‘হার্ট অ্যাটাকে’ হত্যা-নির্যাতনের দায় শোধের সুযোগ by মোহাম্মদ আরজু

আইনি প্রক্রিয়ার দুর্বলতার সুযোগে অপরাধের দায় থেকে রেহাই পাবার সুযোগ থাকলে দেখা গেছে অপরাধ বাড়ে, আরো বেশি সংখ্যক মানুষ আরো বেশি মাত্রায় নানা ব্যক্তি ও সংঘবদ্ধ ব্যক্তিদের অপরাধের শিকার হয়। আর যদি খোদ আইন করেই অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়- তাও আবার খোদ রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে, তখন মানুষের ওপর রাষ্ট্রের অপরাধ-নির্যাতনের মাত্রা কেমন হয়?

সেরকম পরিস্থিতির বেশ কিছু বড় নজির তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ঠিক পর থেকেই। তবে এখানে বলছি শুধু ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’র কথা। এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের খুবই সাম্প্রতিক এক আদেশের ফলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতায় ফিরেছে আবারো।

২০০১’র পয়লা অক্টোবরে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় নির্বাচিত হয়। চারদলের অন্যতম নির্বাচনি ওয়াদা ছিল আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদে অপরাধের যে নরকরাজ্য তৈরি হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। ফৌজদারি আইনের উদ্দেশ্য- অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই লক্ষ্য পূরণে সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে কাজ করবার জন্য পুলিশ গঠিত ও পরিচালিত হয়। সেই পুলিশ তখন ছিল দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি ও দুর্নীতির প্রভাব এবং সামর্থ্য ও সক্ষমতার অভাবে অকার্যকর ও অদক্ষ, একইসঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষার প্রতি অমনোযোগী ও নির্যাতনপ্রবণ। কিন্তু পুলিশকে কার্যকর ও দক্ষ সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার দিকে, কিংবা নাগরিকের আইনি অধিকারবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলবার দিকে তারা গেলেন না।

ক্ষমতার বছরখানেকের মাথায় যখন প্রধানত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধের নরকরাজ্য নিয়ন্ত্রণের আরো বাইরে চলে যেতে থাকলো, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষত ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা প্রকাশ্যেই সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। ২০০২ এর ১৬ অক্টোবর তারা ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে এক অভিযান শুরু করলেন। পোশাকি নাম যদিও ‘যৌথ বাহিনী’র অভিযান ছিল, মানে আইন প্রয়োগকারী বেসামরিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে সামরিক বাহিনী; কিন্তু সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমগুলো সাক্ষী- প্রকৃত ঘটনা ছিল সামরিক বাহিনীই সারা দেশে অভিযানগুলোর নেতৃত্বে ছিল।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কোনো প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা সামরিক বাহিনীর নেই। রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী যেই কাজের জন্য গঠিত ও পরিচালিত হয়, সেই কাজটিই তারা করেছিল অবশ্যই সন্দেহভাজন ‘অপরাধী’দের ‘প্রতিপক্ষ’ সাব্যস্ত করে। পরিণতিও খুব স্বাভাবিক ছিল অপারেশন ক্লিনহাটের্র। ২০০৩ এর ৯ জানুয়ারিতে যখন অভিযানটি শেষ হয় তখন কমপক্ষে ১১,০০০ মানুষ গ্রেফতার ও ২৪০০-কে অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এই অভিযানে ‘যৌথবাহিনীর’ হাতে অসংখ্য মানুষ নির্যাতিত হবার স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ সংবাদ মাধ্যমে এসেছিল। সেনা হেফাজতে অন্তত ৬০ জন নিহত হবার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছিল। বিচার ছাড়াই কোন এখতিয়ারে এবং কারা এদেরকে ‘অপরাধী’ হিসেবে ‘তালিকাভুক্ত’ করেছিল? এ প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। অন্যদিকে নিহত সবার ব্যাপারে সরকার একই ব্যাখ্যা দিয়েছিল; ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যু। যদিও নিহতদের আত্মীয়রা ও সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল যে লাশের গায়ে স্পষ্টতই নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। এত ব্যাপক মাত্রার রাষ্ট্রীয় নির্যাতন চালিয়ে পরে জড়িতদের দায়মুক্তি দিতে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি করে সরকার।

