তত্ত্বাবধায়ক সরকার- চলমান রাজনীতির ব্যাধির প্রাথমিক চিকিৎসা by ফারুক ওয়াসিফ

বাংলাদেশের রাজনীতির গল্পটা আর বাঁদরের তেলতেলে লাঠি বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতার হয়ে নেই, তা হয়ে গেছে প্রতিযোগিতা করে লাঠিটাই ভেঙে ফেলার গল্প। ১৯৭২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই লাঠি নিয়ে খেলছে।


এর মধ্যে নব্বই সালে এরশাদশাহি উৎখাতের পর তারা এই সমঝোতায় আসে: লাঠির মাঝামাঝি পর্যন্ত ওঠা গেছে অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিক (এরশাদকেন্দ্রিক) উমেদারতন্ত্র থেকে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক (বিভিন্ন দল-উপদল) উমেদারতন্ত্রে পৌঁছানো গেছে; এখন দরকার গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কারা শাসকজোট হবে তার নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা। তার জন্য যে পর্যন্ত ওঠা গেছে সেখানে একটা ঠেকনা-কাঠি দেওয়া হবে, যাতে পা পিছলে আবার গোড়ায় গিয়ে পড়তে না হয়, কাঠিতে গিয়ে পা ঠেকে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকার, অন্য নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বন্দোবস্ত ছিল সেই ঠেকনা।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে শোষণমুক্তির অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার দাবি দ্রুতই বাদ দিতে পেরেছিল বিজয়ীরা। কিন্তু আশা ছিল, প্রকৃত জনগণতন্ত্র না হোক, তারা অন্তত নির্বাচনী গণতন্ত্র চালু রাখতে পারবে। তিন জোটের রূপরেখার এই দিকটা অনেককে আশাবাদী করেছিল। এই সমঝোতার জের ধরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকারের করা নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং ফল মেনে নতুন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পত্তনও হয়। স্বৈরতান্ত্রিক উমেদারতন্ত্র (Clientelism) থেকে প্রতিযোগিতামূলক উমেদারতন্ত্রে এই উত্তরণ ছিল বাংলাদেশি গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জন্ম।
এটা ছিল বাহাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত জিইয়ে থাকা শাসনতান্ত্রিক সংকটেরও একজাতীয় সমাধান। স্বাধীনতার আগে ও পরে কখনোই এই দেশে ক্ষমতা অর্জন বা হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে হয়নি। নব্বইয়ে গিয়ে তার একটা বিহিত মনে হয় হলো। এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত হয়ে উঠল। এটুকু অর্জনের সংরক্ষণ ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে সংবিধানের অংশ করে নেওয়ার মাধ্যমে। তাতে সমীকরণটা এমন দাঁড়িয়েছিল: গণতন্ত্র=তত্ত্বাবধায়ক সরকার+নির্বাচন। একটি বাদ দিলে অন্যটিও থাকে না। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই হয়ে দাঁড়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সদর দরজা।
রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি কমিয়ে আনা ছাড়াও আরেকটা কারণেও এটা জরুরি ছিল। স্বাধীনতার পরের প্রথম ১৯ বছরে রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল না। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো প্রতিপক্ষ দাঁড়াতেই পারেনি। এরশাদের আমলের শেষের দিকে অবস্থা বদলাতে থাকে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলগুলো ক্ষমতা সংহত করে এবং ক্ষমতার হিস্যা দাবি করতে থাকে। তাদের আর উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এভাবে বাংলাদেশে রাজনীতিতে বহুপক্ষীয় ভারসাম্য আসে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জমিনও এতে করে তৈরি হয়। এই নতুন বাস্তবতায় কারও পক্ষেই একচেটিয়া ক্ষমতায় দেশ চালাতে পারার কথা নয়। তা করতে হলে নব্বইয়ে স্বীকৃত ক্ষমতার ভারসাম্যটা ভেঙে ফেলতে হবে। বিরোধী দলকে কাবু করে এবং নির্বাচনের মাঠকে অসমান রাখার মাধ্যমেই তা সম্ভব। বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালে একবার এবং ২০০৭ সালে আরেকবার এই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত জরুরি অবস্থার সময় আরও বড় আকারে সেই চেষ্টা হয় এবং যথারীতি তা-ও ব্যর্থ হয়। এতে প্রমাণিত হয়, স্বৈরতান্ত্রিক উমেদারতন্ত্রের যুগ শেষ।