প্রধান কার্যালয় ভবনও দখল করছে হলমার্ক by ইফতেখার মাহমুদ

রাজধানীর বেগম রোকেয়া সরণি ধরে এগিয়ে আগারগাঁও-তালতলা পেরোলেই বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের প্রধান কার্যালয়। ২০৫/৪ পশ্চিম কাফরুলের এই সাততলা ভবনের তিনটি তলার ১৬ হাজার বর্গফুট জায়গা অত্যন্ত কম দামে কিনে নিয়ে প্রধান কার্যালয় করেছে গ্রুপটি। এখন তারা দখল করতে শুরু করেছে পুরো ভবনটিই।


এর আশপাশের ভবনগুলোর প্রতি বর্গফুট জায়গা বিক্রি হয়েছে ছয় থেকে আট হাজার টাকায়। অথচ মালিকপক্ষের পারিবারিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে হলমার্ক গ্রুপ ভবনটির প্রতি বর্গফুট জায়গা কিনেছে অর্ধেক দামে। বাকি জায়গা আর কেনা নয়, দখলের চেষ্টায় আছে সরকারি জমি ও বেসরকারি মালিকানাধীন প্লট দখলকারী হলমার্ক। গ্রুপটি এখন সবচেয়ে আলোচিত সোনালী ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ জালিয়াতির জন্য।
প্রধান কার্যালয় ভবনের চতুর্থ তলাটি হলমার্ক কেনেনি। অথচ তারা এর মালিকানা দাবি করে ভাড়াটিয়াদের ফ্লোর খালি করতে চিঠি দিয়েছে। অন্যান্য ফ্লোরের ভাড়াটিয়াদেরও ভবন ছেড়ে দিতে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য ভবনের একজন ভাড়াটিয়া হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। আরেক ভাড়াটিয়া ভয় পেয়ে ভবন ছেড়ে চলে গেছেন। বাকিরা আছেন আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায়।
হুমকি দিয়ে উচ্ছেদ: ভবনটির চতুর্থ তলায় ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা মানসিক হাসপাতাল। গত জুন মাসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভবনটি ছেড়ে মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে চলে যায়। হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের লোকদের হুমকির কারণে প্রায় ১০ লাখ টাকার অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো ফেলে রেখেই তারা চলে যায়।
হাসপাতালের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ‘হলমার্ক গ্রুপের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা প্রায়ই আসতেন, অনেক রাত পর্যন্ত থাকতেন। শেরেবাংলা নগর থানাসহ মিরপুর এলাকার বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মকর্তারাও ওই কার্যালয়ে প্রায়ই যেতেন।’ ফলে হলমার্ক গ্রুপ তাঁদের ওই ভবন থেকে চলে যাওয়ার জন্য বললে তাঁরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি।
চতুর্থ তলায়ই কম্পিউটার ও প্রযুক্তিপণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ইয়ার ২০০০ কোং (প্রা.) লিমিটেডের কার্যালয় অবস্থিত। ২০১১ সালের ১৪ আগস্ট হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক আসলাম উদ্দিন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাফিজ আকবর আহমেদকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, হলমার্ক গ্রুপ ওই ভবনের চতুর্থ তলাটি কিনেছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ১৫ দিনের মধ্যে ফ্লোরটি ছেড়ে দিতে হবে।
চিঠি পাওয়ার পর হাফিজ আকবর আহমেদ হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, ২০১০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভবনের মালিক মো. ওয়াজউদ্দিনের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের জন্য এবং নবায়নযোগ্য শর্তে ভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু হলমার্ক গ্রুপের কয়েকজন লোক এসে ধমকের সুরে চলে যেতে বলছে। হলমার্ক গ্রুপ বিভিন্ন লোক মারফত অফিসে এসে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
হাফিজ আকবর এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য ভাড়াটিয়ারা হলমার্কের ভয়ে চলে গেছে। আমিও আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি।’
সাইনবোর্ড তুলে নিয়েছে হলমার্ক: অন্যের মালিকানাধীন ভবন দখল করতে চাইলেও নিজেদের কেনা জমি থেকে সাইনবোর্ড এখন উঠিয়ে ফেলেছে হলমার্ক গ্রুপ। প্রধান কার্যালয়ের দুই পাশ ও পেছনে প্রায় সাতবিঘা জমি কিনেছে তারা। মাস খানেক আগেও নিজেদের মালিক হিসেবে দাবি করে ওই জমিগুলোর সামনে সাইনবোর্ড টাঙায় তারা। কিন্তু সোনালী ব্যাংক হলমার্ক গ্রুপের কাছে টাকা ফেরত চাওয়ার পরপরই জমি থেকে সাইনবোর্ড উঠিয়ে নেওয়া হয়।
হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই ভবনের দুটি ফ্লোর তাঁরা কিনেছেন। পশ্চিম কাফরুলের ২০৫/২ নম্বর হোল্ডিংয়ের জমিসহ আরও কিছু জমি কেনা হয়েছে। তবে ক্রয় করা মোট জমির পরিমাণ জানেন না। দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
পারিবারিক দ্বন্দ্বের ফায়দা: ভবনটির মূল মালিক মো. ওয়াজউদ্দিন ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে হলমার্ক গ্রুপের কাছে ভবনটির দ্বিতীয় তলার ছয় হাজার বর্গফুট জায়গা প্রতি বর্গফুট তিন হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এরপর ২০১১ সালে তৃতীয় তলাটি প্রতি বর্গফুট তিন হাজার ৭০০ টাকায় এবং চলতি বছর সাততলার একাংশ (৪০০০ বর্গফুট) চার হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা।
বাজারদরের চেয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে মো. ওয়াজউদ্দিনের স্ত্রী মোসাম্মৎ পারভীন প্রথম আলোকে জানান, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে অর্ধেক দামে জায়গা বিক্রি করতে তিনি বাধ্য হন। টেলিফোনে তিনি জানান, তাঁর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর সদরের নাজিমপুর গ্রামে বসবাস করছেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে তাঁরা ঢাকায় আসতে পারছেন না। ফলে ওই ভবনের বাজারদর সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। স্বামীর চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় হলমার্কের তানভীর মাহমুদ যে দাম দিতে চেয়েছেন, তাতেই রাজি হয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.