এক দশককাল পর গত ১৪ জুন একজন ওই দায়মুক্তিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করবার আদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোটের্র হাই কোর্ট বিভাগে আবেদন (রিট) করেন। আবেদন শুনানি করে গত ২৯ জুলাই হাই কোর্ট বিভাগের একটি যুগ্ম বেঞ্চ সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে ৬ সপ্তাহের সময় দিয়ে রুল জারি করেছেন যে, কেন অপারেশন ক্লিনহার্টে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে প্রণীত ওই আইনটিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হবে না।  আদালত একইসঙ্গে অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে কেন ১০০ কোটি টাকার তহবিল গড়ে তোলা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে।

সরকার কিন্তু জানতো যে, এ অভিযানে ‘প্রচলিত’ আইন অনুসারেই তাদের অনেক দায় জন্মেছে। ফলে ‘প্রচলিত আইনে ও আদেশসমূহে যাহাই থাকুক না কেন’ উল্লেখ করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশটিতে আইন করা হয়েছিল যে (৩ ক ধারা) ‘যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণকে সর্বপ্রকার দায়মুক্তি করা হইল’। দায়মুক্তির অসাংবিধানিকতা ও অবৈধতার বিপক্ষে কি যুক্তি দেখাবেন সংশ্লিষ্টরা? তা দেখবার জন্য আদালতের সঙ্গে আমরাও অপেক্ষা করে আছি। বাংলাদেশের সংবিধান (৩৫ অনুচ্ছেদ) নির্যাতনের থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছে। অপারেশন ক্লিনহার্টে নির্যাতিতরা যাতে সেই সুরক্ষার আলোকে আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন সেজন্য দায়মুক্তি অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করা দরকার। আদালত নিশ্চয় সে ভূমিকা রাখবেন।

মনে রাখা জরুরি, ক্লিনহার্টে’র ‘হার্ট অ্যাটাকে’ হত্যা-নির্যাতনের পর ২০০৪ এ পুলিশের মধ্যে একটি নতুন ব্যাটলিয়ন- র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তৈরি করে নতুন ‘ক্রসফায়ার’ চালু করা হলো। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও এটা চালু রেখেছে। যৌথ অভিযানের নামে কার্যত সামরিক বাহিনীর অভিযান এই ব্যাটালিয়নটির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। প্রধানত, গঠন ও পরিচালনার দিক দিয়ে পুলিশের এ ব্যাটালিয়নটি কোনোভাবেই ‘পুলিশ’ নয়- একটি স্বাভাবিক ও বেসামরিক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব ড. মিজানুর রহমান সম্প্রতি আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা স্বীকার করলেন। ‘হার্ট অ্যাটাক’ওয়ালাদের দায়মুক্তি দিয়ে আলাদা আইন জারি করা হলেও এই ‘ক্রসফায়ার’ওয়ালাদের জন্য কিন্তু এখনো এমন কিছু জারি করা হয়নি। কিন্তু তারা কার্যত দায়মুক্তি পাচ্ছেন।


সে কারণেই বলছি, দায়মুক্তি বাতিল করা হলেই নির্যাতনের আইনি প্রতিকার পাওয়া সহজ হবে না। কারণ, আইনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর কার্যত এক ধরনের দায়মুক্তির সুযোগ আছে আইনে। প্রচলিত ফৌজাদরি আইনে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যা-গুম-নির্যাতনের অভিযোগ আনলে সেই অভিযোগকারীকেই আর দশটা ফৌজদারি মামলার মতো অভিযুক্তের অপরাধটি প্রমাণ করতে হয়। আইন সংস্কার বা দরকারে নতুন আইন করে এ দায়মুক্তি বন্ধ করতে হবে। আইনের বিধান হতে হবে এমন, সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো নাগরিক নির্যাতন-গুম-হত্যার অভিযোগ আনলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা অপরাধটি করেনি; নিজেকে দায়মুক্ত প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত দায়মুক্তি পাবার সুযোগ নেই।


মোহাম্মদ আরজু: সাংবাদিক ও আইনি বিষয়াদির লেখক।

                             ইমেইল: mohammadarju@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.