯৮৪ থেকে ২০১২। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সিডও সনদের ধারা-২ এবং ১৬-১(গ) থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করেনি। আপত্তি থাকতেই পারে। কিন্তু কেন? যৌক্তিকতা থাকতে হবে তো! কী আছে ধারা-২ এবং ১৬ ১(গ)তে? ধারা ২ হলো বৈষম্য বিলোপের নীতি। বৈষম্য বিলোপের নীতি হিসেবে এখানে জাতীয় আইন ও সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার নীতিকে বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যাতে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে না পারে সে জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ আদালতের উপযুক্ত দায়বদ্ধতার কথাও এখানে বলা হয়েছে। এমনকি যেসব জাতীয় দণ্ড বিধান নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেগুলোও বাতিলের কথা বলা হয়েছে। ধারা-১৬-১(গ)তে বলা হয়েছে, বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদকালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করার কথা। এই নীতিতেই যদি আপত্তি থাকে তবে আর কিসের জন্য বৈষম্য বিলোপ আর কেনই বা নারীর অধিকার আদায়ে এত প্রহসন? তবে কি বাংলাদেশে নারীর অধিকার আদায় প্রচেষ্টায় দোমনা?
বাংলাদেশে সিডও সনদের ধারা সংরক্ষণের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এগুলো মুসলিম আইনের পরিপন্থী। কিন্তু কেন এবং কিসের ভিত্তিতে সংরক্ষিত ধারাগুলোকে মুসলিম আইনের পরিপন্থী মনে করা হচ্ছে, তা আজও অস্পষ্ট। বাংলাদেশে মুসলিম আইনের দ্বারা কেবল মুসলমান পারিবারিক আইন পরিচালিত হয়। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় অন্য কোনো ক্ষেত্রে মুসলিম আইন প্রযোজ্য নয়। আর যদি পরিপন্থী হয়েও থাকে, সে ক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইনও অপরিবর্তনযোগ্য কিছু নয়। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। তা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকরা কেন অধিকার বঞ্চিত হবে? তাদের সংখ্যাও তো কম নয়, যারা মুসলিম আইনের আওতার বাইরে। সিডও পূর্ণ অনুমোদনকারী মুসলিম বা মুসলিমপ্রধান দেশের মধ্যে রয়েছে আজারবাইজান, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, ক্যামেরুন, গ্যাবন, গাম্বিয়া, গিনি বিসাউ, ইন্দোনেশিয়া, মালি, সেনেগাল, সিয়েরালিওন, উগান্ডা, ইয়েমেন, বসনিয়া হার্জেগোভিনা ইত্যাদি। এ ছাড়া যেসব দেশে শরিয়া আইন প্রচলিত আছে, সেসব দেশও সিডও সনদের কোনো ধারা সংরক্ষণ করেনি। যেমন_ কুয়েত, ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, ইয়েমেন, তুরস্ক, নাইজিরিয়া, তাঞ্জানিয়া, সেনেগাল। এমনকি পাকিস্তান, মালদ্বীপ এবং সৌদি আরবও ২নং ধারায় আপত্তি জানায়নি। তাই ধর্মীয় আইনের অজুহাতে ধারা সংরক্ষণ একেবারেই অযৌক্তিক। ধারা সংরক্ষণের এ প্রবণতা বরং নারী-পুরুষের সমতার সাংবিধানিক নীতিকেই লঙ্ঘন করে। বাংলাদেশের এ সংরক্ষণের প্রবণতায় সিডও সনদের পথচলা হয়তো থমকে যাবে না। কিন্তু থমকে যাবে বাংলাদেশে সিডও সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশ কোনো রকম সংরক্ষণ ছাড়াই বেইজিং কর্মপরিকল্পনা (১৯৯৫) অনুমোদন করে। যেখানে অন্যতম শর্ত হলো, সিডও সনদের ধারা অনুযায়ী আইন সংশোধন কিংবা বাতিল করা।
এক্ষেত্রে সিডও সনদের ধারা সংরক্ষণের প্রবণতা নিছক পরস্পরবিরোধী আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। দৃশ্যত পুরো ঘটনাটাই আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপের প্রচেষ্টা আকাশে উড়ছে ঘুড়ির গতিবেগে। অন্যদিকে বৈষম্য বিলোপ সনদের ধারা সংরক্ষিত আছে নাটাইয়ে সুতোর মধ্যে। ভুলে গেলে চলবে না, এক সময় ঘুড়িও গোত্তা খেয়ে নাটাইয়ের সুতো থেকে ছিটকে যায়। আপন আনন্দে ঘুরতে থাকে খোলা আকাশে। হ
 

No comments

Powered by Blogger.