প্রেসিডেন্ট ওবামা কী পুনর্নির্বাচিত হতে পারবেন? by মুস্তাফা মাসুদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী নবেম্বর মাসের ৬ তারিখ। এই নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধেই সে দেশে রমরমা প্রচার-প্রচারণা, বাকযুদ্ধ আর নানামাত্রিক যুক্তিতর্ক বিনিময় শুরু হয়েছে। এই নির্বাচনী যুদ্ধে একদিকে রয়েছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা; অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি।


মিট রমনি ও তার সমর্থকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নির্বাচনী মাঠে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তার প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখছেন না। তিনিও তার শাসনামলের সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এই দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর ভোটযুদ্ধের প্রাক্কালে আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী একটি প্রশ্ন বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলো- ওবামা কী পুনর্নির্বাচিত হতে পারবেন? পারবেন কী তার পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে আবারও হোয়াইট হাউস অলঙ্কৃত করতে? সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে আর মাত্র ৫০ দিন পরে- ৬ নবেম্বরের নির্বাচনে। এখন থেকে প্রায় চার বছর আগের কথা। ডেনভারে অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী- বারাক ওবামা প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি আমেরিকাকে বদলে দেবেন। তিনি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন যে, তিনি গোষ্ঠীগত পার্থক্যকে আমলে নেবেন না। তিনি আরও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন যে, তিনি বেকারদের মনে নতুন আশার আলো পুনরুজ্জীবিত করবেন; বৈশ্বিক উষ্ণতার কবল থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর কার্যক্রম শুরু করবেন; আর আমেরিকাকে পুনরায় গর্বের আসনে আসীন করবেন।
কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, চার বছর আগের চাইতে এখন আরো ত্রিশ লাখ আমেরিকান কর্মহীন। বেকার। আমেরিকায় এখন চাকরির বাজার খুবই আক্রা। রিপাবলিকান শিবিরের এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ২ কোটি ৩০ লাখ আমেরিকান কাজ পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। চাকরির বাজারের এই দৈন্য প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য যন্ত্রণাদায়ক বিষফোঁড়া হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্ববিখ্যাত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের জনমত জরিপে উঠে এসেছে যে, ৪৩ ভাগ আমেরিকানই মনে করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে ভাল নয়। আমেরিকার জাতীয় ঋণ ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বেড়েছে। গোষ্ঠীগত জটিলতা এযাবতকালের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নাজুক। তিনি পুঁজিবাদ অপছন্দ করুন কিংবা এর প্রতি যতই নিষ্পৃহ থাকুন না কেন, মার্কিন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। তার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধ প্রচেষ্টা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্বের কাছে আমেরিকা এখন জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলের চেয়ে উন্নততর নয়। আমেরিকার কাছে ইরান এখনও বিপজ্জনক। প্রতিশ্রুত নবরূপায়ণ এবং গুয়ান্তানামো বে কারাগার খুলে দেওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া ও চীন এখনও প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে স্বস্তিদায়ক নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতিপক্ষ মিট রমনি ও তার রিপাবলিকান সমর্থকরা ওবামার এসব নানা ব্যর্থতার চিত্র মার্কিন ভোটারদের সামনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরছেন।
