সোনালী ব্যাংকে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি-দায় পর্ষদের, পুনর্গঠন দাবি

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বেসরকারীকরণ করা। এ দুটি সংস্থা থেকে ক্রমাগত চাপ থাকলেও সরকারি মালিকানার তিনটি ব্যাংককে কম্পানি (করপোরেটাইজ) করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারগুলোর দ্বিধা ছিল। সে কাজটি করল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।


২০০৭ সালে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আলাদা লাইসেন্স দেওয়া হয় রাষ্ট্র খাতের এ তিনটি ব্যাংককে। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ ও ফার্মসে পিএলসি হিসেবে এদের নিবন্ধন হয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সরকারের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পর তখনকার অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছিলেন, 'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব ব্যাংক কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা দিতে পারেনি। আশা করি, এখন থেকে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং দক্ষতা বাড়াতে সক্ষম হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও আশা করেছিলেন, এ চুক্তির ফলে এসব সরকারি ব্যাংক বেসরকারি খাতের অন্য ব্যাংকগুলোর মতো পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত হবে। ব্যাংক কম্পানি আইনের আওতায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে পরিচালিত হবে এদের সার্বিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু পাঁচ বছর পর দেখা গেল, ব্যাংকগুলোর নামের শেষে লিমিটেড যোগ হওয়া ছাড়া আর কিছুরই বদল হয়নি। সরকারের হস্তক্ষেপ সব সময়ই ছিল। বরং এখন সেটা আরো বেড়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা গৌণই থেকে গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাত বিভাগ নামে পূর্ণাঙ্গ একটি বিভাগ করে সরকারের সার্বক্ষণিক প্রভাব নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের সমগ্র ব্যাংক খাতে কখনো যা ঘটেনি, সে রকম নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা সম্প্রতি ঘটে গেল সোনালী ব্যাংকে। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ব্যাংকের একটি শাখাতেই আড়াই বছর ধরে সংঘটিত হওয়া অভিনব এ জালিয়াতির ঘটনা সরকারি খাতের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও তদারকি ব্যবস্থা নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। পর পর দুই বছর ধরে বাংলাদেশ যে দুটি আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থার ইতিবাচক মানসনদ পেয়ে আসছে, সোনালী ব্যাংকের এ ঘটনা তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপ নামে একটি কম্পানির নামে-বেনামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার পর রাজধানীর আরো দুটি শাখায়ও একই কায়দায় আরো ৩০০ কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এসব ঘটনার জন্য ব্যাংকটির শাখা থেকে প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত সব স্তরে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি ও ব্যর্থতাকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করলেও সার্বিক কর্মকাণ্ডে পরিচালনা পর্ষদের তদারকির দুর্বলতাকেও বড় করে দেখছেন বিশ্লেষকরা। কেবল সাময়িক বরখাস্ত বা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া নয়, ব্যাপক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পর্ষদ সদস্যদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎকারী হলমার্ক গ্রুপ ও অন্যান্য কম্পানির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিয়ে টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়ার দাবিও জানান তাঁরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা করপোরেটাইজেশনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। সেটি সম্পন্ন করলে সরকারি ব্যাংকগুলোও পুরোপুরি ব্যাংক কম্পানি আইনে পরিচালিত হতো।'
কম্পানিতে রূপান্তরিত করার আগে সরকার তিনজন সচিবকে তিনটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছিল। পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে প্রধান নির্বাহীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার আসার পর পর্ষদ আবার গঠন করা হয়।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, ব্যাংকিং বা অর্থনীতি বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এমন ব্যক্তিদেরও রাজনৈতিক বিবেচনায় পর্ষদের সদস্য করা হয়েছে। এর চেয়েও বড় ক্ষতির কারণ হলো, তাঁদের ব্যাংক পরিচালনার কাজে কোনো দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা না থাকায়।
সোনালী ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে কার দায় কতখানি জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজ বলেন, এটি তদন্তের ব্যাপার। প্রাথমিকভাবে তো ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাই দায়ী। তবে বোর্ডও দায় এড়াতে পারে না। কারণ জালিয়াতির ঘটনাটা তো এক দিনে ঘটেনি। আড়াই-তিন বছর ধরে চলেছে। পর্ষদের তো দায়িত্ব শাখার কর্মকাণ্ড তদারকি করা, পোর্টফোলিও দেখা, সন্দেহভাজন ঋণ শনাক্ত করা। পর্ষদ যদি তাৎক্ষণিকভাবে জানতে নাও পারে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থাকলে এ ঘটনা তাদের নজর এড়াত না। তখন তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারত। জালিয়াতি রোধে পর্ষদ ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ ঘটনায় প্রশাসনিক যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এর পাশাপাশি দণ্ডবিধি অনুযায়ী দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এ ব্যাপারে অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয় আলোচনা করে করণীয় ঠিক করে নিতে পারে বলে তাঁর মত।