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই দফায় আওয়ামী লীগ সরকার কি একইভাবে নৌকাকে পাহাড় ঠেলে ওঠাতে পারবে? তা পারতে ক্ষমতার এই আপাত-ভারসাম্য ভেঙে আবার এরশাদ আমলের মতো একচেটিয়াতন্ত্র কায়েম করতে হবে। সেটা করা কঠিন, কারণ সবারই ক্ষমতার শিকড় এখন অনেক গভীরে এবং সবাই মোটামুটি সংগঠিত। ২০০৭ সালে এ রকমটা করতে গিয়েই কিন্তু বিএনপি আম ও ছালা দুটোই হারিয়ে জরুরি অবস্থাজনিত বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। বর্তমান অবস্থায় উভয় দলের জন্যই এর থেকে বড় আত্মঘাত আর হয় না।
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠায় অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া গিয়েছিল। সোয়াসের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ মুশতাক হোসাইন খানের ভাষায় এর দৌলতেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা একচেটিয়া উমেদারতন্ত্র থেকে প্রতিযোগিতামূলক উমেদারতন্ত্রে রূপ নিচ্ছিল। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এর সঙ্গে মানানসই। একে স্থায়ী রূপ দেওয়া গেলে নির্বাচন ঘিরে অস্থিতিশীলতার প্রধান জ্বালামুখ বুজিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজনীতিকে আবার নব্বই-পূর্ব জায়গায় নিয়ে গেল। অথচ ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার বাসনার বিরুদ্ধেই তো নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানটি ঘটেছিল। এরশাদ সাহেবের পতন হলেও এরশাদ-মানসিকতা এখনো অটুট। স্বৈরাচার ব্যবস্থা নয় কেবল, স্বৈরাচার একটা মানসিকতা। উভয় দলের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেও এই মানসিকতা স্পষ্ট। উভয় দলই পরস্পরের হাত থেকে দেশ বাঁচানোকে যখন রাজনীতির পয়লা কর্তব্য গণ্য করে, তখন অপর দলকে নির্মূল না করে কীভাবে তাঁরা ‘দেশ’ বাঁচাবে?
এই সহিংস আদর্শ ও ক্ষমতার উদগ্র বাসনাকে সামাল দেওয়ার রক্ষাকবচ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প তাই আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এটা কোনো উদ্ভাবন বা ঐচ্ছিক ব্যাপার নয়, এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আপৎকালীন উপসংহার।
নির্বাচন নিয়ে সংকটের মীমাংসা অন্তত এক দশকের জন্যও যদি হয়, তা হলে রাজনীতি এখনকার মতো নির্বাচনকে ঘিরে আবর্তিত হবে না। রাজনৈতিক সমাজ এবং পুরসমাজের সদস্যদের মনোযোগ তখন ঘুরে যাবে দুই নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়কালে দেশ পরিচালনার কর্মসূচির দিকে। ক্ষমতার জন্য চলমান প্রতিযোগিতাকে তখন দেশ পরিচালনার নীতির প্রতিযোগিতায় বদলে ফেলাও সম্ভব হতে পারে। ক্ষমতার পালাবদলের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া যত দিন না প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তত দিন ‘দেশ ধ্বংস’ আর ‘দেশ বাঁচানোর’ রাজনীতি দেশকে ভোগাতেই থাকবে।
