হলমার্ক নিয়ে মামলায় ব্যস্ত সবাই ॥ ঝুলে যাচ্ছে অর্থ আদায়- -০ ৫০ শতাংশ অর্থ ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধের আল্টিমেটাম আড়ালে চলে যাচ্ছে -০ হলমার্কের সঙ্গে অর্থ আদায় সংক্রান্ত সোনালী ব্যাংকের বৈঠকের তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে -০ মামলা জটে পড়লে অর্থ আদায়ের বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত হতে পারে by শাহ্ আলম খান

ঝুলে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলাসহ দু’টি শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপের হাতিয়ে নেয়া ২ হাজার ৬৬৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা উদ্ধারের জোরদার প্রক্রিয়া। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে জানা যায়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ মুহূর্তে লোপাট হওয়া অর্থ উদ্ধারের চেয়ে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকছে।


আজ অথবা আগামী দু’একদিনের মধ্যেই এ ঘটনায় অভিযুক্ত ৩১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে মামলা করার তাগিদ দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠি দুদক কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, দুদকও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্ধ শতাধিক মামলা হতে পারে।
অর্থাৎ অর্থ কেলেঙ্কারির এ ঘটনায় অর্থ আদায়ে বিভিন্ন মহল থেকে জোরালো উদ্যোগ না নেয়ার পরিবর্তে মামলার তোড়জোড় প্রস্তুতি চলছে সব মহলে। এতে করে ব্যাংক থেকে লোপাট হওয়া অর্থ উদ্ধার দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চয়তায় ঝুলে যেতে পারে, যা নগদ অর্থের অভাবে অভিযুক্ত ব্যাংক আগামীতে ভয়াবহ তারল্য সঙ্কটের দিকে ধাবিত করতে পারে।
ওদিকে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী এজিএমের মাধ্যমে ব্যাংক পর্ষদের একাধিক পরিচালকের অবসরে যাওয়া এবং উর্ধতন কর্মকর্তাদের আশানুরূপ তৎপরতার অভাবে হাতিয়ে নেয়া অর্থের ৫০ শতাংশ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নগদ পরিশোধের আল্টিমেটামও আড়ালেই চাপা পড়ে যাচ্ছে। সময়সীমা পার হতে আর দিনকয়েক বাকি। এর মধ্যেই গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি আকারে হলমার্কের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।
অন্যদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে জালিয়াতির নায়ক হলমার্ক গ্রুপের সঙ্গে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্য বৈঠক কিংবা আলোচনায় বসার দিন তারিখও দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে। এতে করে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ নিয়ে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। আবার বাকি ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের জন্য ইতোমধ্যে ব্যাংকের কাছে মর্টগেজে দেয়া হলমার্কের ৪৭ একর জমি নিষ্কণ্টক কি-না সেটিও যাচাই-বাছাই কাজ শেষ করা হয়নি। এমনকি হলমার্কের দাবি অনুযায়ী ওই পরিমাণ জমির বাজার মূল্য ২০০০ কোটি টাকা হবে কি-না সেটিও এখন পর্যন্ত নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে এভাবে সময় নষ্ট হওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করতে মোটেও ভুল করেনি হলমার্ক কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তাদের ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবারের মানবিক দিকটি উল্লেখ করে ইতোমধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উল্টো সরকারের কাছে দশ দফা ছুড়ে দিয়েছে। এতে হলমার্কের অন্যতম দাবিটি করা হয়েছে গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের দায় নিরূপণ করে ৩০ বছর মেয়াদে কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের সূচী প্রণয়নের।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হলমার্ক গ্রুপের এই প্রস্তাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণী বিন্যাস, পুনঃসূচীকরণ ও ডাউন পেমেন্ট সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের আওতায় পড়ে না।
