লন্ডন প্যারালিম্পিক- বুলবুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ!

লন্ডন প্যারালিম্পিকে নেই বাংলাদেশ। তবে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের বুলবুল হোসেন। লন্ডন থেকে লিখেছেন উজ্জ্বল দাশ ক্রীড়া ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো অলিম্পিকের সফল আয়োজক শহর লন্ডন। জমকালো অলিম্পিক উৎসবের রেশ কাটার আগেই গত বুধবার আবার শুরু হয়ে গেছে উৎসব।
যুক্তরাজ্যে নিজ জন্মভূমিতেই লন্ডন প্যারালিম্পিকের শুভ উদ্বোধন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকের সহযোগিতায় যুক্তরাজ্যের স্টক ম্যাডিভ্যাল এলাকায় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের নিয়ে খেলার আয়োজন করেন স্যার ল্যুডিগ গ্যাটম্যান। এর ১২ বছর পর ১৯৬০ সালে ইতালির রোমে ৪০০ প্রতিযোগী নিয়ে গ্যাটম্যানের আয়োজন স্বীকৃতি পায় প্রথম প্যারালিম্পিকের।
২০০৪ সালে এথেন্সে একজন প্রতিযোগী নিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশ নেয় প্যারালিম্পিকে। ২০০৮ বেইজিংয়েও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল। তবে লন্ডন প্যারালিম্পিকে তা নেই। আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় কমিটি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে দেরি হওয়ায় লন্ডন প্যারালিম্পিক থেকে বাদ পড়েছে বাংলাদেশ। পাঠক হয়তো ভাবছেন, দায়টা কার কিংবা অলিম্পিকে অংশ নিয়েই বা কী লাভ? অলিম্পিকে তো বাংলাদেশ ১৯৮৪ সাল থেকেই অংশ নেয়। সম্প্রতি লন্ডন অলিম্পিকে পাঁচ অ্যাথলেটের সঙ্গে ছিল বিশাল সহযোগীর বহর; ফলাফল তো শূন্যই।
আর প্যারালিম্পিক সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো না কোনোভাবে স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছেন, এমন মানুষজনই অংশ নেন এই প্রতিযোগিতায়। দুঃখ হচ্ছে, বাংলাদেশের প্যারালিম্পিক জাতীয় কমিটির বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় লন্ডনে গ্রীষ্মের হাওয়া খাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা।
বিষাদের বিষয় হলো; লন্ডন প্যারালিম্পিক কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন থেকে অনুশীলন করে আসছিলেন সাঁতারু শাহিনুর ইসলাম, সাইক্লিস্ট মুকুল চৌধুরীসহ চারজন। এর মাঝে ২০১০ সালে চীনের গুয়াংজুতে এশিয়ান প্যারালিম্পিকে আশা জাগানিয়া ফল করেছিলেন শাহিনুর ও মুকুল।
স্পাইনাল কর্ডের সমস্যায় সাঁতারু শাহিনুরের শরীরের নিচের অংশ অচল, হুইল চেয়ার ব্যবহার করে চলেন। শরীরের ওপরের অংশের শক্তি দিয়েই সাঁতার কাটেন। গুয়াংজুতে ৩০টি দেশের প্রতিযোগীর মধ্যে পঞ্চম হয়েছিলেন তিনি। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় শাহিনুর ইসলাম বলেছেন, ‘লন্ডন প্যারালিম্পিকে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের কোনো অংশগ্রহণই থাকবে না, ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন অনুশীলন করছি দেশের সুনাম বয়ে আনার জন্যই। তবে বাংলাদেশ সরকারই কমিটি বিরোধের দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী।’
সাইক্লিস্ট মুকুল চৌধুরী নিজের ১৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনা সাইকেল দিয়েই অনুশীলন করছিলেন। চীনে নিম্নমানের সাইকেল দিয়ে সাইক্লিংয়ে অষ্টম স্থান তাঁকে লন্ডন প্যারালিম্পিকে অংশ নেওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নিজেই নিজের প্রশিক্ষক। নিজের টাকা খরচ করে কঠোর অনুশীলনের পর ডান পায়ে শক্তিহীন মুকুল জানতে পারলেন, বাংলাদেশ অংশ নিতে পারছে না। এই মানসিক ধাক্কা কী করে সামাল দেবেন তাঁরা! তাঁদের অসহায়ত্ব আমাদের কি একটুও কাতর করে না!
সাভার সিআরপির সুইমিংপুল আর মানিকগঞ্জে নিজ বাড়ির পুকুরই শাহিনুরের অনুশীলনস্থল। আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ সুবিধাবঞ্চিত শাহিনুর গুয়াংজুতে ২৫টি দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলেই পঞ্চম হয়েছিলেন। নিজেই নিজের প্রশিক্ষক হয়ে মকুল সাইক্লিংয়ে হয়েছেন অষ্টম। অন্যদিকে কর্মকর্তাদের দলবাজি আর অব্যবস্থাপনায় প্যারালিম্পিক থেকেই ছিটকে পড়ল বাংলাদেশ!
সদ্য সমাপ্ত লন্ডন অলিম্পিকে উদ্বোধন থেকে সমাপনী সকল ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নজরকাড়া উপস্থিতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্যারালিম্পিক থেকে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ ছিটকে পড়ায় এখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বুলবুল হোসেনই বলতে গেলে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় চলনশক্তিহীন হয়ে পড়া বুলবুল নিজের অদম্য ইচ্ছা আর আত্মবিশ্বাসে জায়গা করে নিয়েছেন গ্রেট ব্রিটেন হুইল চেয়ার রাগবি দলে। খেলেছেন বেইজিং প্যারালিম্পিকেও। আর লন্ডন প্যারালিম্পিকের আগে প্রস্তুতি ম্যাচের ফলাফল, চেনা পরিবেশ আর তুমুল সমর্থনে সোনা জয়ের স্বপ্নই দেখছে তাঁর দল। কয়েক দিন আগে অলিম্পিক ভিলেজে যাওয়ার আগে বুলবুলের সঙ্গে কথা হয়। জানালেন, ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম খেলায় কঠিন প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রকে হারাতে পারলে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে পদকপ্রাপ্তি।
লন্ডন প্যারালিম্পিকে আমাদের জ্ঞাতি বুলবুলই ভরসা। প্রথম ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে তাঁর গলায় উঠুক অলিম্পিক পদক। জয়তু বুলবুল, বাংলাদেশ আপনার পাশে আছে।
 উজ্জ্বল দাশ: প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.