জীবন কথন- প্রশ্ন যত প্রভুর কাছে by রণজিৎ বিশ্বাস

: বিধাতা কিসের নাম?: একটি বিশ্বাসের নাম। বিধাতা নামের অস্তিত্ব সব সময় অদৃশ্য। তবে, বিশ্বাসীদের কাছে অতি বিশ্বাস্য।: যারা সাকার উপাসনা করে, তাদের বেলায়?: তাদের বেলাও অদৃশ্য। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তারাও কোনদিন বিধাতাকে দেখেনি। আমি আবারও বলি এবং বার বার বলি নৈষ্ঠিক মানুষের একটি গভীর বিশ্বাসের নাম
বিধাতা। একটি শর্তহীন ও অকম্প প্রতীতির নাম বিধাতা। মানুষের জন্মপরিচয় যাই হোক না কেন, বিশ্বাস বিনে বিধাতা নেই।
: বিধাতাকে নিয়ে আপনার মনে কী কী ভাবনার উদয় হয়?
: বিধাতাকে নিয়ে আমার মনে ভাবনার শেষ নেই। যেমন গায়ে যখন জোর থাকে, অধিকারে ও মালিকানায় সম্পদ থাকে, আশেপাশে সহায় থাকে, তখন মানুষ বিধাতার সঙ্গে লড়ালড়ির জোর দেখায়।
: সেই লড়ালড়িটা কী রকম?
: বিধিতার উদ্দেশে বার বার বলা তুমি নাই, তুমি বড় অসহায়। আবার দুর্বল মানুষ, বঞ্চিত দলিত পীড়িত নিপীড়িত এবং লাঞ্ছিত মানুষও বিধাতার সঙ্গে লড়ালড়ি করে, তার কাজের ও অ্যাকশনের কঠিন ও নির্দয় সমালোচনা করে। কবুল করতে আমার কম্পন নেই, মানবসৃষ্ট কারণে বার বার লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হয়ে; মানবেতর পাশবেতর কীটেদের হাতে বার বার অসম্মানিত হয়ে এবং আপন ‘হক’ থেকে ‘মাহ্রুম’ হয়ে আমি বিধাতার সঙ্গে বার বার ঝগড়াফ্যাসাদ করেছি; যখনতখন তর্কেবিতর্কে ও বাহাসে মেতেছি।
আমি তাঁকে বলেছি তুমি কেন বুঝতে পারো না, তোমার নামে ধর্মবাজ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং ছদ্মসাম্প্রদায়িক লোকেরা ব্যবসাবাণিজ্য করে। তুমি কেন বুঝতে পারো না তোমার মহত্ত্ব, ঔদার্য ও নিরপেক্ষতাকে ওরা প্রশ্নবিদ্ধ করে! সবাইকে তুমি সৃষ্টি করেছো, কিন্তু ওরা মনে করে তুমি ওদের ছাড়া আর কাউকে সৃষ্টি করো নি; ওরা নিজেদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাসী মনে করে না। বিশ্বাস যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, যার যার ধর্ম তার তার এটি তুমি ঘোষণা দিয়েছো, কিন্তু ওরা মানে না। ওরা বুঝতেই চায় না গন্তব্য এক হলেও মানুষ, অন্যের কোন ক্ষতি না করে, বিভিন্ন মতের চর্চা করতে পারে ও বিভিন্ন পথে ভ্রমণ করতে পারে। বিভিন্ন বাহন ও প্রার্থনাপ্রক্রিয়া বেছে নিতে পারে। তুমি কেন বুঝতে চাও না যে ওরা তোমাকে বিভিন্ন উপাস্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে তোমাকে খর্বই শুধু করে না, তোমাকে সাম্প্রদায়িকও বানিয়ে ছাড়ে!
বিধাতাকে বলি আমি বড় বিস্মিত হই প্রভু যখন তোমার অস্তিত্ব আছে সবাই বিশ্বাসে নতপ্রণত হওয়ার পরও ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট তৈরি হয়, যুদ্ধাপরাধীরা আস্ফালন করে টিকে যায় ও তাদের যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব হয়। বুঝতে পারি না তোমারই সৃষ্ট মানুষ কী করে ‘আশরাফুল মখলুকাত’ থেকে‘ ‘আতরাফুল মখলুকাত’ হয়ে যায় এবং ঠা-ামাথায় ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট হত্যাকা-ে নেতৃহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা, নারীহত্যা, মাতৃহত্যা, শিশুহত্যা ও ভ্রƒণহত্যা করে দায়মুক্তি পায় এবং তার হাতে সসম্মান পুনর্বাসন পায়, যে বলেছিল আমাকে বাদ দিয়ে তোমরা জুনিয়ররা যদি কাজটা করে ফেলো আমার আপত্তি নাই। আমি বুঝতে পারি না বিধাতা তোমার উপস্থিতিতে কী করে মানুষ জন্মদিনের পর জন্মদিন পাল্টে জাতির সবচেয়ে বড় শোকের দিনে ফিট করে নেয়ার কৌতুক ও ব্যঙ্গ করে! আমি বুঝতে পারি না বিধাতা রাজাকার মন্ত্রীরা কী করে বলে একাত্তরে যা করেছি, তা আমাদের সুচিন্তিত পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড অথবা মুক্তিযোদ্ধার গরম দেখিও না, মনে রেখো রাজাকার হলেও আমি মিনিস্টার। আমি বুঝতে পারি না গুটিকয় কুলাঙ্গার চাড়া আমরা সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধ করলাম, কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতে একটি জন্মপরিচয়ের মানুষই কেন পাকিস্তানের প্রায় একমাত্র ও ভয়াবহ শক্র বনে গেলাম! বুঝতে পারি না তুমি অস্তিত্বমান থাকার পরও কোন্ যুক্তিতে ওরা এক পরিচয়ের ও এক উপাস্যের মানুষকে আলদা করে নেয় ও আআদা স্টাইলে তাদের অত্যাচার করে, তাদের সহায়সম্পদ আত্মীয়স্বজন বাড়িঘর ধর্মবিশ্বাস এবং ইজ্জতসম্ভ্রমশুচিতা কেড়ে নেয়, পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়ে দেশত্যাগে তাদের বাধ্য করে!
