এবার বুয়েট শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে-ভিসির বাড়ি ঘেরাও

সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যখন আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত তখন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিদায়ের দাবিতে ফের অস্থির হলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আজ রবিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।


গত ২৫ আগস্ট বুয়েট খুললেও শিক্ষকরা ক্লাসে যাননি। এ অবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা, ভর্তিসহ সব একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে গত শুক্রবার শিক্ষকদের চিঠি পাঠায় কর্তৃপক্ষ। এর পরদিনই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলেন। শিক্ষকদের আন্দোলনের বৈধতা নিয়ে আদালতের একটি রুল জারির পর শিক্ষক সমিতি এখন আন্দোলনে নেই। তবে শিক্ষকরা এখন বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, বুয়েটে শিক্ষকদের এই দীর্ঘ আন্দোলনের কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তির কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে। পেছাচ্ছে বর্তমানে অধ্যয়নরত বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সরকার ইচ্ছে করেই বুয়েটে সংকট জিইয়ে রেখেছে। একই মন্তব্য করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য ও বুয়েটের উপাচার্য দুজনের বাড়িই গোপালগঞ্জে। শুধু এই একটি কারণেই তাঁদের রাখার পক্ষে অবস্থান নেয় সরকার।
যোগাযোগ করা হলে শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরো বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবহিত। ঠিক সময়েই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী দেশের বাইরে। তাঁরা ফিরলে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।
শিক্ষামন্ত্রী বর্তমানে মরিশাসে অবস্থান করছেন। বিদেশ যাওয়ার আগে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বুয়েটের সংকট সমাধান করব।' কিন্তু কবে সমাধান করবেন সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
এর আগে গত জুলাই মাসে যখন শিক্ষকরা আন্দোলন করছিলেন তখন শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, 'আমরা (সরকার) যখন সমাধানের উদ্যোগ নিই তখন শিক্ষকরা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দিয়ে সেই উদ্যোগে বাধা দেন।' মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর বুয়েট শিক্ষকরা আন্দোলনের সব কর্মসূচি স্থগিত করেন। এর পর দেড় মাসেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এই পরিস্থিতিতে এবার শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে 'বুয়েট পরিবার' ব্যানারে সর্বজনীন আন্দোলন শুরু হলো।
'একার পক্ষে সম্ভব নয়' : জানা যায়, গতকাল বুয়েটের সাধারণ শিক্ষকরাও উপাচার্য ও উপউপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগের অনুরোধ জানিয়েছেন। জানা যায়, শিক্ষকরা এ সময় বলেন, এতদিন শিক্ষকদের আন্দোলনে ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছে, এখন সরাসরি ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তাঁদের পদত্যাগ করা উচিত। শিক্ষকদের এসব অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, 'এটা আমার একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'
গতকাল উপাচার্য কার্যালয়ে বুয়েট শিক্ষকদের সঙ্গে উপাচার্যের সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে আসার সময় ছাত্রদের সঙ্গে উপাচার্যের সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে জিজ্ঞেস করে, 'স্যার, আপনি পদত্যাগ করবেন কি না।' জবাবে উপাচার্য বলেন, 'তোমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, আমি তাঁদের উত্তর দিয়েছি।' শিক্ষার্থীরা এ সময় একযোগে বলে, 'স্যার আপনি পদত্যাগ করুন।' এ সময় উপাচার্য নেতিবাচক মনোভাব দেখালে তাৎক্ষণিক শিক্ষার্থীরা উপাচার্য বাসভবন ঘেরাও করে। এ সময় সাধারণ শিক্ষকরা উপউপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। সাক্ষাতের সময় উপউপাচার্যের কক্ষে ছাত্রলীগ নেতারা প্রবেশ করলে শিক্ষকরা তাদের বের করে দেওয়ার দাবি জানান। এ নিয়ে সেখানে হইচই শুরু হলে পরে ছাত্রলীগ কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে উপউপাচার্য কক্ষ থেকে বের হয়ে এলে পদত্যাগ করবেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তাৎক্ষণিকভাবে আমি বলতে পারব না। আমার অ্যাপয়েন্টিং অথরিটির (নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ) সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।'