এছাড়া হাতিয়ে নেয়া অর্থ পরিশোধের বিষয়ে হলমার্কের বিজ্ঞপ্তি প্রস্তাবনা এবং গত ২ সেপ্টেম্বর দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য পুরোপুরি স্ববিরোধী বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি ওই দিন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘আমি যে ঋণ নিয়েছি তার ২০ গুণ সম্পদ আমার আছে। ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়েছি এবং তা যথাসময়ে পরিশোধ করব।
পরবর্তীতে তাঁর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংক পর্ষদ সর্বসম্মতভাবে হলমার্ককে ঋণের অর্ধেক অর্থ নগদে পরিশোধের জন্য ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়। এ বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলেছিল, গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী তিনি অসীম সম্পদের মালিক। অর্থাৎ আমাদের আল্টিমেটাম অনুযায়ী তিনি ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি সক্ষম। আর আমরা এটিকে ঋণ বলব না। এটি একটি জালিয়াতির ঘটনা।’
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, হলমার্ক তার গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের দায় নিরূপণ করে ৩০ বছর মেয়াদে কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের যে সূচী প্রণয়নের দাবি করেছে এটি কোন যৌক্তিকতা ও আইনের ব্যাখ্যার মধ্যে পড়ে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণী বিন্যাস, পুনঃসূচীকরণ ও ডাউন পেমেন্ট সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের এ সীমা বছরের পর বছর (৩০ বছর) ধরে চলতে পারে না। কন্টিনিউয়াস ও ডিমান্ড লোন শ্রেণীকরণের ক্যাটাগরি অনুযায়ী এসএস, ডিএফ ও বিএল-এর প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেণীকরণের সময়সীমা আগের তুলনায় ৩ মাস করে কমিয়ে ৬ মাস, ৯ মাস ও ১২ মাসের পরিবর্তে যথাক্রমে ৩ মাস, ৬ মাস ও ৯ মাস নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে ৫ বছর ও ৫ বছরের উর্ধসীমার টার্ম লোন এসএস, ডিএফ ও বিএল হিসেবে শ্রেণীকরণের সময়সীমা একই ক্যাটাগরির আওতায় এনে যথাক্রমে ৩ মাস, ৬ মাস ও ৯ মাস নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৫ জুলাই থেকে এই নিয়ম কার্যকর হয়েছে। এর আগে ৫ বছর মেয়াদী টার্ম লোনের ক্ষেত্রে এ সময়সীমা যথাক্রমে ৬ মাস, ১২ মাস ও ১৮ মাস এবং ৫ বছরের উর্ধমেয়াদী টার্ম লোনের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ১২ মাস, ১৮ মাস ও ২৪ মাস নির্ধারিত ছিল।
এ সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, কোন ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পার হলে নিম্নমানে ঋণটি শ্রেণীকৃত হবে। ছয় মাস পর্যন্ত এই পর্যায়ে শ্রেণীকৃত থাকবে। যদি ঋণটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ছয় মাসে গিয়ে ঠেকে, তাহলে তা সন্দেহজনক পর্যায়ে শ্রেণীকৃত হবে এবং তা নয় মাস পর্যন্ত এই পর্যায়ে থাকবে। নয় মাস পার হয়ে গেলে তা মন্দ ঋণে পরিণত হবে।
তিনি আরও জানান, খেলাপী ঋণ কোনভাবেই তিনবারের বেশি পুনর্তফসিল করা যাবে না। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি তৃতীয়বারের মতো পুনর্তফসিল ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাকে আর সুযোগ দেয়া হবে না। আর কোন ঋণের বিপরীতে এককালীন অর্থ পরিশোধ (ডাউন পেমেন্ট) করলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়মিত ঋণ হবে না। যদিও ঋণ তথ্য (সিআইবি) প্রতিবেদন নিয়ে দায়মুক্তি পেয়ে নতুন ঋণ করা যাবে। তবে এই ঋণ পৃথকভাবেই দেখা হবে।
ওদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা করা হলে আদালতে বিচারাধীন মামলার জট ঠেলে দ্রুত তারিখ দেয়া এবং মামলার বিচার কাজ শেষ করা যেমন অসম্ভব হয়ে পড়বে, তেমনি হলমার্ক গ্রুপের নিয়োজিত আইনজীবীদের প্রস্তাব অনুযায়ী সোনালী ব্যাংকের লোপাটকৃত অর্থের চেয়ে হলমার্কের ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবার-পরিজনের মানবিক বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। এতে করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে যেতে পারে অর্থ আদায়ের উদ্যোগ।

No comments

Powered by Blogger.