ওবামার বিরুদ্ধে এত এত নেতিবাচক অনুষঙ্গ জড়ো করা হলেও আগামী নবেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে নিয়ে ওবামা ও তার সমর্থকরাও কিন্তু বসে নেই। বিগত চার বছরে তার ঝুলিতে শুধু যে ব্যর্থতার সওদা জড়ো হয়নি, সাফল্যের পরিমাণও যে কম নয়Ñ তা তারা জনগণের সামনে তুলে ধরছেন। দু’-দু’বার নির্বাচিত সাবেক সফল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ওবামার নির্বাচনী প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ওবামা-পতœী মিশেলও ভিন্ন এক ক্যারিশমাটিক ভঙ্গিমায় স্বামীর জন্য জনমত আকর্ষণে দারুণ অবদান রাখছেন। সম্প্রতি নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের শারলটে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেট দলীয় কনভেনশনের উদ্বোধনী দিনে ভাষণ দিতে গিয়ে মিশেল বলেন, ‘ওবামা একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে অসাধারণ। তিনি মার্কিন জনগণের স্বপ্ন সম্পর্কে অবহিত; কারণ তিনি স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছেন। ওবামা চান দেশের প্রতিটি মানুষ সমান সুযোগ লাভ করবে।’ তিনি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় আরও বলেন, ‘আমরা অবশ্যই তেমনভাবে কাজ করব, যেমনটি আগে কখনও করিনি; এবং এই মহান দেশটিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা পুনরায় একসঙ্গে সেই নির্ভরযোগ্য মানুষটি, আমার স্বামী, আমাদের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পাশে দাঁড়াব।’
চার বছর আগে বারাক ওবামা ‘আশা’ ও ‘পরিবর্তনের’ যে পতাকা উড়িয়ে আমেরিকানদের উদ্বেলিত করেছিলেন, দৃশ্যত তা আজ অনেকটা ফিকে হয়ে এলেও তার অর্জনও কম নয়Ñএ কথা জনগণকে বোঝাচ্ছে ওবামা-শিবির। উদ্ধত ভঙ্গিতে নয়, অনেকটা মোলায়েম স্বরে, তিনি যা করতে পারেননি ওবামা তার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করছেন বিনীতভাবে। প্রবল ক্ষমতাশালী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সরলভাবেই মেনে নিচ্ছেন যে, তার এখনও অনেক কাজ বাকি। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে পারফেক্ট বা নিখুঁত হতে পারেননি বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন এবং আগামী মেয়াদে নির্বাচিত হলে তিনি ভোটারদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছেন। দেশে আরো স্কুল তৈরি, আরও শিক্ষক নিয়োগ, আফগানিস্তানে যুদ্ধরত বেশিসংখ্যক সৈন্য দেশে ফিরিয়ে আনা, রাস্তাঘাট তৈরি, অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে দেশকে উদ্ধার, ওয়াল স্ট্রিট পুঁজিবাজারের সংস্কারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শুরু-করা সংস্কার কর্মসূচী নতুনভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি নির্বাচনে আমেরিকান জনগণের পুনর্সমর্থন চান।
ওবামার ইরাকনীতি, সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষ্যে আল কায়েদাপ্রধান ওসামা বিন লাদেন হত্যা, বহুল প্রশংসিত স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষার্থীদের ঋণ প্রদান কর্মসূচী এমনি আরও ইতিবাচক সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরা হচ্ছে পুনঃ জনসমর্থনের আশায়। ৫ সেপ্টেম্বরের ডেমোক্রেট দলীয় কনভেনশনের পর তাদের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে জোরেশোরেইÑযদিও অনানুষ্ঠানিক প্রচার বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান উভয় শিবিরেই। তবে একটা কথা সত্যি যে, অত্যন্ত গতিশীল ও খোলামেলা প্রকৃতির বারাক ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় যে পরিমাণ জনসমর্থন পেয়েছিলেন, এখন তা অনেকটা নিম্নমুখী। তার পূর্বেকার ৬৮ শতাংশ জনসমর্থন এখন ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির চেয়ে অধিকতর সপ্রতিভ ও ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েও তিনি বেকারত্বসহ অন্যান্য অনেক বার্নিং ইস্যুতে আশানুরূপ সফল না হতে পারার কারণে তার বিপুল জনপ্রিয়তার এই নিম্নমুখিতা। তবে তার পূর্বে শুরু করা অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের সংস্কার কর্মসূচী সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য, বিগত দিনের অধিকতর পরিপক্ব অভিজ্ঞতার আলোকে অন্য অসম্পন্ন কর্মসূচীগুলো সম্পন্ন এবং নতুন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য আমেরিকার জনগণ তার পূর্বসূরি বিল ক্লিনটনের মতো তাকেও দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত করবে কিনা, তা দেখার জন্য আমাদেরক আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্র : ইকোনমিস্ট, এএফপি ও বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.