কণ্ঠস্বর-রাজনীতি :আলো থেকে অন্ধকারে? by রাহাত খান

ষাটের মাঝামাঝি থেকে রাজনীতির মূলধারা চলে যায় ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগে। এই আইয়ুব শাহির আমলে রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনের পর দলের মধ্যমণি এবং দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে দাঁড়ান শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের ম্যাগনা-কার্টা হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। সময়টা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের

মানুষের জীবন একটাই। তবে এই এক জীবনে বহু জীবন পার হয়ে হয়ে মানুষকে তার শেষ মীমাংসা অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত পেঁৗছুতে হয়। এটা অবশ্য সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবন বলতে যা বোঝায়, সেই জীবন। অকালমৃত্যু ঘটে যাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে, কিংবা শৈশবে বা কৈশোরে; তাদের গল্প ভিন্ন। সেটা দীর্ঘশ্বাস ও কান্না জড়ানো ট্র্যাজেডির শুরু ও শেষ।
সেই ট্র্যাজেডির কথা বলছি না। বলছি সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনের সত্যাসত্য। সত্তর পার হয়েছি। বহু জীবন পার হয়ে হয়েই এ্যাদ্দুর পেঁৗছেছি। শুধু আমি নই, সত্তর কিংবা দীর্ঘতর জীবনের অধিকারী যারা, তাদেরও গল্প অভিন্ন। বহু জীবন। বহু পৌষ-ফাগুন পাড়ি দেওয়া। বহু তিক্ত ও মধুর স্বাদের সময় ভোগ করা।
তবে বলে রাখি, আত্মকাহিনী বলার ইচ্ছে আমার নেই। কলামে বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া সে ধরনের লেখা সম্পাদকের সম্মতিও পায় না। না পাওয়ারই কথা। সংবাদপত্রের ধারণ করার কথা তো শুধু সাংবাদিকতা। পত্রিকার মূল পৃষ্ঠায় বিশাল কোনো কালোত্তীর্ণ লেখক ছাড়া আত্মকাহিনী ফেঁদে বসার সুযোগের অবকাশ নেই অন্য কারও। আমার বক্ষ্যমাণ লেখাতে আত্মকাহিনীর একটা রূপরেখা আছে অবশ্য। সেটা প্রকৃত আত্মকাহিনী থেকে ভিন্ন। বয়স ও অভিজ্ঞতার দাবি নিয়ে লেখাটার নামকরণ করা যেতে পারে : আমার দেখা রাজনীতি। বলা দরকার, দেখাটা শুধু আমার নয়। বেশি বা কাছাকাছি বয়সের সচেতন বেশির ভাগ মানুষেরই। আর বলতে হয়, দেশটার নাম এককালে ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পরে কিছুদিনের জন্য পূর্ব বাংলা, ১৯৭১ সাল থেকে দেশটি স্বাধীন-সার্বভৌম এক আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
রাজনীতি আসলে কী_ সেটা চলি্লশ ও পঞ্চাশ দশকে খুব অল্পই চিনেছি। শৈশবে গ্রামেও বহু লোকের সমাগমে প্রায় কিছু না বুঝে বহু কণ্ঠের সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছি : পাকিস্তান জিন্দাবাদ। কায়েদে আজম জিন্দাবাদ। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। শৈশবে একটা গানের কথাও বেশ মনে পড়ে। মাইনর স্কুলে পড়ার সময় সুরে-বেসুরে গাইতে হতো : পূরব বাংলার শ্যামলিমা, পঞ্চ-নদীর তীরে অরুণিমা, ধূসর সিন্ধুর মরু সাহারায় ঝাণ্ডা ওড়ে যে আজাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ইত্যাদি।
শহরের স্কুলে এসে একবারই রাজনীতির একটি গভীর স্পর্শ বারো-তেরো বছরের এক কিশোরকে একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। সেটা ১৯৫২ সাল। ইংরেজি ফেব্রুয়ারি মাস। মনে আছে, ঢাকা শহরে ভাষার দাবিতে শহীদ ছাত্রদের রেখে যাওয়া পতাকাটি গোটা বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) সর্বস্তরের মানুষের হাতে হাতে সেদিন উড়েছিল। 'ও বাঙালী, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি'। আবদুল লতিফের (মরহুম) এই গান বাঙালির মর্মমূলে আলোড়ন তুলেছিল। যে কোনো দেশে কায়েমি স্বার্থের দালাল, জালিম সরকারের পদলেহী, কুলাঙ্গার তো থাকেই। তারা ছিল, আছে এবং থাকবে। এইসব কুলাঙ্গার ছাড়া বাংলা-ভাষাভাষী (পাকিস্তানের) ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই_ এই ইস্যুতে।
এসব পুরনো রাজনীতির কাসুন্দি কেন ঘাঁটছি_ এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে এই প্রশ্নের একটা যুক্তিগ্রাহ্য জবাবও রয়েছে। সুন্দরভাবে সূচিত হওয়া দেশপ্রেম ও জনকল্যাণের রাজনীতি কীভাবে পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের হোতাদের কারণে নামতে নামতে কতখানি নিচে নেমে এসেছে; রাজনীতি আজ কতটা অপরাজনীতিতে এসে ঠেকেছে... এর প্রেক্ষাপট ও অতীত জানার প্রয়োজনেই পেছন ফিরে রাজনীতির চেহারাটা দেখে নেওয়া দরকার। শুধু দরকার নয়, জরুরি।
কেননা, মানুষ অন্ধকার থেকে আলোর পথ খোঁজে। রাজনীতিতে ইনস্টিটিউশন (প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা, যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, কর্মকমিশন, পুলিশ, পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী ইত্যাদি) নিরপেক্ষ ও নির্দলীয়ভাবে, আস্তে ধীরে হলেও গড়ে তুলতে পারলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত আলোর দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৭৫ সালের পর থেকে রাজনীতি হঠাৎ পাকিস্তানের ধারায় একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের কব্জায় চলে গেল। স্বৈরশাসনের স্থায়িত্ব সব মিলিয়ে ৭+৯= ১৬ বছর। এই সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মেরুদণ্ড শুধু যে ভেঙে দেওয়া হলো; দলীয়করণ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ধারায় রাজনীতি শুধু যে 'সবকিছু পেয়ে যাওয়ার' একটা লাভজনক 'ব্যবসায়ে' পরিণত হলো তা-ই নয়; রাজনীতি বলতে দাঁড়াল জি-হুজুর রাজনীতিক, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী এবং সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় নৈতিকতা বোধহীন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনা কর্মকর্তার নেপথ্য সমর্থনের বদৌলতে এক ধরনের 'পুতুল নাচের ইতিকথা'। রাজনীতি অন্ধকার থেকে গভীরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকল। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতনে গণতান্ত্রিক উপায়ে এক ব্যক্তি এক ভোটের ইতিবাচক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল বটে; চর্চা শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের রাজনীতি। তবুও কবির ভাষায় 'গেল না আঁধার'। সেটাই দুর্ভাগ্যক্রমে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতির দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস।
সেই ইতিহাস কিছুটা বিবৃত করার আগে রাজনীতির অতীতেও একটু তাকানো ইতিবাচক-নেতিবাচক রাজনীতির প্রশ্নেই খুব প্রাসঙ্গিক। উপন্যাস বা ইতিকাহিনী ফেঁদে বসার তো কোনো অবকাশ নেই। শুধু বলি, ষাট দশক পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে মূলত শাসন করত ছাত্র রাজনীতি। সময়টা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে কর্মজীবন শুরুর সময়। দেখেছি তখনকার বড় ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ এমনকি এনএসএফকে পর্যন্ত। একে অপরের পক্ষে-বিপক্ষে সমঝোতা ও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্র বলতে ছিল বক্তৃতা। বা একটু ক্যারিশমা জুড়ে দিয়ে বলা যেতে পারে বাগ্মিতা।
এর পর ছাত্র রাজনীতিতে এআর ইউসুফদের প্রবেশ। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও তার সাগরেদ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এদের হাতে প্রতিপক্ষ দমনের জন্য তুলে দিলেন হকিস্টিক, ছুরি, সাপ ইত্যাদি। এনএসএফ পরিণত হলো এক ভয়ঙ্কর ড্রাগনে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রথম এক-দেড় বছর ছাত্র-রাজনীতির এই ড্রাগনের হাতে পিটুনি খেল। কেউ কেউ শাসক মুসলিম লীগের লেলিয়ে দেওয়া এই ড্রাগনদের হকিস্টিক ও ছুরিকাঘাতে প্রাণ দিল।
কিন্তু জানা কথা_ অস্ত্র পাল্টা অস্ত্র ডেকে আনে। প্রথমদিকে আত্মরক্ষার খাতিরে, পরে প্রতিআক্রমণের ধারায় ছাত্রলীগের এবং কিছুটা ছাত্র ইউনিয়নের হাতে 'অস্ত্র' এসে গেল। বিশেষত, ছাত্রলীগ তখন প্রবল জনসমর্থন পাওয়া আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে এনএসএফ ও মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। ছাত্র রাজনীতিতে ঢুকে গেল হকিস্টিক, ড্যাগার, পিস্তল। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাতবোমা। আলো থেকে এ দেশের ছাত্র রাজনীতির অন্ধকারে ঢুকে যাওয়ার এই-ই হচ্ছে পটভূমি। ভিলেনের নাম আইয়ুব খান, মোনায়েম খান ও মুসলিম লীগ_ এই মুহূর্তে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী সর্বাংশে এবং একই রাজনৈতিক পরিবারভুক্তির সুবাদে বিএনপি বহুলাংশে যাদের রাজনীতির উত্তরসূরি।
ষাটের মাঝামাঝি থেকে রাজনীতির মূলধারা চলে যায় ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগে। এই আইয়ুব শাহির আমলে রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনের পর দলের মধ্যমণি এবং দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে দাঁড়ান শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের ম্যাগনা-কার্টা হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। সময়টা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের। ছয় দফা আন্দোলনের সময় ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির অন্যতম প্রিয় স্লোগান ছিল :'বাংলাদেশের ঠিকানা/ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।' 'এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।' দুটি স্লোগান বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল কিছু কুলাঙ্গার ছাড়া গোটা বাঙালি জাতি। তাদের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা। শুধু স্বাধীনতা; আর কিছু নয়।
এই সময়টা রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল সময়। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ আলোর এই দীপ্ত মশালই বহন করেছিল। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পথ দেখিয়েছিল রাজনীতির এই আলোই। জাতির জন্য দুর্ভাগ্য; স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যে এই আলোর মশাল নিভে গিয়ে রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করেছিল 'অদ্ভুত এক আঁধার'। রাজনীতি থেকে সেই আঁধার এখনও ঘোচেনি। বরং পুরনো শকুন খামচে ধরেছে পতাকা। রাজনীতিতে বিরাজ করা অন্ধকার আরও গভীরতর হয়েছে।
সবই, আমার মতো অনেকেরই জীবদ্দশায় দেখা। তবে বিষয়টির ওপর লেখাটা শেষ করতে চাই সমকালে আমার পরের লেখায়। আত্মকাহিনী না হয়েও এই ধরনের লেখা লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া অগ্রসর হতে পারে না।

রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.