ক্ষমতা না ছাড়তে চাওয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতিটিও কম গুরুত্বপূর্ণনয়। ক্ষমতায়যাওয়ার অভিযানে উভয়েরই প্রয়োজন বিপুল অর্থ এবং দলীয়কৃত প্রশাসন ও পেশিশক্তি। কারণ, রাজনীতি এখানে করের টাকায় দেশ পরিচালনার মামলা নয়, রাজনীতি এখানে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সম্পদ অর্জনের দলবদ্ধ প্রচেষ্টা। রাষ্ট্র এখানে হাতিয়ার মাত্র। এই হাতিয়ারের ওপর একটি দলের বিবিধ গোষ্ঠীর একচেটিয়া থাকবে এবং অন্য দলগুলোর মধ্যে সংহত হওয়া গোষ্ঠীগুলো তা সইবে কেন? ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়াপনা আসে আরেকটি ভয় থেকে। একেকটি সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় যে সহিংস প্রক্রিয়ায় বিত্ত-পদ-ক্ষমতা আহরণ করা হয়, তা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে বিপুল প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। তারা তখন প্রতিহিংসার জন্য তক্কে তক্কে সরকারের বিদায়ের দিন গোনে কিংবা বিদায়ের সানাই বাজাতে থাকে। এহেন সরকার তখন যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা আঁকড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এ কারণেই দেখা যায়, বিদায় নিতে বাধ্য হওয়া সরকার সাধারণত প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের হাতে ক্ষমতা দিয়ে গা বাঁচাতে চায়।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে সহিংসতার এই চাকাকেও এক জায়গায় থামাতেই হবে। বিদায়ী সরকারের মনে এই ভরসা দিতে হবে যে তারা প্রতিহিংসার শিকার হবে না এবং নির্বাচনে পরাজিত হলে তারা বিরোধী দলের সঙ্গে যেমন আচরণ করেছিল, তেমন আচরণ তাদের সঙ্গে করা হবে না। লিখিত বা অলিখিত, এ রকম এক রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া সহিংস রাজনীতির বিষাক্ত বৃত্ত পানিতে ঢিল-ছোড়া ঢেউয়ের মতো পরিধি বাড়াতে বাড়াতে গোটা দেশটাকেই তার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবে। এই সমঝোতা সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের জন্যই লাভজনক। অর্থনীতির ভাষায়, এটা একধরনের ট্রেড-অফ: একটি ছাড়ের বদলায় অন্য একটি ছাড় পাওয়া। আজকের বাস্তবতায় ট্রেড-অফের প্রধান শর্তগুলো হতে পারে এই যে, সরকারি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনের বাধা হবে না এবং বিরোধী দল জয়ী হলে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবে না। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে মোটা দাগে এ রকম একটা সমঝোতা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত আছে।
কিন্তু কীভাবে এটা হবে এবং কে তার দায় নেবে? আর্কিমিডিস বলেছিলেন, আমি পৃথিবীকে তার কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দিতে পারি, যদি পৃথিবীর বাইরে কোথাও লিভার রাখার জায়গাটা পাই। রাজনীতির বাইরে থেকে রাজনীতিকে সুশাসিত করা যায় না। ২০০৭-০৯ সালের অভিজ্ঞতা সবারই জানা আছে। রাজনীতির দুষ্ট গ্রহগুলোকে সরানোর মতো বৈপ্লবিক কোনো লিভারের আবির্ভাবও দেখা যাচ্ছে না। বাকি রইল সেই নাগরিক সমাজ, যারা স্বাধীন এবং দেশি-বিদেশি কোনো পক্ষের দ্বারা পরিচালিত নয়। গণমাধ্যম, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং বৃহত্তর জনগণের সমর্থনে এ সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া যায়। এ কাজের মধ্যে কৃত্রিমভাবে ওপর থেকে রাজনীতির প্লাস্টিক সার্জারি কিংবা দুর্নীতি দমনের কাঁচা-যুদ্ধ আসতে দেওয়া যাবে না। সেই কাজ নির্বাচিত সরকারের সময়ের, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের নয়। এই সমঝোতা যদি উভয় রাজনৈতিক জোট, গণমাধ্যম এবং জনগণের মধ্যে থাকে, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগে ক্ষমতার তৃতীয় বা চতুর্থ দাবিদারেরা ঝোপ বুঝে কোপ মারার মওকা পাবে না। জনগণকে সঙ্গে করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে আস্থায় রেখেই সম্ভব বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য জরুরি এই ‘ম্যাগনা কার্টা’ রচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেটাই ভোগাতে থাকা রাজনৈতিক ব্যাধির প্রাথমিক চিকিৎসা।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.