খুলে যাচ্ছে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার ॥ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আজ by ফিরোজ মান্না

বাংলাদেশীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার আগে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ করতে মঙ্গলবার রাতে সে দেশের মানবসম্পদমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের ঢাকায় এসে পৌঁছার কথা। আজ বুধবার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।


চূড়ান্ত এই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হবে কত সংখ্যক কর্মী মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে নেবে। বৈঠকের ‘এজেন্ডা’ আগেই ঠিক করা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ভবনে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর এই বৈঠক হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি খোলার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার জন্য দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এরপর মালয়েশিয়া সরকারের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে যায়। তাঁরা একটি রিপোর্ট সে দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। ওই রিপোর্টের পর মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছরের মে মাসে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়া সফরে যায়। তাঁরা দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। কর্মী নিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী। ওই সফরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, হিউম্যান রিসোর্স মন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন।
প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. জাফর আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মালয়েশিয়া সফরের বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই সফরের সময় বলা হয়েছিল চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণের জন্য আরেকটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসবে। মঙ্গলবার গভীর রাতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের ঢাকায় এসে পৌঁছার কথা। তাঁরা আজ বুধবার ইস্কাটনস্থ প্রবাসী কল্যাণ ভবনে বৈঠকে বসবেন। এই বৈঠক থেকেই সিদ্ধান্ত হবে তাঁরা কত সংখ্যক কর্মী বাংলাদেশ থেকে নেবে। তাছাড়া কর্মী পাঠানোর ব্যাপারেও কিছু গাইডলাইন দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বিপুলসংখ্যক পরিমাণ কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতেই বেশি আগ্রহী। কারণ সে দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করতো ইন্দোনেশিয়ার। এরপরেই নেপালের। তৃতীয় স্থানে ছিল বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছুদিন ধরে ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। তাছাড়া নেপালের শ্রমিকের ‘ডিমান্ড’ বেশি। বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ তাদের জন্য সস্তা হয়। তাই তারা ‘সোর্স কান্ট্রি’ হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। এখন মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন রকম কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কম করে হলেও ২০ লাখ কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। মে মাসে মন্ত্রীর সফরে এমন একটি সিদ্ধান্তই হয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় অবস্থিত সাড়ে তিন লাখ কর্মীর বৈধতা নিয়েও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ থেকে কম করে হলেও পাঁচ লাখ কর্মী সেখানে কাজ পাবেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শামসুন নাহার বলেন, মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার ব্যাপারে রোজার ঈদের আগেই সে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়। মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী এস সুব্রামনিয়ামের নেতৃত্বে মালয়শিয়ার প্রতিনিধি দলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নিয়োগকর্তাদের প্রতিনিধিরাও থাকছেন। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মী পাঠানো গত তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বিএমইটি মহাপরিচালক শামসুন নাহার বলেন, বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর পদ্ধতি দেখতে তাঁদের (মালয়েশিয়া) মানবসম্পদমন্ত্রী সফরে আসছেন। আশা করি, তাঁদের এ সফরে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া পাবে। মালয়েশীয় প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রগুলো চূড়ান্ত হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এর আগে বলেন, এটিই হবে তাঁদের (মালয়শিয়া) চূড়ান্ত মিশন। এ সফরের পর তাঁরা গিয়ে তাঁদের সরকারকে প্রতিবেদন দেবেন। তাঁদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ সফরে দু’দেশের মধ্যে জনশক্তি নেয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের সম্ভাবনাও রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার আগেই দেশটিতে তালিকাভুক্ত সোর্সিং কান্ট্রি (উৎস দেশ) হিসেবে জনশক্তি রফতানির সুযোগ নিশ্চিত করতে চায় ঢাকা। এ জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শক্ত অবস্থান নিয়েছে। মালয়েশীয় প্রতিনিধিদলের সফরকালে এ বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। বর্তমানে ১৩টি উৎস দেশ (সোর্সিং কান্ট্রি) থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। বাংলাদেশও সেখানে উৎস দেশ হতে চায়। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেয়া হবে। এতে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো সহজ হবে এবং খরচও কমে যাবে। এটি জনশক্তি নেয়ার স্থায়ী ব্যবস্থা। এতে আর কলিং ভিসার (আহূত ভিসা) মতো নির্দিষ্ট সংখ্যক জনশক্তি নেয়ার পর লোক নেয়া বন্ধের সুযোগ থাকবে না। মালয়েশিয়ায় উৎস দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠাতে ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার মালয়শীয় রিঙ্গিত পর্যন্ত খরচ হতে পারে। ফলে অভিবাসন ব্যয়ও কমে যাবে। ব্যয় কমিয়ে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে জনশক্তি রফতানি শুরু করা সম্ভব হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশী কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭৪২ কর্মী বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। এরপর আর কোন শ্রমিক তারা নেয়নি। ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার, ২০০৭ সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার এবং ২০০৬ সালে ২০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী মালয়েশিয়া যান। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় কলিং ভিসায় কর্মী নেয়া শুরু করলে বাংলাদেশী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এজন্য ২০০৯-১০ সালে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাংলাদেশী কোন শ্রমিককে যেন বিমানে বহন করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে এ সংক্রান্ত চিঠি কুয়ালালামপুর অভিবাসন দফতর থেকে সব বিমান সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। সেই থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিক রফতানি বন্ধ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.