সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-মেডিকেল কলেজে কেমন শিক্ষার্থী চাই by এবিএম জামাল

মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকদের মান, শিক্ষা প্রক্রিয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে কেমন শিক্ষার্থী আমাদের দেওয়া হচ্ছে সেটাও বিবেচনা করা উচিত। হয়তো একটি বা দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানা সম্ভব নয়।


মুখস্থনির্ভর, নানা পদের পরীক্ষানির্ভর যে নির্বাচন আমাদের এখানে চালু আছে_ আমরা কি নিশ্চিত, এতে সেরা ছাত্রদের পাচ্ছি? এমন তো হচ্ছে না, এক কিংবা দুই নম্বর কম পাওয়ার জন্য অনেক অসাধারণ ভবিষ্যৎ ডাক্তারকে আমরা হারিয়ে ফেলছি

এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীর জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমাদের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয় তারা। বাবা-মা আর অভিভাবকরা সেভাবেই ছেলেমেয়েদের প্রস্তুত করেন। যদিও এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর বড় একটি অংশেরই সে লক্ষ্য পূরণের সুযোগ থাকে না। আগেই ঝরে পড়ে। আর যারা সুযোগ পান ভর্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে তাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে, যে কোনোভাবে হোক একটি ভর্তির সুযোগ করে নেওয়া। বেশ কিছুদিন ধরে সব মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে একই দিনে একই প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি প্রশংসনীয়। অন্ততপক্ষে পরীক্ষার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পান তারা। ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে এসএসসি-এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে মেধা তালিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হয়। একই দিনে ৭৫টি মেডিকেল কলেজের জন্য একটি মাত্র পরীক্ষা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়ে আসছে। যদিও প্রশ্নপত্র ফাঁস, অতিমাত্রায় কোচিং নির্ভরতা এবং ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন নিয়ে কিছু আলোচনা আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। সরকার সম্প্রতি নানা যুক্তি দেখিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে।
আমরা মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা শিক্ষার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ার রকমফেরের চেয়ে কেমন মানের শিক্ষার্থী পাচ্ছি সেটি নিয়েই বেশি সচেতন থাকি। একবার ভর্তি হয়ে গেলে যে কোনোভাবেই হোক তাদের গড়ে-পিঠে ডাক্তার বানানোই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে আমরা চাই মনোযোগী শিক্ষার্থী। অধ্যবসায় আর শৃঙ্খলার মিশেল হয়ে দীর্ঘ ৫টি বছর মানবসেবার মহান ব্রতে দীক্ষিত হবে। রোগ চিকিৎসা তো শিখবেই। যোগ্যতম মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে_ এটি সবার প্রত্যাশা। অন্তত চার থেকে পাঁচটি দশক গৌরবের সঙ্গে চিকিৎসা পেশা চালিয়ে যাবে। এটি মোটামুটি সারাবিশ্বেই প্রমাণিত যে, চিকিৎসা শিক্ষা সব শিক্ষার মধ্যে সবচেয়ে কষ্টসাধ্য শিক্ষা পদ্ধতি এবং এর মূল্যায়ন পদ্ধতি যথেষ্ট মানসম্মত। আমরা শিক্ষকরা চেষ্টা করি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যথাসম্ভব ভালো মানের চিকিৎসক তৈরি করতে। যদিও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং বাজার অর্থনীতির নানা সমীকরণে পড়ে চিকিৎসা শিক্ষা এর গৌরব হারাচ্ছে।
এই যে এত কিছু করে আমরা চিকিৎসক তৈরি করছি, তাদের ভাবমূর্তি সমাজে যে খুব উজ্জ্বল এমন দাবি করব না। নানাভাবে আমাদের চিকিৎসকরা সমালোচিত হচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমালোচনাটা অতিরঞ্জিত। আমরা হয়তো জনপ্রত্যাশা মেটানোর মানের চিকিৎসক তৈরি করতে পারছি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তার সমালোচিত হন তাদের আচরণগত কারণে।