ভিসির বাসভবন ঘেরাও : এতদিন উপাচার্য ও উপউপাচার্যের অপসারণ দাবিতে শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছিলেন। শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে শিক্ষকদের সঙ্গে ছিল। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার প্রেক্ষাপটে এখন মাঠে শিক্ষকরা আর আনুষ্ঠানিকভাবে নেই। এবার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে, তাদের সঙ্গে শিক্ষকরা আছেন বিচ্ছিন্নভাবে। গতকালও বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক উপাচার্য ও উপউপাচার্যের কক্ষে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'স্বার্থে' উপাচার্য ও উপউপাচার্যকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানালে তাঁরা দুজনেই এতে অপরাগতা জানান। তাঁরা শিক্ষক নেতাদের বলেন, রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন। তাই রাষ্ট্রপতিই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলের পর দুপুর ১টার দিকে উপাচার্যের বাড়ির সামনে অবস্থান নেয় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঘেরাও চলে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছে, আজ রবিবারও তারা একই কর্মসূচি পালন করবে।
এর আগে সকাল ১১টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচির পর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেতাকেও অংশ নিতে দেখা যায়। শিক্ষক সমিতি শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিতে একাত্মতা জানাচ্ছে কি না জানতে চাইলে বুয়েট শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান বলেন, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০০৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান পলাশ গণমাধ্যমকে জানান, পদত্যাগ না করলে আজ সকাল ১০টায় স্লোগানসহ মিছিল বের করা হবে এবং উপাচার্য ও উপউপাচার্যের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হবে। তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টার যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা আজ সকাল ১০টায় শেষ হবে।
শিক্ষকদের পক্ষে ড. মো. হুমায়ুন কবির সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল (শনিবার) তাঁদের পদত্যাগে খুব ভদ্রভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত যে সময় দিয়েছে, আশা করি উপাচার্য ও উপউপাচার্য ভালো কাজে এ সময় ব্যবহার করবেন। তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেন, তাঁরা কোনো কূটকৌশল অবলম্বন করলে আন্দোলন আরো কঠোর হবে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, উপাচার্য হয়তো বর্ষাকালে গ্রীষ্মকালীন ৪৪ দিনের ছুটি দিতে পারেন কূটকৌশল হিসেবে। তবে আমরা এ ছুটি মানব না। এ ধরনের ছুটি দেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের তা না মানার আহ্বান জানান ড. কবির। একই সঙ্গে ছুটি দিলেও তারা যেন হল না ছাড়ে সে অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
উপাচার্য অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম ও উপউপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে গত ৭ এপ্রিল কর্মবিরতি শুরু করে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। প্রায় এক মাস পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে তাঁরা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করলেও দাবি পূরণ না হওয়ায় ১৪ জুলাই থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা দেন তাঁরা। ওই কর্মসূচি দেওয়ার পর গত ১০ জুলাই রোজা ও ঈদের আগাম ছুটি ঘোষণা করেন উপাচার্য। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য ও উপউপাচার্যের অপসারণ চেয়ে গণপদত্যাগেরও ঘোষণা দেন শিক্ষকরা। তবে শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগের পর তাঁরা ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এর পর ১৪ আগস্ট আদালত 'আন্দোলন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না' রুল জারি করলে আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচি দেয়নি শিক্ষক সমিতি।
দুপুরে শিক্ষক নেতারা যখন উপাচার্য ও উপউপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা সেখানে গেলে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বুয়েট ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক তন্ময় বিশ্বাসসহ কয়েকজন নেতা সেখানে ছিলেন। ওই সময় সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে তাদেরও হুমকি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, এই খবর কিংবা ছবি প্রকাশ হলে সাংবাদিকদের বুয়েটে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.