স্মরণ- বড় কাকুর কথা by শাওন্তী হায়দার

কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক জিয়া হায়দার আমাদের বড় কাকু। আজ থেকে চার বছর আগে তিনি এই দিনে চলে গেছেন বহু দূরে, না-ফেরার দেশে (২ সেপ্টেম্বর ২০০৮)। বড় কাকু আমাদের পরিবারের মহীরুহ। তাঁর ছায়ায় সবাই বড় হয়েছেন। তিনি ছিলেন এই পরিবারটির কর্তা।


আমার বাবা-চাচাদের কাছে বড় কাকু মানে বাবা, প্রিয়জন, ভাই, আপনজন। শুধু চাচারা কেন? পরিবারের বোন, ভাগনে, ভাগনি, ভাতিজি, ভাতিজা—সবার প্রতিই ছিল তাঁর সমান মনোযোগ। কে কবে কোন ক্লাসে উঠছে, কেমন রেজাল্ট করছে, কোথায় ভর্তি হবে—সবই তিনি জানতে আগ্রহ বোধ করতেন। মনে আছে, একবার চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে আমাদের রেজাল্ট দেখে যাবেন বলে পরের দিন গেলেন। আমাদের দুই বোনের স্কুলের রেজাল্ট দেখে কোথায় ভালো করতে হবে—সব তিনি বুঝিয়ে দিলেন।
বড় কাকু আমাকে গান শেখার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন। আমরা চাচাতো ভাইবোনেরা গানের বেশ ভক্ত। গান শিখলাম সাত বছর ‘সংগীত ভবনে’। কিন্তু চর্চাটা রাখলাম না। এখন অনেক আফসোস হয়, গানটা ছেড়ে দিয়েছি বলে। বড় কাকুর স্বপ্ন পূরণে আমি পুরোপুরি ব্যর্থ।
ছোটবেলা থেকেই শুনতাম, বড় কাকু নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মাঝেমধ্যে বড়দের কথায় বুঝতাম, কোথায় যেন একটা ঝামেলা চলছে। এক দিন শুনলাম, বড় কাকু বাবাকে বলছেন, ‘ওরা (নাগরিকদের সদস্যরা) আমাকে ছাড়াই মিটিং করে।’ খুব দুঃখী, অভিমানী তাঁর সুর। পরে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, আমার বাবা (রশীদ হায়দার) বলতেন, ‘সোনাভাই, (জিয়া হায়দার) আপনি লেখেন।’
বড় কাকুর লেখা তাঁর (থিয়েটারের কথার পাঁচটি খণ্ড) আজ নাট্যকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্যতম প্রয়োজনীয় বই। বড় কাকু অভিমানী ছিলেন কিন্তু কাজেকর্মে কখনো অসফল হননি।
বড় কাকু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাস করার পর ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলায় এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে তোলারাম কলেজে শিক্ষকতার পরে বাংলা একাডেমীতে সংস্কৃতি বিভাগে সহকারী সংস্কৃতি অধিকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। নাট্যকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠাতা তাই বড় কাকু নিজেই। চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এরই ধারাবাহিকতায় জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ খোলা হয়।
বড় কাকুর বেড়ে ওঠা পাবনায়। তাঁর তখনকার বন্ধুরা আজ সমাজে নিজ নিজ ভুবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তখন সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা হলেও পাবনায় বড় কাকু ও তাঁর বন্ধুদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল মুক্তবুদ্ধিচর্চার বিভিন্ন বিষয়। পাবনায় তাঁদের দলটি কবিতা, নাটক, নাট্যচর্চা, প্রবন্ধ, গল্প—সব দিকেই পদচারণে মুখর ছিল।
বড় কাকুর জীবনে সংসার করা হয়নি। কিন্তু এই পুরো পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে তিনি যে তৃপ্তি পেতেন, তা বলে শেষ করার নয়। আমরা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলতাম, তুমি আর কত করবে? বড় কাকুর স্পষ্ট উত্তর, যত দিন পারি।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিবারের সবার জন্য করে গেলেন।
বড় কাকু ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই বলতেন, আরও তিন-চার বছর বাঁচতে চান। ডাক্তারকেও একই কথা বলতেন, ‘তোমরা আমাকে আরও তিন-চার বছর বাঁচিয়ে রাখো, আমার যে কত কাজ বাকি।’
বড় কাকু তাঁর কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে গেছেন চার বছর আগে।
বড় কাকুর মৃত্যুর পর স্মরণসভায় বক্তারা তাঁকে নাট্যাঙ্গনের যুধিষ্ঠির বলে আখ্যায়িত করেন। এটি তাঁর প্রাপ্য সম্মান। স্বাধীনতা-পরবর্তী নাট্যচর্চা, নাট্যকলা শিক্ষায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
বড় কাকুকে প্রায়ই অনুভব করি। নিকট আপনজনের প্রথম মৃত্যু বলে মেনে নিতেও কষ্ট হয়। কিন্তু মানতে তো হবেই।
বড় কাকুর মৃত্যুদিনে তাই আমাদের পরিবারের সবার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি। বড় কাকু, তুমি যেখানেই থাকো, অসম্ভব ভালো থেকো।
শাওন্তী হায়দার
সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.