যে উদ্দেশ্যে কম্পানি করা হয়েছিল, সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা হয়নি বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। আশা করা হয়েছিল ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করবে, পরিচালনা পর্ষদ পেশাদারি নিয়ে কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন ও তদারকি করবে, তা হয়নি। পর্ষদে সব সময়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় এবার এটি বেশি মাত্রায় হয়েছে। তদারকির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে যতখানি জোর দেওয়া দরকার ছিল, ততখানি হয়নি। দৃশ্যত ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাই ভেঙে পড়েছে।
তবে পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনার সবাই যে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা বলা যাবে না। জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা ব্যবস্থাপনারই হোক বা পর্ষদেরই হোক, সবাইকে শনাক্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ প্রধান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করে ব্যাংকটিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে এর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনার জন্য প্রথমেই দায়ী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আর তাদের নিয়মিত তদারকিতে ব্যর্থতার দায় নিতে হবে পরিচালনা পর্ষদকে। সোনালী ব্যাংকের শতভাগ মালিকানা সরকারের। ফলে সরকার যাঁকে ইচ্ছা তাঁকেই পরিচালক নিয়োগ করতে পারে। এ বিবেচনায় অনেকেই ঢুকে গেছেন বোর্ডে। দলীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা সুবিধাবঞ্চিত, এভাবে তাঁদের পয়সা কামানোর একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়। ব্যাংকের টাকা হলমার্ক একা খায়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই এর ভাগ পেয়েছেন। সন্দেহভাজনদের ধরে রিমান্ডে নিলেই সব তথ্য বের হয়ে আসবে। হলমার্কের বিরুদ্ধেও এখনো কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ কম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণা, মানি লন্ডারিংসহ অনেক মামলা করা যায়। ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এ জালিয়াতিতে সহায়তা করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিটি লেনদেনের জন্য ৪০৯ ধারায় ব্রিচ অব ট্রাস্টের মামলা করতে পারে দুদক।
পর্ষদের সদস্যদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, পরিচালকরা তো মিটিং ভাতা ছাড়া আর কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। পরিচালক হওয়ার আগে তাঁদের কী সম্পদ ছিল আর এখন কী আছে, তা মিলিয়ে দেখতে পারে সরকার।
বেসরকারি ও ব্যাংক খাতের ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় দেশের সার্বিক ব্যাংক খাতে যে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল, সোনালী ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় তা অনেকটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এতে বহির্বিশ্বে লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে পারে। আর্থিক খাতের আস্থা নষ্ট হলে দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইও যেখানে দোষী ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে বোর্ড পুনর্গঠনের কথা বলেছে, সেখানে অর্থমন্ত্রী বাদ সাধছেন; যা আর্থিক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস ব্যাহত করবে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
ভুয়া এলসির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াও শক্ত হবে যার বিরূপ প্রভাব পড়বে ব্যাংকিং খাতে। এ ছাড়া এই ঘটনায় অন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ইমেজ সংকটে পড়া এবং আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সভাপতি ড. সালেহ জহুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলারিটি বডি হিসেবে যেকোনো ব্যাংকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত দিলে তা হবে সাংঘর্ষিক। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় বিচার বিভাগীয় কমিটি করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করা উচিত; না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো অনেক ঘটনা ঘটবে। আর ঘটনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এর সঙ্গে সরকারের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও জড়িত।' তিনি আরো বলেন, 'শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তদন্তে গঠিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে চিহ্নিত কোনো অপরাধীর শাস্তি না হওয়ায় পুঁজিবাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। একইভাবে ব্যাংকিং খাতের এই দুর্নীতির বিচার না হলে পুরো সেক্টরের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। অর্থমন্ত্রীর মতো রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এই রকম অবিবেচকের মতো কথা বলা উচিত নয়।'
ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. মু. সিকান্দার খান বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে প্রশ্ন তুলেছেন তা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এভাবে মূলত তিনি অপরাধীদের উৎসাহিত করেছেন। এটা না বলে বরং উনি আরো আলাপ-আলোচনার কথা বলতে পারতেন। অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্যের কারণে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবে তারা চাইলে নিজেরাই পর্ষদ ভেঙে দিতে পারত। কিন্তু তারা হয়তো নিজের কাঁধে দায়িত্ব রাখতে চায়নি। এ কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর দায়িত্ব দিয়েছে। তাই বলে অর্থমন্ত্রী এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না।'
হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের অনুরোধসহ যেসব উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, সেগুলো যৌক্তিক বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। সম্প্রতি এক বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বোর্ডের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক হান্নানা বেগম বলেন, এ ধরনের জালিয়াতির পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে আরো দ্রুত ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছে পর্ষদ।
এদিকে কিছু নামধারী ব্যবসায়ী ও কিছু দুর্নীতিপরায়ণ ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে অসাধু উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এফবিসিসিআই। যাঁরা ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদারক করতে ব্যর্থ হওয়ায় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে ২৭ আগস্ট অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, নিয়ম অনুসারে ব্যাংকটির পরিচালকদের ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা পালনে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিচালকরা কঠোর হলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল বলেও চিঠিতে দাবি করা হয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী পরদিন বলেন, এ ধরনের কোনো সুপারিশ করার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পরামর্শ দিতেই পারে। অর্থমন্ত্রী কেন তা মেনে নিতে পারেননি, তা বোধগম্য নয়।
ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর। এ পর্ষদের অন্তত দুজন সদস্য রয়েছেন যাঁরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন, আরেকজন সদস্য বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে হেরেছেন। ব্যাংক বা অর্থনীতিতে তাঁদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন ব্যাংকার, যাঁর পরিচিতিতে রয়েছে, তিনি সরকারের মালিকানাধীন বিশেষায়িত কয়েকটি ব্যাংকের প্রধান হিসেবে কাজ করেছিলেন। জানা যায়, ওই ব্যাংকগুলোর সবই ছিল লোকসানি। বিশেষজ্ঞরা আশা প্রকাশ করেছেন, রাষ্ট্র খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটিতে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে নতুন পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধ্বে উঠে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুভাষ সিংহ রায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাইমুম সরওয়ার কামাল এবং মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী রয়েছেন। সেই সঙ্গে মো. শহীদ উল্লাহ মিয়া, মো. আনোয়ার শহীদ, এ এস এম নাইম, কে এম জামান রোমেল, কাশেম হুমায়ুন, সত্যেন্দ্র চন্দ্র ভক্ত ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক ব্যাংকার কাজী বাহারুল ইসলাম ও পদাধিকারবলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে দায়ী করেছেন। প্রতিদিন প্রতিটি শাখার হিসাব ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে আসার পরও দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতির বিষয়টি কিভাবে তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল, সেই প্রশ্নও তাঁরা তোলেন।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরো বলেন, সোনালী ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা দায়ী হলেও রীতি অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদও দায় এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, লিমিটেড কম্পানি হিসেবে সোনালী ব্যাংকের যেভাবে চলার কথা সেভাবে সরকারই চলতে দিচ্ছে না। ব্যাংকিং ডিভিশন করে অর্থ মন্ত্রণালয় তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। এমন ব্যক্তিদেরও বোর্র্ডে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা ছাত্রলীগ করতেন, যাঁদের বয়স কম, এখনো ম্যাচিউরিটি আসেনি। দলীয় মতাদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যেও তো দায়িত্বশীল প্রজ্ঞাবান মানুষ ছিলেন। আশা করি পর্ষদ পুনর্গঠনের সময় সরকার বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত বিভাগটি একসময় উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন সেটি আবার চালু করে আরো পূর্ণাঙ্গ একজন সচিবের অধীনে আলাদা বিভাগ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ বিভাগে ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, এ বিভাগটির তেমন কোনো কাজ নেই। মূলত সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের হস্তক্ষেপ করার একটি হাতিয়ার হিসেবেই এটিকে রাখা হয়েছে। অবশ্য প্রশাসনিক কিছু পদক্ষেপ ছাড়া নীতিনির্ধারণে এ বিভাগের তেমন কোনো ভূমিকা নেই বলেও জানান তিনি।
সরকার নিয়োগ দিলেই যে সব সময় খারাপ হয় তা ঠিক নয় মন্তব্য করে ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিলে একটি প্রতিষ্ঠান সফলভাবে চলতে পারে। আবার একই প্রতিষ্ঠান অনুপযুক্ত ব্যক্তির হাতে পড়লে খারাপ করে। এটি নির্ভর করে সরকারের আন্তরিকতার ওপর। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি চান প্রতিষ্ঠানটি তাঁরা ভালোভাবে চালাবেন, তাহলেই তাঁরা উপযুক্ত লোককে দায়িত্ব দেবেন।

No comments

Powered by Blogger.