আমার আরও অনেক অভিযোগ আছে বিধাতা। সব ক’টি আমি বলবো না। বড় বড় কয়েকটির কথা তোমার কাছে তুলে ধরলাম এই বিশ্বাসে যে আমি সুবিচার পাবো। আমি জানি তুমি মহাপ্রভু, মহানুভব, সর্বশক্তিমান; জানি তুমি পরিচয়নিরপেক্ষ, তুমি স্থাননিরপেক্ষ, কালনিরপেক্ষ, দিকনিরপেক্ষ, জাতিনিরপেক্ষ, বর্ণনিরপেক্ষ, বিশ্বাসনিরপেক্ষ, বিত্তনিরপেক্ষ, শিক্ষানিরপেক্ষ, প্রার্থনানিরপেক্ষ এবং তুমি সর্বনিরপেক্ষ। আমি গভীর এই বিশ্বাস নিয়ে আজ বাড়ি ফিরতে চাই এবং আমার সঙ্গীসাথী নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত সবাইকে নিজ নিজ কুলায় ও কুটিরে ফিরে যেতে বলি-তারা ব্যগ্রতায় অপেক্ষা করতে পারে, সুবিচার তারা পাবে শুধু নয়, পাবেই। তোমার হাতে সুবিচার না পেলে মানুষ কার হাতে তা পাবে। তুমি দুষ্টের ও নষ্টের বিনাশ ঘটাও, শিষ্টের পালন কর এবং সংসারে ধর্মকে সংস্থাপন কর। তোমার হাতে সবাই যেন সুখে থাকে, শান্তিতে থাকে এবং কেউ যেন অকারণ দুঃখভোগ না করে। মানুষ যেন বিশ্বাস করে মানুষ মানবসন্তান হিসেবেই সংসারে নামে; মানুষ রিক্তহাতে আসে, শূন্যহাতে ফিরে যায়; মানুষ কেঁদে কেঁদে আসে, কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ফেরৎ যায়। তোমার শিক্ষায় মানুষ যেন বুঝতে পারেÑযেমন মৃগশাবক হয় মৃগশাবক, শার্দুলশাবক শার্দুল শাবক, অশ্বশাবক অশ্বশাবক, তেমনি মানুষের শিশু মানবসন্তান হিসেবেই ভূমি স্পর্শ করে। তোমার সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে যাদের বুকভরা অহঙ্কার পাচ্যদুষ্পাচ্য,তারা যেন বিশ্বাস করে মানুষের প্রথম, প্রধান, সর্বশেষ, সর্বসেরা ও একমাত্র পরিচয় সে মানুষ, সে মানবসন্তান। অবয়বগত মানুষ ও মানবসন্তানের মধ্যে যে পার্থক্য, তাও যেন আমরা বুঝতে পারি। যেন বুঝতে পারি, কেন মানুষকে আবার ‘মানুষ’ হতে হয়; কেন মানুষকে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য বার বার জন্মগ্রহণ করতে হয়, কেন আমরা পাঠ করি পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, তরুলতা সহজেই তরুলতা; মানুষ, অনেক চেষ্টার পরে সে মানুষ। যেন বুঝতে পারি কেন জন্মমাত্রই মানুষ ‘মানুষ’ নয়, গরু যেমন গরু, সর্প যেমন সর্প, হায়েনা যেমন হায়েনা, চিতা যেমন চিতা যেন বুঝতে পারি, কেন আমরা ভাইবোন পুত্রকন্যা ও ছাত্রের মাথায় হাত দিয়ে বলিÑমানুষ হ, তুই মানুষ হ বৎস, বা তুই মানুষ হ, মা তুই মানুষ হ। এক মিনিট দাঁড়িয়ে আমরা যেন এই গানটির বাণী বোঝার চেষ্টা করিÑসব লোকে কয়, লালন কী জাত সংসারে/ ছুন্নৎ দিলে হয় মুসলমান, নারীর বেলায় কী হয় বিধান/ বাহ্মণ চিনি পৈতা প্রমাণ/ বামনী চিনি কী প্রকারে!/ ...। সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে!

লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.