প্রতিক্রিয়া- সরকারের সঙ্গে সাংসদের ব্যবসা-বাণিজ্য by সরদার আমজাদ হোসেন

কতিপয় সাংসদ নিজেকে অসীম ক্ষমতাধর বলে মনে করছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। সংসদে সংখ্যাগুরু সদস্যদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভা গঠন করেন, মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়ী থাকে। তারা সংসদে জবাবদিহি নিশ্চিত করে। তাই বলে সাংসদের ক্ষমতা লাগামহীন নয়। সংবিধানের বিভিন্ন ধারা,


উপধারা, বিধি, প্রবিধান সংসদের ও সাংসদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।
গত ১০ ও ১২ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর ‘আইন ভেঙে সরকারের সঙ্গে সাংসদদের ব্যবসা’ কিংবা ‘১১ মন্ত্রী ও ৪৮ সাংসদকে সংরক্ষিত এলাকায় প্লট বরাদ্দ’। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সাংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং সংবিধানের প্রতি তাঁদের প্রকাশ্য অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়, যা দেশবাসী আইনপ্রণেতাদের কাছে প্রত্যাশা করে না।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরা প্রকল্প নামে সরকার নিজ উদ্যোগে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য তিন শ্রেণীতে ২০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। রাজউক এবং গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করছে। দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নেয়। সাংসদ মোহাম্মদ এনামুল হকের এনা প্রপার্টিজ ও দক্ষিণ কোরিয়ার ভোঙ্গা (এনা-ভোঙ্গা) যৌথভাবে ৪০টি ভবনের নির্মাণকাজ পায়।
প্রশ্ন, কী পরিস্থিতিতে সাংসদ হয়েও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ভেঙে কাজ পেলেন? সাংসদ নসরুল হুদা একইভাবে ঠিকাদারি কাজ পান বলে পত্রিকার খবরে বলা হয়। এনা-ডোঙ্গা আরেকটি কোম্পানির সঙ্গে ১১ ভাগে ২১টি ভবনের কাজ কিনে নেয়। এর মাধ্যমে দুই সাংসদ ৭৯টি নির্মিতব্য ভবনের ৭৭টিরই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১২(২) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করলে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার বা ওই পদে থাকার যোগ্য হবেন না। এ সম্পর্কে এনামুল হক মন্তব্য করেন, ‘আমরা তো কোনো লাভ করছি না। কাজেই আমার মনে হয় না আরপিও ভঙ্গ হয়েছে। আর আপনারা তো আগেও লিখেছেন। কিন্তু এমন কিছু প্রমাণিত হলো না।’ এ বক্তব্যের মাধ্যমে ওই সাংসদ নিজের ক্ষমতাই দেখাতে চেয়েছেন। সত্য প্রকাশই সংবাদপত্রের দায়িত্ব। প্রথম আলো তা-ই করেছে। সাংসদ এনামুল হক এর আগে বলেছিলেন, ‘আমি ব্যবসায়ী, যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা করতে পারি।’ সাংসদের এ ধরনের উক্তি যেমন সংবাদপত্রের মর্যাদার প্রতি অবমাননাকর, তেমনি আইনের প্রতিও অবজ্ঞাপূর্ণ। সংবাদপত্রের প্রথম দায়িত্ব বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ এবং তা পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেওয়া। সুতরাং,
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য সম্পর্কে মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও সাংসদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
