নানান কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

নানা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে শনিবার ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। সকালে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।


পরে তিনি কবর প্রাঙ্গণে জিয়া সাংস্কৃতিক সংস্থা (জিসাস) আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী উদ্বোধন করেন। এর আগে ভোরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী বইমেলা শুরু হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে বিএনপি। দুদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে গত শুক্রবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনাসভা করেছে দল। এছাড়া গত কয়েকদিন ধরেই দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচী পালন করে আসছে। দেশের জেলা-মহানগর-উপজেলাসহ বিভিন্ন ইউনিটের উদ্যোগে নানান কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে দলের নেতাকর্মীরা।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কবর প্রাঙ্গণে আসতে থাকে। এ সময় নেতাকর্মীরা রং-বেরঙের ব্যানার, ফেস্টুন বহন করে। সকাল ১১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জিয়ার কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। পরে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলনকে তীব্র পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে আমরা মনে করি। তিনি আরও বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে বিধান বর্তমান সরকার বিদ্যমান সংবিধানে এনেছে তা বাতিল করে নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনরায় সংযোজন করাও আমাদের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, সংবিধান সংশোধন করে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া বিনষ্ট করা হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির ওপর এখন দায়িত্ব পড়েছে গণতন্ত্র রক্ষার। আমরা বিশ্বাস করি, নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন সফল করার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র আবার ফিরে আসবে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন, ৩৪ বছরে বিএনপি দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছে। একদলীয় শাসনের মাধ্যমে যে গণতন্ত্রকে হরণ করা হয়েছিল জিয়া ক্ষমতায় এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সেই গণতন্ত্র আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন। জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রশংসা করে মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁর নেতৃত্বে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তিনি অর্থনীতির চাকা সচল করে দেশকে মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র ও ‘উদীয়মান ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন।
শেরে বাংলা নগরে জিয়ার কবরে ফুল দেয়ার সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মাহবুবুর রহমান, আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. ওসমান ফারুক, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকতউল্লাহ বুলু, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিমউদ্দিন আলম, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে শ্রমিক দলের কার্যকরী সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক জাফরুল হাসান, যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, মহিলা দলের সভানেত্রী নূরে আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদিকা শিরিন সুলতানা, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, মৎস্যজীবী দল, বাস্তুহারা দল, ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), জিয়া সাংস্কৃতিক সংস্থা (জিসাস) নেতাকর্মীরা পৃথকভাবে জিয়ার কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বইমেলা
বিএনপির ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় তিন দিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করেছে বিএনপি। শনিবার বিকেলে জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা সংস্থা আয়োজিত এ বইমেলা উদ্বোধন করেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার পর্যন্ত এ মেলা চলবে।
বিএনপির বইমেলায় দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, দলের বর্তমান চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই প্রদর্শিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ‘জিয়াকে যেমন দেখেছি’, ‘ছোটদের জিয়া’, ‘প্রিয় দেশবাসী’ ইত্যাদি শিরোনামের বই। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব মহিউদ্দিন খান মোহনের ‘জরুরী অবস্থা, বিএনপি ও কিছু না বলা কথা’ শিরোনামের বইটি পাঠকদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
যুবদল সভাপতি ও বিএনপির যুববিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের সভাপতিত্বে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব উন-নবী-খান সোহেল প্রমুখ। মির্জা ফখরুলসহ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।
বইমেলা উদ্বোধনকালে মির্জা ফখরুল বলেন, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় তুঘলকি কা- চলছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় মেধা পাচারের প্রবণতা আবার শুরু হবে। আগে প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে যেত। এভাবে মেধা পাচার হয়ে যেত। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজগুলো ছেলেদের ধরে রেখে মেধা পাচার হওয়া ঠেকাত। এখন আবার পরিকল্পিতভাবে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, বুয়েট আমাদের গৌরব। এটিকে পরিকল্পিতভাবে এখন ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সেশনজটে ছেলেদের ভবিষ্যত নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখার আহ্বান জানান।
মির্জা ফখরুল বলেন, পৃথিবী ছোট হয়ে গেছে। এখন জ্ঞানের যুদ্ধ করেই এগিয়ে যেতে হবে। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে এগিয়ে গেলে কেউ আর আমাদের সামনে টিকতে পারবে না। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। আর খালেদা জিয়াও বই পড়তে উৎসাহ দেন।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বাউল সঙ্গীত
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুপুর থেকেই ট্রাকের ওপর বানানো অস্থায়ী মঞ্চে জাতীয়তাবাদী বাউল দলকে সঙ্গীত পরিবেশন করতে দেখা গেছে। এখানে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও উৎসাহী জনতার ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
জিয়া স্মৃতি পাঠাগার উদ্ধোধন
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার বিকেলে নয়াপল্টন ভাসানী ভবনে জিয়া স্মৃতি পাঠাগার উদ্বোধন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এ পাঠাগার ও পাঠাগারের সদস্য হওয়ার জন্য ফরম বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ পাঠাগারের নামে ফেসবুক আর ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে বলে জানান পাঠাগারের সভাপতি ও বিএনপির ঢাকা মহানগর শাখার সদস্য সচিব আবদুস সালাম।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি ছিলেন দলের প্রথম চেয়ারম্যান। জিয়া এর আগে একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি সংগঠন গঠন করেন, যা পরে বিএনপিতে বিলুপ্ত হয়। রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন জিয়া। এরপর দলের হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। তবে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের ভরাডুবি ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.