মানুষের আচরণে পরিবর্তন ঘটানো খুব কঠিন কাজ। খুবই নাজুক সমস্যা। এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে যখন রোগীর লোকজন আত্মীয় সেজে কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় রোগীর প্রতি আচরণ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়। পরীক্ষাগুলোতে সরাসরি দেখা হয় রোগীর প্রতি পরীক্ষার্থীর আচরণ কেমন। এর পরও সমস্যা যে থেকে যায় না, তা নয়। লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের মেডিকেল এডুকেশনের অধ্যাপক ক্রিস ম্যাকমেনাস তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৭ বছর পর্যন্ত একজন মানুষের আচরণে পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব। এরপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে একটি প্রবণতা দাঁড়িয়ে যায়। কাজেই মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ব্যাপারটি মেডিকেলে ভর্তির আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে ভর্তি প্রক্রিয়ায় এ ব্যাপারটি সব সময়ই উহ্য রাখা হয়েছে, যা খুব জোরালোভাবে দেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ধরনও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। মানুষের শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক জন বিগস। তিনি দেখিয়েছেন, যারা খুবই সাধারণ মানের চিন্তাস্তরসম্পন্ন শিক্ষার্থী, তারা কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারেন না। পক্ষান্তরে যে শিক্ষার্থী অনুসন্ধিৎসু, বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করতে অভ্যস্ত তারা ভালো করেন। দুঃখজনক হলো, শিক্ষার্থী নির্বাচনের সময় এ বিষয়গুলো দেখার কোনো উপায়ই নেই। প্রশ্নপত্রেও প্রতিফলন থাকে না। সর্বত্রই মুখস্থ বিদ্যার জয়জয়কার। এমন একজন শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজে এসেও মুখস্থ করার অভ্যাস ছাড়বেন না। ভালো ডাক্তার হওয়ার যেটি প্রধান অন্তরায়।
আমরা দেখেছি, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের অন্তত ২৫ শতাংশ নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অভিভাবকদের চাপে পড়ে কিংবা সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে মেডিকেলে ভর্তি হন। তাদের পড়ালেখায় আগ্রহী করে তোলা কঠিন। অনেকে আবার চিকিৎসা শিক্ষার ব্যাপ্তি বুঝতে অক্ষম। যেহেতু আমাদের দেশে কোনো প্রিমেডিকেল শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তারা অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকেন। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। লেখাপড়াটা তাদের কাছে বোঝা মনে হয়। আমাদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় এদিকটাও দেখা উচিত। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরই প্রথমবারের মতো তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। আমরা জানতে পারি, অনেক শিক্ষার্থী বলেও না। চিকিৎসকের বাহ্যিক আকর্ষণই তাদের অনেককে আকৃষ্ট করে। নাম-যশ করা চিকিৎসক হিসেবে গড়ে ওঠার বন্ধুর পথ তাদের অলক্ষ্যেই থেকে যায়। আমরা তো সবাই চাই আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো থেকে ভালো মানের ডাক্তার তৈরি হোক। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ূক। সম্মান ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করুক। মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকদের মান, শিক্ষা প্রক্রিয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে কেমন শিক্ষার্থী আমাদের দেওয়া হচ্ছে সেটাও বিবেচনা করা উচিত। হয়তো একটি বা দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানা সম্ভব নয়। মুখস্থনির্ভর, নানা পদের পরীক্ষানির্ভর যে নির্বাচন আমাদের এখানে চালু আছে_ আমরা কি নিশ্চিত, এতে সেরা ছাত্রদের পাচ্ছি? এমন তো হচ্ছে না, এক কিংবা দুই নম্বর কম পাওয়ার জন্য অনেক অসাধারণ ভবিষ্যৎ ডাক্তারকে আমরা হারিয়ে ফেলছি?

ডা. এবিএম জামাল : সহযোগী অধ্যাপক সার্জারি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
 

No comments

Powered by Blogger.