সাংসদ এনামুল হক রাজশাহী সিটি করপোরেশনের রাজশাহী সরকারি কলেজ লাগোয়া ১৮৭৩ সালের ভবন ভেঙে বাণিজ্যিক কেন্দ্র সিটি সেন্টার ভবন নির্মাণের চুক্তি করেন। সিটি সেন্টারের সঙ্গে চুক্তিতে ১৬তলা ভবন নির্মাণের চুক্তি হলেও তিনি রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে ১৮তলার নকশা অনুমোদনের জন্য পেশ করেন। ২০০৯ সালে উদ্বোধন করে ৩৬ মাসে কাজ শেষ করার বাহানায় নকশা অনুমোদনের আগেই কাজ শুরু করা হয়। রাজশাহীর কাটাখালীতে প্রতিষ্ঠিত ‘নর্দান পাওয়ার সলিউশনে’ এই সাংসদের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৯১ কোটি টাকা। তবে রূপান্তরযোগ্য বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে তহবিল ১৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এসইসি এই বিষয়ে কোনো উৎসাহ না দেখালেও ‘প্রভাবশালী মহলের চাপ আছে বলে জানা যায়’। জনমনে প্রশ্ন, কারা এ প্রভাবশালী মহল? বর্তমানে উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের প্রথম পর্যায়েই এনা-ভোঙ্গা কোম্পানি রাজউক এবং গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪০ কোটি টাকা অগ্রিম দাবি করেছে। এ বিষয়ে পূর্তসচিব চুক্তিবহির্ভূত কোনো অগ্রিম টাকা দিতে অস্বীকার করেন। ২০১১ সালে ‘আইন ভেঙে সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপা হলে দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধান চালালে বিষয়টির সত্যতা প্রমাণিত হয়। দুদক স্পিকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে ১০ এপ্রিল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পত্র দেয়। কিন্তু প্রতিকার নেই। তাই সাংসদদের ধারণা, আইন ভাঙলেও তাঁদের কিছু হবে না।
সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি প্রতি মাসে একবার বৈঠকে বসবে। ঢাকায় একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও বাসা আছে এ রকম সাংসদ মিথ্যা ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে হলফনামা দিয়ে সংরক্ষিত কোটার প্লট নিয়েছেন; আবার অনেকে এক, দুই ও তিনটি পর্যন্ত প্লট নিয়েছেন বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠক ঠিকমতো হয় না। ফলে মন্ত্রণালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিরও বালাই নেই।
তাই সরকারের সঙ্গে সাংসদের ব্যবসা বা অসত্য হলফনামা দিয়ে ঢাকায় প্লট নেওয়া সহজ হয়েছে। সাংসদের এসব কর্মকাণ্ড, অবৈধভাবে সম্পদ আহরণ সাংবিধানিক বিধিনিষেধ ভঙ্গ করছে কি না, তা-ও দেখার বিষয়। আলোচ্য বিষয়ে আমি সংবিধানের তৃতীয় তফসিল (১৪৮ অনুচ্ছেদের), স্পিকারের ঘোষণা পাঠ এবং এ সংসদ সদস্যের শপথ বিবেচনার্থে তুলে ধরলাম, ‘আমি...সশ্রদ্ধচিত্রে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে আমি আইন অনুযায়ী স্পিকারের কর্তব্য (এবং কখন আহূত হইলে রাষ্ট্রপতির কর্তব্য) বিশ্বস্ততার সাথে পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসগত আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব। এবং ভীত বা অনুগ্রহ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।’
একজন সাংসদের শপথ ‘আমি...সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া সশদ্ধচিত্তে শপথ (ও দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্য ভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি যে, তাহা আইন অনুযায়ী বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব এবং সংসদ সদস্য রূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’
প্রথম আলোর প্রতিবেদন সত্য হলে আলোচ্য সাংসদেরা ‘আইন অনুযায়ী বিশ্বস্ততার’ সঙ্গে নয়, সন্দেহাতীতভাবে অবিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা ‘ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত’ হচ্ছেন। সুতরাং সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে। ১৫তম সংশোধনীতে এই সাংসদেরাই কিন্তু ৭ক অনুচ্ছেদে এ মর্মে বিধান করেছেন যে, ‘এই সংবিধানের কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাকে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।’ আমাদের ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী সাংসদেরা কি দণ্ড, না দায়মুক্তি ভোগ করবেন?
সরদার আমজাদ হোসেন: সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য।

No comments

Powered by Blogger.